শরীরে স্প্লিন্টার, বয়সের সঙ্গে বাড়ছে যন্ত্রণাও
কারো বয়স ৫০ পেরিয়েছে, কারো ৫০ ছুঁই ছুঁই। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমেছে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, কমেছে যন্ত্রণা সওয়ার ক্ষমতা। কিন্তু এক যুগ আগে শরীরে বাসা বাঁধা গ্রেনেডের স্প্লিন্টারগুলোর যন্ত্রণা দেওয়ার ক্ষমতা যেন ক্রমেই বাড়ছে। স্প্লিন্টারগুলো যেন দিনে দিনে আরো বেয়াড়া হয়ে উঠছে, তিলে তিলে যন্ত্রণা দিয়ে জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে। গ্রেনেডের স্প্লিন্টার শরীরে নিয়ে অবর্ণনীয় যন্ত্রণার জীবন বয়ে বেড়ানো এ মানুষগুলো আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মী। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে সন্ত্রাসীদের গ্রেনেড হামলায় তাঁরা মারাত্মক আহত হন।
গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আহত কয়েকজন নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক যুগ আগে তাঁরা যখন গ্রেনেডের স্প্লিন্টারবিদ্ধ হন তখন তাঁদের বেশির ভাগেরই বয়স ছিল ৩৫-৪০-এর মধ্যে। সে বয়সে স্প্লিন্টারগুলো শরীরে নানা অসুবিধা তৈরি করলেও সেগুলো সহ্য করার শক্তি ছিল। কিন্তু এখন সে শক্তিতে ভাটা পড়েছে। আহতদের বেশির ভাগের বয়সই ৫০ ছাড়িয়ে গেছে। এখন আর আগের ধকল নিতে পারে না শরীর।
২১ আগস্টের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার মুহূর্তে আইভি রহমানের পাশেই ছিলেন মহিলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইয়াসমিন হোসেন। গ্রেনেড বিস্ফোরণে তাঁর শরীরের নিম্নাংশে আগুন ধরে যায়। ভেঙে যায় বাঁ পা। শরীরে বিদ্ধ হয় সহস্রাধিক স্প্লিন্টার। সেদিন তাঁর আশপাশে থাকা অনেকেই প্রাণ হারালেও বেঁচে যান ইয়াসমিন। কিন্তু এ বেঁচে থাকা যেন মৃত্যুর চেয়েও কষ্টের। প্রতিনিয়ত অসহনীয় যন্ত্রণা সয়ে চলেছেন তিনি। নিজের যন্ত্রণার কথা জানিয়ে ইয়াসমিন হোসেন বলেন, ‘শরীরের বিভিন্ন জায়গায় এখনো হাজারের বেশি স্প্লিন্টার রয়ে গেছে। দুই পা, দুই হাতে অসংখ্য স্প্লিন্টার রয়েছে। শুধুমাত্র ডান পায়ের বুড়ো আঙুলেই ৩৫টি স্প্লিন্টার রয়েছে। একটু গরম পড়লেই সমস্যা বাড়ে। রোদে বের হতে পারি না। শরীরে রোদ লাগলেই যন্ত্রণা বেড়ে যায়। এর তেমন কোনো চিকিৎসা নেই। ব্যথা বেড়ে গেলে ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়াই সমাধান। এভাবেই চলছি গত এক যুগ।’
গ্রেনেড হামলার সেই ভয়াল দিনের স্মৃতিচারণা করে ইয়াসমিন হোসেন জানান, ‘সেদিন আমি আর আইভি আপা পাশাপাশি ছিলাম। প্রথম গ্রেনেডটা এসে আইভি আপার দুই পায়ের মাঝখানে পড়ে। বিস্ফোরণের ফলে আমি কয়েক ফুট শূন্যে উঠে রাস্তায় আছড়ে পড়লাম। আমার বাঁ পা ভেঙে গেল। শরীরের নিচের অংশে আগুন লেগে পা পুড়ে কয়লার মতো কালো হয়ে গেল। শরীরে অসংখ্য স্প্লিন্টার বিদ্ধ হলো। প্রথম এক-দেড় ঘণ্টা ঘোরের মধ্যে ছিলাম, তেমন ব্যথা অনুভব করিনি। এর পরই যন্ত্রণা বুঝতে শুরু করলাম। আমাকে প্রথমে ঢাকা মেডিক্যালে ও পরে সেখান থেকে শমরিতা হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে শিকদার মেডিক্যালে ১৭ দিন চিকিৎসা দেওয়া হয়। এরপর কলকতায় চিকিৎসা নিই। কিন্তু আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারিনি।’
যে দলের জন্য নিজের স্বাভাবিক জীবন হারিয়েছেন সে দল নিয়ে খানিকটা হতাশাও ফুটে ওঠে ইয়াসমিন হোসেনের কথায়। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সেদিন আমাদের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তা না হলে হয়তো বাঁচতাম না। কিন্তু এরপর আর দল থেকে কোনো সহযোগিতা পাইনি। কেউ খোঁজখবর নিতেও এগিয়ে আসেনি।’
হতাশা সামলে নিয়ে ইয়াসমিন হোসেন বলেন, ‘১৯৮৬ সাল থেকে নেত্রীর (শেখ হাসিনা) জন্য কাজ করছি। তিনি বেঁচে আছেন, এটাই আমাদের বড় পাওয়া। কে খোঁজখবর নিল বা না নিল সেটা বড় কথা নয়।’
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আহত হন মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী ও বর্তমানে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য উম্মে রাজিয়া কাজল। তিনি বলেন, ‘বাইরে থেকে দেখলে কেউ বুঝবে না ভেতরে কী যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে চলেছি। শরীরের বিভিন্ন স্থানে সোয়া তিন শ স্প্লিন্টার রয়েছে। স্প্লিন্টারের কারণে শরীরে নানা রোগ বাসা বেঁধেছে। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসে ভুগছি। প্রচুর ওষুধ খেতে হয়। দিনে অন্তত ২০টি ট্যাবলেট। গত ১২ বছর ধরে চলছে। ওষুধেরও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও হয়।’
উম্মে রাজিয়া কাজল বলেন, ‘আগে ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা ছিল। এখন বয়স ৫০ ছুঁই ছুঁই। সহ্য করার ক্ষমতাও কমছে। অনেকটা পঙ্গু জীবন টেনে চলেছি। ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারি না। নামাজ পড়তে হয় বসে বা ইশারায়। কোমর থেকে নিচের অংশে বিশেষ করে বাঁ পায়ে যন্ত্রণা বেশি। আবার ডান পায়েও ছয়-সাতটি শিরা কাটা পড়েছে। ফলে চলাফেরায় সমস্যা হয়। মাঝেমধ্যেই যন্ত্রণা বেড়ে যায়, অস্থির লাগে। প্রতি চার মাস পর পর ভারতে যেতে হয় চিকিৎসার জন্য। প্রথম দিকে তিন বছর ক্র্যাচে ভর করে হেঁটেছি।’
গ্রেনেড হামলায় মারাত্মক আহত হয়ে দুর্বিষহ যন্ত্রণা সয়ে চলেছেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের তত্কালীন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বেঁচে থেকে মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করছি। শরীরে এখনো শতাধিক স্প্লিন্টার রয়েছে। রোদে গেলে এই স্প্লিন্টারগুলো গরম হয়ে যায়। তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রণাও বাড়ছে। ডাক্তার বলেছেন, যতক্ষণ শরীর স্প্লিন্টারগুলো সহ্য করতে পারবে ততক্ষণ ভালো থাকবেন। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমবে। এতে নানা জটিলতা বাড়বে।’
গ্রেনেড হামলায় আহত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, কেন্দ্রীয় সদস্য এস এম কামাল, মহিলা আওয়ামী লীগের শাহিদা তারেক দীপ্তি, মাহবুবা পারভীনসহ আরো শতাধিক নেতাকর্মী শরীরে স্প্লিন্টার নিয়ে এক নারকীয় যন্ত্রণার জীবন পার করছেন।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশবাসীকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপকবিস্তারিত পড়ুন
দুই দফা কমার পর ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম
টানা দুই দফা কমার পর দেশের বাজারে ফের স্বর্ণের দামবিস্তারিত পড়ুন
চট্টগ্রামে দুর্ঘটনার কবলে হাসনাত-সারজিসের বহরের গাড়ি
আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের কবর জিয়ারত শেষে ফেরার পথে সড়কবিস্তারিত পড়ুন