রাস উৎসবে হরিণ নিধনের আশঙ্খা
ব্যাপক নজরদারী থাকা সত্ত্বেও এবারের রাস উৎসবে দর্শনার্থী ও পর্যটকদের সাথে ছদ্মবেশে যোগ দিচ্ছে বিপুল সংখ্যক শিকারী চক্র। মেলায় আগত দর্শনার্থীদের হরিণের মাংস দিয়ে আপ্যায়নের বাড়তি সুবিধার কথা বলে মোটা অংকের অর্থ বাণিজ্যের কৌশল হিসেবে একটি সঙ্গবদ্ধ চক্র হরিণ শিকারীদের একত্রিত করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, বনজ সম্পদ রক্ষায় এবার পশ্চিম সুন্দরবন বিভাগের উদ্যোগে নেয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তবে তা হরিণ শিকার রোধে কতটুকু প্রভাব পড়বে সেটা নিয়ে শুরুতেই আশঙ্কা করেছেন সুন্দরবন উপকূলীয় অধিবাসীরা। তাদের দেয়া তথ্যমতে, সুন্দরবনের ১৩২তম ঐতিহ্যবাহী রাস মেলাকে ঘিরে শুরু হয়েছে শিকারীদের হরিণ শিকারের অপতৎপরতা। ইতোমধ্যে বিভিন্ন ছদ্মাবরণে পেশাদার চোরা শিকারীরা প্রবেশ করতে শুরু করেছে বনাঞ্চলে। তাদের অনেকে বনজীবী সেজে বন বিভাগ থেকে মাছ ও কাঁকড়া ধরার পারমিট নিয়ে হরিণ শিকারের ফাঁদসহ বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে ঢুকে পড়ে বন অভ্যন্তরে।
বাইরের দর্শনার্থীদের পাশাপাশি সুন্দরবন সংলগ্ন ৮টি উপজেলার প্রায় শতাধিক চোরা শিকারী চক্র মেলাকে সামনে রেখে মেতে উঠে বনের মায়াবী চিত্রল হরিণ নিধনের মহোৎসবে। পরিবেশবিদদের ধারণা, সারা বছর সুন্দরবন থেকে যে পরিমান হরিণ শিকার হয় তার অর্ধেকেরও বেশী পরিমাণ শিকার হয় রাস উৎসবের সময়ে।
সূত্র মতে, বঙ্গোপসাগরের দূবলার চরে (আলোর কোল) ২৪ নভেম্বর শুরু হচ্ছে ৩দিন ব্যাপী রাস উৎসব। বন বিভাগের পক্ষে মেলাকে ঘিরে ব্যাপক নিরাপত্তার সাথে সাথে দর্শনার্থীদের নিরাপদে যাতায়াতের জন্য সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ ৮টি পথ নির্ধারণ করে থাকে, এবারও তা ব্যতিক্রম হচ্ছে না। পূণ্যার্থীদের সুন্দরবনে প্রবেশের সময় জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা ইউপি চেয়ারম্যানের নিকট হতে প্রাপ্ত সনদপত্র সাথে রাখতে হচ্ছে। পরিবেশ দূষণ করে এমন বস্তু, মাইক বাজানো, পটকা ফোটানো, বিস্ফোরক দ্রব্য ও আগ্নেয়াস্ত্র বহন থেকে যাত্রীদের বিরত থাকতে হবে বলে বরাবরের মত বন বিভাগ জানিয়েছে।
সুন্দরবন বঙ্গোপসাগরের কুঙ্গা ও মরা পশুর নদীর মোহনায় জেগে উঠা দুবলার চর দ্বীপের রাস মেলা সাগর কেন্দ্রীক সবচেয়ে বড় উৎসব। মেলার ইতিহাস মতে, ১৯২৩ সালে ঠাকুর হরিচাঁদের অনুসারী হরিভজন নামে এক সাধকের হাত ধরেই এ মেলার শুরু। সেই থেকে প্রতিবছর কার্ত্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে পূর্ণিমা তিথিতে শুক্লা পক্ষে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পাপমোচন ও পার্থিব জীবনের কামনা-বাসনা পূরণের লক্ষ্যে গঙ্গাস্নানের মধ্য দিয়ে এ উৎসব পালন করে আসছে। তবে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সনাতনীদের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্ম-বর্ণের দেশী-বিদেশী পর্যটকদেরও মন কাড়তে সক্ষম হয়েছে উৎসবটি। জেলে ও বনজীবীসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও সুন্দরবনের দরবেশ গাজী-কালুর স্বরণে মানত দিতে যোগ দিয়ে থাকেন উৎসবে। আর তাই মেলাকে ঘিরেই প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে পর্যটক ও পূজারীদের অন্তরালে চোরা শিকারীদের হরিণ নিয়ে যত আয়োজন। অনেকের মতে হরিণ শিকার করতে না পারলে যেন মেলার আগমনই তাদের কাছে বৃথা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিকারী দর্শনার্থীরা জানান, নাইলনের ফাঁদ, জাল পেতে, স্প্রীং বসানো ফাঁদ, বিষটোপ, তীর বা গুলি ছুড়ে, কলার মধ্যে বর্শি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা ফাঁদ সহ পাতার উপর চেতনা নাশক ঔষধ দিয়ে নিধন করা হয়ে থাকে বিপুল সংখ্যক হরিণ। ফাঁদে হরিণ ধরা পড়লে আঁড়ালে থাকা শিকারীরা ছুটে গিয়ে আটক হরিণকে লাঠিপেটা করে মেরে নিরাপদ দুরত্বে নিয়ে জবাই করে। এরপর চামড়া, শিং সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ পাঠিয়ে দেয়া হয় উপযুক্ত ক্রেতাদের কাছে। কখনো কখনো ঝামেলা এড়াতে তা মাটিতে পুঁতে বা সাগরে ফেলে দেয়া হয়। এরপর শুরু হয় মাংস দিয়ে ভুঁরিভোজের যত আয়োজন।
সুন্দরবনের বন বিভাগের হিসাব মতে, বনের বাংলাদেশ অংশে বর্তমানে ১ লাখ ২০ হাজার চিত্রা হরিণ রয়েছে। তবে আয়তন, খাদ্য ও সার্বিক পরিবেশের উপর নির্ভর করে এর প্রকৃত সংখ্যা। মেলা চলাকালিন আনন্দে মাতোয়ারা দর্শনার্থী ও প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব চোরা শিকারীরা সুন্দরবনের হিরণ পয়েন্ট, দুবলার চর, আলোর কোল, কটকা, কচিখালী দুবলা চান্দেরশ্বর, বগি, চরখালী, তালপট্টিসহ যে সকল এলাকায় হরিণের বেশী বিচরণ শিকারীরা সে সব এলাকায় বিভিন্ন ফাঁদ দিয়ে শিকার করে চিত্রা হরিণ। তবে এবার মেলাকে ঘিরে আগের চেয়ে বেশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর বলে দাবি বন বিভাগের।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, সুন্দরবন সংলগ্ন চোর শিকারী চক্র এক প্রকার ফেরী করে বিক্রি করে থাকে হরিণের মাংস। বনরক্ষীসহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে প্রতি নিয়ত ধরা পড়ছে ফাঁদসহ শিকারীদের কেউ কেউ, উদ্ধারও হচ্ছে বিপুল পরিমান মাংস। হরিণ নিয়ে এমন চিত্র বলে দেয় সুন্দরবনের গহীনেও ভাল নেই সেখানকার অন্যতম প্রধান আকর্ষণীয় এ প্রাণীরা। চোরা শিকারীরা দল বেঁধে বৈধ-অবৈধ উপায়ে সুন্দরবনে ঢুকে গুলি করে, ফাঁদ পেতে অথবা চেতনা নাশক ট্যাবলেট দিয়ে ব্যাপক হারে হত্যা করছে সুন্দরবনের মায়াবী চিত্রল হরিণ। পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খাদ্য সংকটে, বাঘ-কুমিরের আক্রমনে মৃত্যুর সাথে যুক্ত বেপরোয়া চোরা শিকারীদের অপতৎপরতায় প্রতিমাসে মারা পড়ছে শত শত হরিণ। আর সাগর মেলাকে ঘিরে শিকারীরা যেন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে।
জানা গেছে, খুলনার কয়রা উপজেলার মহেশ্বরিপুর, কালিকাপুর, চৌকুনি, তেতুলতলারচর, শেখেরকোনা, মাঠের কোন, ৪নং কয়রা, ৬নং কয়রা, শাকবাড়িয়া, গুড়িয়াবাড়ি, পাতাখালী, জোড়াশিং, গোলখালি, খাশিটানা, গতির ঘেরি, পাইকগাছার চাঁদখালি, লস্কর, সোলাদানা, পশ্চিম বন বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের, শ্যামনগর, উপজেলার গাবুরা, ডুমুরিয়ার ৯নং সোরা, পারশেমারী, চাঁদনী মুখ, জেলেখালী, বুড়িগোয়ালিনীর দাতিনাখালী, মুন্সী গঞ্জের বিজয় সরদারের ঘাট, মীরগাং, যতীন্দ্র নগর, রমজাননগর, কালিঞ্চী, টেংরাখালী, কৈখালী, জয়খালী, বাগেরহাটের শরনখোলা, সোনাতলা, তফালবাড়ী, চালরায়েন্দা, উত্তর তাফালবাড়ী, তালজোড়া, মংলা সহ সুন্দরবন সংলগ্ন হরিনটানা, মরাতোলা, তেঁতুলবাড়িয়া, আড়াইবেঁকী, নাওলী জনপদের বহু মানুষ এক প্রকার পেশা হিসেবে বেঁছে নিয়েছে হরিণ শিকার।
সূত্র জানায়. বিভিন্ন শিকারী চক্র অবৈধ ভাবে বনে প্রবেশের পাশাপাশি বিভিন্ন ষ্টেশন থেকে সাদা মাছ ও কাঁকড়া ধরার পাশ নিয়ে সুন্দরবন অভ্যন্তরে প্রবেশ করে মেতে উঠে হরিণ শিকারে। সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রা, পাইকগাছা, শ্যামনগর, মুন্সীগঞ্জ, নওয়াবেঁকী, কাশিমাড়ী, বংশীপুর, নুরনগরসহ সেখানকার প্রত্যন্ত এলাকায় কেজি প্রতি হরিণের মাংস পাওয়া যায় মাত্র ৩/৪শ’ টাকায়।
এছাড়া তাদের কাছ থেকে এক শ্রেনীর ব্যবসায়ীরা মাংস কিনে তা বিভিন্ন মাধ্যমে পাচার করছে দেশের বিভিন্ন জেলা সদরসহ রাজধাণীতে। কখনও কখনও তাদের দু’এক জন গ্রেফতার হলেও অধিকাংশই রয়ে যায় ধরা ছোয়ার বাইরে। তবে বনবিভাগের চেয়ে পুলিশের হাতে মাংস উদ্ধারের ঘটনা বেশী ঘটে থাকে। বিভিন্ন জেলায় এসংক্রান্ত কয়েক শ’ মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
১৯৯৬-৯৭ সালে ইন্টারগ্রেটেড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (আই আর এস) প্রকল্পের আওতায় এক জরীপে সুন্দরবনে প্রায় ১ থেকে দেড় লাখ চিত্রল হরিণের অস্তীত্ব ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। এরপর আর কোন জরীপ না হওয়ায় বর্তমানে সুন্দরবনে ঠিক কি পরিমান হরিণ আছে তার সঠিক সংখ্যা নির্ণয় সম্ভব না হলেও বনের বিভিন্ন পেশাজীবীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, হরিণ নিধনের এ মহোৎসবের সময়ে আশংকাজনক ভাবে হ্রাস পেয়েছে চিত্রলরা। এমন অবস্থা চলতে থাকলে সুন্দরবন অদুর ভবিষ্যতে হরিণ শুণ্যতায় ভুগবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে সুন্দরবনের ২২ প্রজাতীর উভচর, ১৪৩ প্রজাতীর সরীসৃপ ও ১১৬ প্রজাতীর স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে রয়েলবেঙ্গল টাইগারের পরেই সবচেয়ে আকর্ষণীয় হরিণ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিটি শিকারী চক্র ৪/৫ অথবা ৮/১০ জনের দল নিয়ে ৪/৫ দিন ধরে বন অভ্যন্তরে থেকে শিকার শেষে বেরিয়ে আসে বনের বাইরে।
এরপর স্থানীয়ভাবে বিক্রি ছাড়াও মাছের বক্স, ঝুড়ি বা ট্রে কখনো কখনো বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানীর রিপ্রেজেন্টেটিভদের ব্যাগ ভরে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় পাচার করে থাকে হরিণের মাংস। সূত্র আরও জানায়, বনবিভাগের কিছু অসাধু কর্তা ব্যক্তিদের সাথে শিকারী চক্রের রয়েছে গোপন আঁতাত। মাসোহারার ভিত্তিতে তারা তাদেরকে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ ভাবে সহযোগীতা করে থাকে। বন সংলগ্ন এলাকাবাসী জানায়, হরিণের মাংস বাইরে আনার পর কিছু ধরা পড়লেও মূল মাংসের চালান ও সংশ্লিষ্টরা বরাবরই রয়ে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
মলা আয়োজক কমিটির নেতারা বলেন, অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার মেলা আনন্দ ঘন পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে তার জন্য প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে খুলনা পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জহির উদ্দিন আহমেদ বলেন, বন বিভাগের নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। জনবল ও লজিস্টিক সংকট দীর্ঘ দিনের। এ সমস্যা নিরসণ না হওয়ায় হরিণ শিকার বন্ধে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে রাস মেলাকে ঘিরে পর্যপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও টহল জোরদার করা হচ্ছে। বন বিভাগের তৎপরতায় হরিণ শিকার আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। অপর্যাপ্ত জনবল নিয়ে বিশাল সুন্দরবনের নিরাপত্তা নিশ্চিন্ত রাখা খুবই কঠিন বলেও মনে করেন তিনি।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
খুলনায় তিন কেন্দ্রে ব্যালট বই ছিনতাই, গণসিল, মহিলার কারাদণ্ড
খুলনার ফুলতলা উপজেলার দুটি ভোট কেন্দ্রের তিনটি বুথে ব্যালট বইবিস্তারিত পড়ুন
৪ হাজার কোটির খুলনা-মোংলা রেলপথ প্রস্তুত
ট্রেন চলাচলের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত খুলনা থেকে মোংলা পর্যন্ত নতুনবিস্তারিত পড়ুন
খুলনায় ছাত্রদলকর্মীকে কুপিয়ে হত্যা
খুলনা ব্রজলাল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্র ও ছাত্রদলকর্মী আবদুল্লাহবিস্তারিত পড়ুন