যৌনপল্লির ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-ব্যারিস্টারে মডেল ঊষা
যৌনপল্লির ছোঁয়ায় যেন আর থাকতে না হয় তাঁদের সন্তানদের৷ তাঁদের সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে৷ এবং, সেই কারণেই তাঁদের সন্তানদের ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ব্যারিস্টার হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছেন যৌনকর্মীরা৷
আর, এমন স্বপ্নে তাঁরা যাতে বুঁদ হয়ে থাকতে পারেন, ওই রকম স্বপ্ন পূরণের মাধ্যমে তাঁদের জীবনে যাতে নতুন সকাল আসে, তার জন্য যৌনকর্মীদের কাছে অন্যতম সহায় হয়ে উঠেছে ঊষা৷ ওই ঊষার হাত ধরেই যৌনকর্মীরা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছেন তাঁদের স্বপ্ন পূরণের পথে৷ শুধুমাত্র ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারব্যারিস্টার-ও নয়৷ রয়েছে অন্য নানা স্বপ্ন-ও৷ এবং, সেই সব স্বপ্ন পূরণের জন্যেও, নতুন ভোর হিসেবে অন্যতম সহায় ওই ঊষা-ই৷
আর, সেই কারণেই, যৌনকর্মীদের কন্যা-সন্তানদের বিয়ের জন্য যেমন খরচ জোগাড় করতে সমস্যায় পড়তে হয় না৷ তেমনই আবার, ঘর-বাড়ি তৈরি অথবা মেরামতি কিংবা রক্ষণাবেক্ষণ থেকে শুরু করে প্রয়োজনে যৌনকর্মী এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা-র জন্য খরচ জোগাড়েও কোনও সমস্যায় পড়তে হয় না৷ শুধুমাত্র তাই নয়৷ যৌনকর্মীদের রাজনৈতিক অধিকারও এনে দিয়েছে ওই ঊষা-ই৷ কেননা, ঊষা-র প্রমাণপত্র দেখিয়েই নির্বাচন কমিশনের পরিচয়পত্র তৈরি করাতে পারছেন যৌনকর্মীরা৷ সব মিলিয়ে, সমবায় ব্যাংক হিসেবে নতুন পথের-ও সন্ধান দিয়েছে ঊষা৷ পরিচিত পথ থেকে ওই ভিন্ন পথে সাফল্যের জেরে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে সেরা সমবায় ব্যাংকের সম্মান-ও এসেছে ঊষার ঘরে-ই৷
ইতিমধ্যেই ঊষার সাফল্য-কে অনুসরণ করে যাত্রা শুরু হয়েছে বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে৷ তবে, এখানেই আবার থেমেও থাকতে রাজি নয় ঊষা৷ আগামী দিনে সমবায়-এর তকমা থেকে মুক্ত হয়ে, একটি ব্যাংক হিসেবে আত্মপ্রকাশের জন্যেও স্বপ্নের পাখা মেলে দিয়েছে ঊষা৷ তেমনই, শুধুমাত্র যৌনকর্মীদের জন্য নয়৷ এ দেশের বিভিন্ন অংশের প্রান্তিক মানুষের যথাযথ উন্নয়নের জন্য, ঊষা-কে মডেল হিসেবে গড়ে তোলারও দাবি করা হচ্ছে৷ ওই ঊষা অর্থাৎ, ঊষা মাল্টিপারপাস কোঅপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড-এর ২০ বছর পূর্তিতে, শুরু হচ্ছে সপ্তাহব্যাপী উৎসব৷ আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে দুই অক্টোবর পর্যন্ত কলকাতার শ্রদ্ধানন্দ পার্কে চলবে ওই উৎসব, ঊষা মেলা৷ শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-ও নয়৷ ওই মেলায় থাকছে ঊষার সাফল্য তথা সমবায় ব্যাংক হিসেবে ভিন্ন পথের সাফল্য সহ সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর যথাযথ উন্নয়নের জন্য আলোচনা-বিতর্ক এবং মতামত বিনিময়ের অনুষ্ঠানও৷
ওই সব অনুষ্ঠানে দেশ-বিদেশের বহু বিশেষজ্ঞের অংশ নেওয়ার কথা৷ ঊষা মেলা-র আহ্বায়ক তথা পশ্চিমবঙ্গের যৌনকর্মীদের অন্যতম সংগঠন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির সচিব ভারতী দে-র কথায়, ‘‘গরিব মানুষ এবং সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর যথাযথ উন্নয়নের জন্য আলোচনা, বিতর্ক এবং মত বিনিময়ও হবে ঊষা মেলায়৷ আর, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে থাকছে নাটক, মূকাভিনয়, সঙ্গীত, নৃত্য সহ আরও বিভিন্ন বিষয়৷’’ অথচ, পরিচিত পথের বাইরে হেঁটে সাফল্যের মুখ দেখা-র কাজটিও সহজ ছিল না ঊষার কাছে৷ ১৯৯৫-এ মাত্র ১৩ জন যৌনকর্মীকে নিয়ে পথ চলা শুরু করেছিল, যৌনকর্মীদের দ্বারা এবং যৌনকর্মীদের জন্য ব্যাকং, ঊষা৷ এক সময় ঊষা-কে অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আইন৷ পরে অবশ্য ওই আইন সংশোধন করা হয়েছিল৷ আর, এখন ঊষা-র সদস্য সংখ্যা সাত হাজার৷
তেমনই, শুধুমাত্র টাকা গচ্ছিত রাখা-ও নয়৷ প্রয়োজনে যাতে ঋণ-ও নিতে পারেন ঊষার সদস্যরা, তার জন্যেও রয়েছে ব্যবস্থা৷ আর, সুদের পাশাপাশি বছরে যে আয় করে ঊষা, তাও সদস্যের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়৷ তবে, যৌনকর্মীদের বিভিন্ন ধরনের স্বপ্ন পূরণের জন্য অন্যতম সহায় ঊষার দেওয়া ঋণ৷ এই প্রসঙ্গে ঊষা মাল্টিপারপাস কোঅপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড-এর ফিনান্স ম্যানেজার শান্তনু চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘গত আর্থিক বছরে মোট ছ’ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে৷ এর মধ্যে সর্বাধিক ৪২ শতাংশ ক্ষেত্রে ঋণ দেওয়া হয়েছে যৌনকর্মীদের সন্তানদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার হিসেবে গড়ে তোলার জন্য৷ ২৪ শতাংশ ক্ষেত্রে ঋণ দেওয়া হয়েছে তাঁদের ঘর-বাড়ি তৈরি অথবা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য৷ ১২ শতাংশ ক্ষেত্রে ঋণ দেওয়া হয়েছে যৌনকর্মী এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য৷ আর, অবশিষ্ট ২২ শতাংশ ক্ষেত্রে ঋণ দেওয়া হয়েছে যৌনকর্মীদের কন্যা-সন্তানদের বিয়ের খরচ সহ তাঁদের অন্যান্য বিষয়ের জন্য৷’’
একই সঙ্গে শান্তনু চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘উন্নয়নের দিশা, সমবায়ে ঊষা৷ এটাই এখন আমাদের স্লোগান৷ শুধুমাত্র যৌনকর্মীরা নন৷ ট্রান্সজেন্ডার, গৃহশ্রমিক এবং বিভিন্ন স্বনির্ভর গোষ্ঠী সহ সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রান্তিক মানুষের উন্নয়নের জন্যেও আমরা এ বার ঋণ দেব৷’’ অর্থনৈতিক উন্নতি কীভাবে একজন যৌনকর্মীকে সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে চলতে সহায়তা করে, তাও দেখিয়ে দিয়েছে ঊষা৷ এ কথা জানিয়ে ঊষা মাল্টিপারপাস কোঅপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড-এর ফিনান্স ম্যানেজার বলেন, ‘‘এইচআইভি-এইডস প্রতিরোধ সহ যেভাবে যৌনকর্মীদের মধ্যে কনডোম ব্যবহারের সাফল্য-ও মিলেছে, তার জন্যেও অন্যতম কারণ তাঁদের অর্থনৈতিক উন্নতির বিষয়টি৷’’ সমবায় নয়, আগামী দিনে ঊষা যাতে ব্যাংক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে, তার জন্যে প্রচেষ্টা জারি রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি৷ শুধুমাত্র তাই নয়৷
দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির মুখ্য উপদেষ্টা ডাঃ স্মরজিৎ জানা বলেন, ‘‘সরকারের তরফে উন্নয়নের মাপকাঠি হিসেবে জিডিপি-র কথা বলা হয়৷ কিন্তু, সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রান্তিক মানুষের যথাযথ উন্নয়নও প্রয়োজন৷ অথচ, বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষকে কোনও ব্যাংক ঋণ-ও দেয় না৷ আমরা সেই কাজ-ও করছি৷’’ একই সঙ্গে ডাঃ স্মরজিৎ জানা বলেন, ‘‘সমবায় ব্যাংকের পরিচিত পথের বাইরে হেঁটে, সমাজের পিছিয়ে পড়া বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের যথাযথ উন্নয়নের জন্য ঊষা কাজ করছে৷ আমাদের আর্জি, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের যথাযথ উন্নয়নের জন্য ঊষার সাফল্যকে সরকারের তরফে মডেল হিসেবে গ্রহণ করা হোক৷’’ শুধুমাত্র কলকাতার অন্যতম যৌনপল্লি, সোনাগাছি নয়৷ দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির অধীনে থাকা কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তের যৌনপল্লিতে, এ ভাবেই স্বপ্নের ভোর এনে দিয়েছে ঊষা-ই৷ এবং, এ ভাবেই, এ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের যৌনকর্মীদের নানা রঙের স্বপ্ন পূরণেও, ওই ঊষা-র হাত ধরেই দেখা দিচ্ছে নতুন নতুন সকাল৷
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
ধর্ষণের অভিযোগের তদন্ত চলায় এমবাপ্পেকে বিজ্ঞাপন থেকে সরাল রিয়াল
আর্থিক দ্বন্দ্বের মধ্যে পিএসজি ছেড়ে রিয়াল মাদ্রিদে আসার পর একেরবিস্তারিত পড়ুন
ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর পদ হারালেন গাজীপুর জেলা ছাত্রদলের সভাপতি
ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর সাংগঠনিক শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে গাজীপুর জেলা ছাত্রদলেরবিস্তারিত পড়ুন
ঢাকা উত্তর সিটির সাবেক মেয়র আতিকুল গ্রেপ্তার
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামকে রাজধানীরবিস্তারিত পড়ুন