“মুই অ্যালা এটিই থাকিম; কোথাও যাবার নং”
একেবারে শেষ মুহূর্তে ছবি তোলার জন্য তুলসীতলায় যেতে বলার পর অশ্রুরুদ্ধ হয়ে পড়েন কৃষ্ণকান্ত বর্মণ। চোখ ছলছল করছিল। তুলসীতলায় দাঁড়ানোর পর আর কান্না থামিয়ে রাখতে পারেননি। হাতজোড় করে কাঁদতে কাঁদতে আপন মনে বলতে থাকেন_ ‘ঠাকুর অক্ষা (রক্ষা) করিস। অ্যামুন ভুল আর করবেন নং। দোহাই তোর, হামাক বাপ-দাদার মাটিতে অধিষ্ঠান আকিস (রাখিস)।’
বাংলাদেশে যুক্ত হওয়া সদ্যবিলুপ্ত ভারতীয় ছিটমহল দাসিয়ারছড়ার দেবীরহাট গ্রামের বাসিন্দা তিনি। ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়নের পর ভারতে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে নাম নিবন্ধন করেছিলেন। কিন্তু ভারতে যাওয়ার দিনক্ষণ যখন এগিয়ে আসছে, তখনই আতঙ্কিত হয়ে উঠেছেন কৃষ্ণকান্ত। কৃষ্ণকান্ত একা নন; দাসিয়ারছড়ার নাম নিবন্ধনকারী এমন আরও ৫৪ জন এখন ভারতে যাওয়ার ব্যাপারে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছেন। আরও ৩৫ জন তাদের নামে ইস্যু হওয়া ভারতীয় ট্রাভেল পাস গ্রহণই করেননি। তারাও বাংলাদেশে থেকে যাবেন বলে মনস্থির করেছেন।
যখন থেকে যাওয়ার সুযোগ ছিল তখন কেন যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছিলেন? শুধু কৃষ্ণকান্তকে একা নয়; প্রশ্নটি করা হয়েছিল এখন ভারতে যেতে অনিচ্ছুক দেবীরপাটের হিন্দুদের ১১টি পরিবারের সবাইকে। উত্তরে তারা নিঃশর্ত দুঃখ প্রকাশ করেন। অকপটে স্বীকার করেন কাজটা ভুল হয়ে গেছে। দুর্গোৎসবের মহাসপ্তমীর দিন বলেই হয়তো সবাইকে বাড়িতে পাওয়া গেল। বর্মণদের সবারই বাড়ি দেবীরপাট গ্রামে। খোলা মাঠের পাশ দিয়ে গ্রামে ঢুকতেই পূজামণ্ডপের সামনে দেখা হলো প্রতাপ চন্দ্র বর্মণের সঙ্গে। বর্মণদের নেতৃস্থানীয় এই ব্যক্তিটি এক সময় দাসিয়ারছড়া পঞ্চায়েতের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। প্রতাপের সঙ্গে আলাপ শুরু হওয়ার আগেই সেখানে এসে উপস্থিত হন গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি ধীরেন্দ্রনাথ বর্মণ। ভারতে যেতে অনিচ্ছুকদের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ জানালে প্রতাপ আমাদের অপেক্ষা করতে বলে তাদেরকে ডেকে আনতে গ্রামের ভেতর লোক পাঠালেন। এই অবসরে ধীরেন্দ্রনাথ ও প্রতাপের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, জ্ঞাতিগোষ্ঠী মিলিয়ে বর্মণরা এখানে এখনও ৩০ পরিবার আছে। এই ৩০ পরিবারের মধ্য থেকে ১৫টি পরিবার ভারতে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে নাম নিবন্ধন করিয়েছিল। এখন মাত্র চার পরিবার যেতে ইচ্ছুক। বর্মণরা সবাই কৃষিজীবী। তাদের কারও কারও ১৫ থেকে ২০ বিঘা পর্যন্ত জমি আছে। সম্পর্কে মামা-ভাগ্নে ধীরেন্দ্রনাথ ও প্রতাপ দু’জনই সম্পন্ন কৃষক এবং শুরু থেকে একবারের জন্যও তারা দাসিয়ারছড়া ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবেননি।
প্রতাপ বলেন, ‘আমি প্রথম দিন থেকেই সবাইকে ভারতে যেতে নিষেধ করেছি। বারবার বলেছি_ সপ্ত পুরুষ যেথায় মানুষ, সে মাটি সোনার বাড়া। কেউ আমার কথা কানে নেয়নি।’ প্রতাপ আরও জানান, ট্রাভেল পাস পাওয়ার পর দাসিয়ারছড়ার ৩৯ জন একসঙ্গে কোচবিহারের দিনহাটায় গিয়ে দেখে এসেছে ছিটমহলের লোকজনের জন্য সেখানকার কৃষিমেলার পাশে পাকা ভিটের ওপর টিনের বাড়ি বানানো হচ্ছে। একেক পরিবারের জন্য ১২ ফুট বাই ১৪ ফুট করে দুটি ঘর দেওয়া হবে। অবস্থাটা যেন একাত্তরের শরণার্থী শিবিরের মতো। দাসিয়ারছড়ার মুক্ত পরিবেশ ছেড়ে সাধ করে কে মরতে যাবে ঘিঞ্জি বস্তিতে! তা ছাড়া এখানে যে জমিজমা আছে, তা-ও বিক্রি করা যাচ্ছে না। ক্রেতা পাওয়া গেলেও তারা এমন দর সাধছে, যে তার চেয়ে বিনে পয়সায় জমি দান করে দেওয়া ভালো। জমিজমা বিক্রি করা গেলে হয়তো নতুন দেশে গিয়ে নিজেদের মতো কিছু একটা ব্যবস্থা করা যেত।
প্রতাপের সঙ্গে আলাপের ফাঁকেই সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছেন কৃষ্ণকান্ত বর্মণ। প্রতাপের কথার বিরোধিতা করে কৃষ্ণকান্ত বললেন, ‘মুই অত কিছু বুঝং নাই (বুঝিনি)। যখন দিনহাটায় গেছং (গেলাম), তখন মোর মনটা চমকি উটিল (কেমন করে উঠল)। তখন মোর মনে হইল, বাপ-দাদার ভিটাবাড়ি ছেড়ে মুই কোটে এলুং (কোথায় এলাম)! মুই অ্যালা এটিই থাকিম; কোথাও যাবার নং।’
এরই মধ্যে একে একে এলেন সিদ্ধান্ত পরিবর্তনকারী নারায়ণ বর্মণ, রামপ্রসাদ বর্মণ, বাবুল বর্মণ, শশীভূষণ বর্মণ, গজেন্দ্র বর্মণ, মণীন্দ্র বর্মণ, মোহন বর্মণ, মিলন বর্মণ, দধিরাম বর্মণ ও কামনী বর্মণ এবং তাদের পরিবারের সদস্যদেরও কেউ কেউ। কেউ কেউ এই প্রতিবেদকদের বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি মনে করে তাদের যেন ভারতে যেতে না হয়, সে ব্যবস্থা করে দেওয়ার অনুরোধ করতে থাকেন।
ছোটরা যে বড়দের এত কথা বোঝে না তা বোঝা গেল কৃষ্ণকান্তের মেয়ে সপ্তম শ্রেণীপড়ূয়া সুবর্ণার কথায়। দেবীরপাট থেকে ফেরার পথে কৃষ্ণকান্তের বাড়ি যেতে যেতে কথা হয় সুবর্ণার সঙ্গে। সে জানায়, মা-বাবা যখন ভারতে চলে যাওয়ার অপশন দিয়েছিল, তখন দিদিদের ফেলে, খেলার সাথীদের ফেলে চলে যেতে হবে বলে সুবর্ণার ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল। কৃষ্ণকান্তের বড় দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে বাংলাদেশে। কাউকে ফেলে যেতে হচ্ছে না জেনে সুবর্ণা এখন ভীষণ খুশি। কিন্তু সে জানে না_ থেকে যেতে চাইলেও হয়তো শেষ পর্যন্ত চলে যেতে হবে তাদের। সুবর্ণাকে এ কথা জানাতেই কৃষ্ণকান্ত আবার বললেন, ‘মুই কোথাও যাবার নং। দেখি কাই মুক পাঠায়? কাই মুক নিয়ে যাবার পাবার নয়। নিয়ে গেলে মোর লাশ নেবে।’
দাসিয়ারছড়ার ১৩ পরিবারের যে ৫৫ জন ভারতে যেতে চান না, তারা এরই মধ্যে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসককে লিখিতভাবে বিষয়টি অবহিত করেছেন এবং জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে লিখিত আবেদন করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বরাবর। জেলা প্রশাসক খান মো. নুরুল আমিন বলেন, দাসিয়ারছড়ার ১৩টি পরিবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে থেকে যেতে চাইছে। তবে এটি এখন দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিষয়।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার (রাজশাহী) সন্দীপ মিত্র বিষয়টি অবগত আছেন বলে জানালেন। তিনি বলেন, আমরা জেনেছি_ ভারতে যেতে ইচ্ছুক কেউ কেউ এখন সিদ্ধান্তহীনতায় আছেন। তারা শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত নেন, তা জানার জন্য আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। সময় হলে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
উল্লেখ্য, যে ১৩ পরিবার শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে থেকে যেতে চাইছে তাদের মধ্যে দুটি মুসলিম পরিবারও রয়েছে। এরা হলেন আবদুল্লাহ রহমানের পরিবারের পাঁচ সদস্য এবং বদিয়ার রহমানের পরিবারের তিন সদস্য।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
ডিএমপি: ৫ আগস্ট পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে
ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. সারোয়ার জাহানবিস্তারিত পড়ুন
আমির খসরু: নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণকে দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দিতে হবে
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, “গণতন্ত্রেরবিস্তারিত পড়ুন
নারায়নগঞ্জে কোটা আন্দোলনকারীর উপর আক্রমন
নিজস্ব প্রতিবেদক : নারায়নগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ এলাকায় কোটা আন্দোলনকারী সংগঠকবিস্তারিত পড়ুন