মীর কাসেমের নারকীয়তার সাক্ষী চট্টগ্রামের ডালিম হোটেল
মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়ে গেলো একাত্তরের ঘাতক জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর।
এই ঘাতকের নির্যাতন সেল ছিল চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা কাটা পাহাড়ের মোড়ে অবস্থিত ডালিম হোটেল। ভবনটির নাম মহামায়া ভবন। কিন্তু মীর কাসেমের বর্বরতায় ডালিম হোটেল নামেই এটি খ্যাতি পেয়েছে।
এই ডালিম হোটেল বহন করছে একাত্তরে মীর কাসেমের যতো নারকীয়তা আছে তার স্মৃতি।
একাত্তরে ডালিম হোটেল ছিল চট্টগ্রামের আল-বদর বাহিনীর সদর দপ্তর। এই হোটেলই ছিল সব অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু। এই হোটেলে বসেই মীর কাসেম মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সকল বর্বরতা আর নৃশংসতার নির্দেশনা দিয়েছিল। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে আটক, নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে এখানেই।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ‘ডালিম হোটেল’ ও ‘মীর কাসেম আলী’ ছিলেন অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এ হোটেলে ক্যাম্প করে মুক্তিযুদ্ধকালীন সমস্ত মানবতাবিরোধী অপরাধের তত্ত্বাবধানে ছিলেন এই আলবদর নেতা। আর নৃশংসতার জন্য তার পরিচয় হয়েছিল ‘বাঙালি খান’।
মীর কাসেম আলীর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে এই ডালিম হোটেলের কথা উল্লেখ রয়েছে। ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর প্রকাশিত রায়ে এসব কথা উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ডালিম হোটেলে বন্দিদের ওপর দিনের পর দিন নির্যাতন করা হত। নির্মম নির্যাতন সইতে না পেরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেন অনেকে। কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম, টুন্টু সেন ও রঞ্জিত দাশ ডালিম হোটেলে নির্যাতনে নির্মমভাবে প্রাণ হারান। এই ডালিম হোটেলই ছিল মীর কাসেমের ডেথ ফ্যাক্টরি।
মীর কাসেমের বিরুদ্ধে গঠন করা ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১২টি নির্যাতনের এবং দুটি নির্যাতনের পর হত্যার। এই ১৪টি ঘটনাই ঘটেছে চট্টগ্রামের ডালিম হোটেলে।
মীর কাসেম ঢাকার মানিকগঞ্জের বাসিন্দা ছিলেন। তবে তার বাবা ছিলেন চট্টগ্রামের নন্দনকাননের টেলিগ্রাফ অফিসের কর্মচারী। সেই সুবাদে মুক্তিযুদ্ধের সময় মীর কাসেম আলী পরিবারের সঙ্গে ছিলেন চট্টগ্রামে। তার বাবার কর্মস্থল চট্টগ্রাম নন্দনকানন টেলিগ্রাফ অফিসের কয়েকশ’ গজ দূরত্বে ডালিম হোটেলকেই তিনি একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার পক্ষের মানুষজনকে নির্যাতন ও হত্যার নারকীয় আস্তানা হিসেবে গড়ে তুলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র ছিলেন। এই সময় তিনি জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি এবং আলবদর বাহিনীর তৃতীয় শীর্ষ ব্যক্তি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর তার হাতে প্রথম হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয় কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনের।
ঈদের দিন ডালিম হোটেলে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনকে নির্যাতন করে হত্যা করে পরে লাশ ফেলে দেওয়া হয় নদীতে। জসিমের মামাতো বোন হাসিনা খাতুন মীর কাসেমের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় ট্রাইব্যুনালে এই বিষয়ে সাক্ষ্য প্রদান করেন।
এ ছাড়া ডালিম হোটেলের এই টর্চার সেলে আরো নির্যাতন করা হয় মৃদুল কুমার দে, শিবু দাশ, প্রদীপ তালুকদার, ন্যাপ নেতা সাইফুদ্দিন খান, এ এন নুরুন্নবী, মো. সেলিম, অরুণ কুমার চৌধুরী, শফিউল আলম চৌধুরী, ইরশাদ কামাল খান ও মোসলেহ উদ্দিন খান।
ডালিম হোটেলে মীর কাসেমের নির্যাতন সেলে নির্যাতনের শিকার এবং ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ এমরান জানান, চট্টগ্রামের নন্দনকানন টিঅ্যান্ডটি কার্যালয়ের পেছনেই এ হোটেলের অবস্থান। হিন্দু পরিবারের মালিকানাধীন এ ভবনের আসল নাম ছিল ‘মহামায়া ভবন’। ১৩৭৩ বঙ্গাব্দে চন্দ্রমোহন নাথ চট্টগ্রাম শহরের পুরাতন টেলিগ্রাফ রোডে ৬ শতক জমির ওপর তিনতলা এ ভবনটি নির্মাণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সপরিবারে তিনি ভারতে পাড়ি জমালে বাড়িটি দখল করে আলবদর বাহিনী এর নাম দেয় ডালিম হোটেল।
তিনি আরো জানান, আলবদর কমান্ডার মীর কাসেম ও তার সহযোগীরা একাত্তরে খোলা জিপ ও অস্ত্র নিয়ে চট্টগ্রাম শহর দাপিয়ে বেড়াতেন। শহরের কোথাও কোনো মুক্তিযোদ্ধা গোপনে আশ্রয় নিয়েছেন বলে খবর পেলেই তার নেতৃত্বে বদর বাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যদের নিয়ে অভিযান চালিয়ে তাদের ধরে ডালিম হোটেলে নিয়ে আসত। তাদের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ও তাদের অস্ত্রের বিষয়ে জানতে চাওয়া হত। করা হতো নিষ্ঠুর নির্যাতন। নির্যাতনের পর বন্দিরা পানি খেতে চাইলে প্রশ্রাব পান করতে দেওয়া হত।
একই সময়ে ডালিম হোটেলে নির্যাতনের শিকার মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর চৌধুরী জানান, ১৯৭১ সালের ২৩ নভেম্বর চট্টগ্রামের কদমতলী এলাকায় কারফিউ দিয়ে আটক করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। চান্দগাঁও এলাকায় নিজ বাড়ি থেকে ৩০ নভেম্বর ভোরে গ্রেপ্তার করা হয় মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মো. এমরানকে। মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী ৩০ নভেম্বর আন্দরকিল্লায় গোপন আস্তানায় বদর বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। নির্মম নির্যাতন সহ্য করে ভাগ্যক্রমে তারা বেঁচে ছিলেন এবং তারা মীর কাসেমের ওই মৃত্যুঘর থেকে মুক্ত হতে সক্ষম হন।
নির্যাতনের স্মৃতি বহন করে এই ডালিম হোটেলটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে। এই ভবনের বর্তমান মালিক চন্দ্র মোহন নাথের বংশধররা। সরেজমিন ওই ভবনে গিয়ে ভবনের মালিক ও তার পরিবারের কোনো সদস্যের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তারা কেউ গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলেন না বলে স্থানীয়রা জানায়। ভবনের নিচতলায় বর্তমানে তিনটি দোকান আছে। তৃতীয় তলায় থাকেন ভাড়াটিয়ারা। দ্বিতীয় তলায় বাস করেন মালিক চন্দ্র মোহন নাথের চার ছেলে বাবুল চন্দ্র নাথ, সুভাষ চন্দ্র নাথ, সুকুরঞ্জন নাথ ও অরুণ চন্দ্র নাথ ও তাদের পরিবার।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
রবিবার যেসব এলাকায় ১০ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না
গ্যাস পাইপলাইনের মেরামত কাজ ও জরুরি স্থানান্তরের জন্য রবিবার দেশেরবিস্তারিত পড়ুন
জেমিনি চ্যাটবটে যুক্ত হলো মেমোরি, যে সুবিধা পাওয়া যাবে
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) চ্যাটবট জেমিনিতে নতুন সুবিধা যুক্ত করেছে গুগল।বিস্তারিত পড়ুন
ঢাকা সিটি কলেজে ক্লাস বন্ধ রাখা নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত
ঢাকা কলেজের বাস ভাঙচুরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত বুধবার সংঘর্ষেবিস্তারিত পড়ুন