আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেই হইচই ফেলে দিয়েছেন চারদিকে। ভারত সিরিজে দুর্দান্ত বোলিংয়ে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছেন সবাইকে। স্বাভাবিকভাবেই এখন স্পটলাইটের উজ্জ্বল আলোটা মুস্তাফিজুর রহমানের ওপর। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বন্ধুর পথে তরতরিয়ে এগিয়ে যেতে তরুণ-উদীয়মান মুস্তাফিজকে মূল চ্যালেঞ্জটা সামলাতে হবে এখনই।
এখন থেকেই তিনি নিয়মিত প্রতিপক্ষের রাডারে থাকবেন, তাঁর বোলিং নিয়ে হবে প্রচুর বিচার-বিশ্লেষণ। তাঁর বিভিন্ন কৌশলকে ভোঁতা করে দিতে প্রতিপক্ষও আঁটবে নানা ছক। তবে সেরাদের মূল বৈশিষ্ট্যই তো প্রতিপক্ষের সব কৌশল-পরিকল্পনা মিথ্যে বানিয়ে এগিয়ে যাওয়া। কিংবদন্তি খেলোয়াড়েরাও তা-ই করেছেন। দীর্ঘদিন ধারাবাহিক পারফর্ম করে নিজেদের নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়। মুস্তাফিজ কি পারবেন নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে?
মুস্তাফিজ প্রতিভাবান; তবে শুরুতেই তিনি যে এভাবে কিস্তিমাত করবে তা ভাবেননি গাজী আশরাফ হোসেন। তবে অতি মুস্তাফিজ-নির্ভর না হওয়ার পরামর্শ বাংলাদেশ দলের এ সাবেক অধিনায়কের, ‘মুস্তাফিজকে প্রায় তিন বছর দেখছি। শুরু থেকেই তাকে সম্ভাবনাময় মনে হয়েছে। তবে এসেই এমন কিস্তিমাত করবে, ভাবিনি! এতে আমরা যেন আবার “মুস্তাফিজ-নির্ভর” না হয়ে যাই। কেবল মুস্তাফিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে, এমন নয়। পাঁচ-ছয় উইকেট প্রতিদিন পাওয়া যাবে না। সে যদি তার অস্ত্রগুলো ব্যবহার করে দ্রুত উইকেট তুলে নিতে পারে, অপরপ্রান্তের বোলাররা তাতে সুবিধা পাবে।’
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কঠিন এক জায়গা। নিজেকে দীর্ঘদিন ধরে রাখতে হলে ভান্ডারে যোগ করতে হবে নানা অস্ত্র। নিজেকে ভেঙে গড়তে হবে প্রতিনিয়তই। মুস্তাফিজ সম্পর্কে গাজী আশরাফ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখন একজন ক্রিকেটারকে নিয়ে অনেক বেশি বিশ্লেষণ হয়। তাই নিজের শক্তি ও দুর্বলতা সম্পর্কে সব সময়ই সজাগ থাকতে হবে। অত্যাধুনিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতিপক্ষ খুব দ্রুতই একজন খেলোয়াড়কে পড়ে ফেলে। ভান্ডারে নতুন অস্ত্র যোগ করতে না পারলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টিকে থাকা খুব কঠিন। অজন্তা মেন্ডিস এ ব্যাপারে দারুণ এক উদাহরণ।’
বছর দুয়েক আগে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের পেস বোলিংয়ের কোচ হয়ে এসে মুস্তাফিজুরকে নিয়ে কাজ করেছিলেন রণদেব বসু। সাবেক ছাত্রের সাফল্যে স্বাভাবিকভাবেই আপ্লুত তিনি। কলকাতা থেকে ফোনে রণদেব বললেন, ‘মুস্তাফিজের সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে শেখার ইচ্ছে। এই দিকটা ওকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। নিজের শক্তিশালী ও দুর্বল দিকগুলো নিয়ে বেশ ওয়াকিবহাল সে। ওকে যা করতে বলতাম, শতভাগ চেষ্টা করত। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দীর্ঘদিন টিকে থাকতে হলে তাকে আরও কয়েকটি বিষয় আয়ত্তে নিয়ে আসতে হবে।’ ভান্ডারে আর কী কী অস্ত্র যোগ করতে পারে মুস্তাফিজ—রণদেব বাতলে দিলেন কয়েকটি উপায়। বললেন ‘মোটা দাগে চারটি জিনিস বলব।
১. পেসটা আরও বাড়াতে হবে। অনেক কন্ডিশনে ঠিকঠাক সুইং পাবে না। তখন পেসের দরকার হবে। যে গতিটা রুবেল বা তাসকিনের আছে। ওদের মতো অত গতি না হলেও কাছাকাছি অন্তত থাকতে হবে। ঘণ্টায় ১৩৬-১৩৭ কিলোমিটার করতে পারলে ভালো। ১৪০ কিলোমিটারে করতে পারলে তো কথাই নেই! আমার বিশ্বাস, তার সে সক্ষমতা আছে।
২. সব সময় পাঁচ-ছয় উইকেট সে পাবে না। উপমহাদেশের উইকেট সাধারণত ন্যাড়া। কখনো কখনো খারাপ দিন যাবে। এ খারাপ সময়টা যাতে নিজের ওপর প্রভাব না পড়ে, সতর্ক থাকতে হবে। এখানে আশপাশের মানুষের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। বাংলাদেশের দর্শকেরা এমনিতে খুবই আবেগপ্রবণ। খেলোয়াড়দের কাছে প্রত্যাশার পারদ থাকে আকাশচুম্বী। সে প্রত্যাশাটা প্রতিদিন পূরণ করা সম্ভব নয়। কোনো খেলোয়াড় পারেনি। তবে কখনো ব্যর্থ হলেও দ্রুত যাতে ছন্দে ফিরে আসতে পারে, সে সক্ষমতা থাকতে হবে।
৩. ভান্ডারে ভালো কিছু বাউন্সার রাখতে হবে। ওর কাটার-স্লোয়ার দেখেছি। সঙ্গে গতিময় বাউন্সারও আয়ত্ত করতে হবে।
৪. সে অফ কাট বেশ ভালো পারে। বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের জন্য লেগ কাটও ভালোভাবে শিখতে হবে।’
গাজী আশরাফের মতে, আরও কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে মাশরাফি বিন মুর্তজা, রুবেল হোসেন, তাসকিন আহমদকেও। তাতে হয়তো চাপ কমবে মুস্তাফিজের ওপর। বাংলাদেশ দলের এ সাবেক অধিনায়ক বললেন, ‘মুস্তাফিজকে বাংলাদেশ দলের ‘‘জাদুরকাঠি’’ বলতে চাই না। সে যদি নিয়মিত পারফর্ম করতে পারে, সেটা দারুণ হবে। তবে সব সময় তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা যাবে না। মাশরাফি, রুবেল, তাসকিনকেও নিয়মিত কার্যকরী বোলিং করতে হবে। এতে ওর ওপর চাপটা কম থাকবে।’
রণদেব অবশ্য বললেন, মুস্তাফিজকে কেবল ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টির জন্য নয়; প্রস্তুত করতে হবে টেস্টের জন্যও। মুস্তাফিজকে হতে হবে লম্বা রেসের ঘোড়া! ’