সংসদ লাইব্রেরির বইয়ে ভেজাল, দামে নয়ছয়
বই কেনা হয়েছে মোট ৫০টি। মোট দাম চার লাখ ১৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে তিনটি বইয়ের দাম ৯১ হাজার টাকা। একেকটি বইয়ের দাম ৩০ হাজার টাকারও বেশি! বইগুলোর কোনোটিই মূলকপি নয়, ফটোকপি।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের টাকায় বইগুলো কিনেছে জাতীয় সংসদের লাইব্রেরি। নিম্নমানের কাগজে ফটোকপি করা এই ৫০টি বই কিনতেই খরচ হয়েছে এত টাকা। শুধু তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে কেনা হয়েছে নকল বই!
সংসদ সচিবালয়ের গ্রন্থাগার গবেষণা বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন বইগুলো কিনেছেন বই সরবরাহকারী হাসান ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মুস্তাফিজের কাছ থেকে। বই কেনায় কোনো ধরনের দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। এই কাজে গ্রন্থাগার গবেষণা বিভাগের কর্মকর্তা জেব-উন-নেসা জড়িত ছিলেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, সব মিলিয়ে হয়তো ১০ হাজার টাকাও খরচ করা হয়নি। অথচ বিল নেওয়া হয়েছে চার লাখ ১৭ হাজার টাকা।
বইগুলোর মলাট ও লেখকের নাম পরিবর্তন করে একই বই দেওয়া হয়েছে ভিন্ন নামে। এ ছাড়া সরবরাহ করা বইগুলোর মধ্যে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলসহ বইও পাওয়া গেছে। আর সংসদ সচিবালয় থেকে ২০১৫ সালের বই চাওয়া হলেও দেওয়া হয়েছে ২০১২ সালের বই।
প্রাথমিক তদন্তে অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছেন ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া। আর পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।
প্রকল্পের টাকায় নয়ছয়
সংশ্লিষ্টরা জানান, সংসদ সচিবালয়ের জন্য তিন লাখ টাকার কেনাকাটা করতে গেলে দরপত্রের মাধ্যমে করা হয়। কিন্তু ওই টাকা প্রকল্পের হওয়ায় দরপত্র আহ্বান করা হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ইউএনএফপিএর স্ট্রেথদেনিং পার্লামেন্টস ক্যাপাসিটি ইন ইন্টেগ্রেটিং পপুলেশন ইস্যু ইন টু ডেভেলপমেন্ট (এসপিসিপিডি) নামের একটি প্রকল্পের পাঁচ লাখ টাকা উদ্বৃত্ত থাকে। ২০১৫ সালে ওই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়। লাইব্রেরি কমিটির সভাপতি ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বী মিয়া লাইব্রেরির উন্নয়নে ওই টাকা ফেরত না দিয়ে বই কেনার পরামর্শ দেন। এতে সম্মতি জানায় ইউএনএফপিএ। বই কেনার দায়িত্ব দেওয়া হয় গ্রন্থাগারের পরিচালক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনকে। তিনি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান হাসান ট্রেডার্সের মালিক মুস্তাফিজকে বই কেনার কাজটি দেন। মাত্র এক মাসের মধ্যে বই সরবরাহ করেন মুস্তাফিজ। পরে লাইব্রেরির পরিচালক নাসিরউদ্দিন সব বই ঠিক আছে বলে লিখিত দেন। এর ভিত্তিতে চার লাখ ১৭ হাজার টাকার চেক পরিশোধ করা হয় হাসান ট্রেডার্সকে। পরে ওই বই নিয়ে কাজ করতে গেলে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল।
আছে নকল বই!
‘পার্লামেন্ট : ফাংশনস’, ‘প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রসিডিউরস’, ‘এ কম্পারেটিভ কনস্টিটিউশনাল পারস্পেকটিভ’ নামে তিনটি বই দেওয়া হয়েছে ৯১ হাজার টাকায়। বইগুলোর লেখক গ্রিফিথ অ্যান্ড রাইলি। কিন্তু সরবরাহ করা হয়েছে জেএজি গ্রিফিথ, মিচাইল রাইলি ও এমএজে হুইলার বুথ-এর লেখা ‘পার্লামেন্ট : ফাংশনস’, ‘প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রসিডিউরস’-এর ফটোকপি বই। যেখানে মূল লেখকের নাম ঠিক রাখতে মলাট পরিবর্তন করে সরবরাহ করা হয়েছে। জানা গেছে, গ্রিফিথ অ্যান্ড রাইলির লেখা আসল বইয়ের ৩৫টি কপি রয়েছে সংসদে। তারপরও ওই ৫৩৮ পৃষ্ঠার তিনটি বই কেনা হয়েছে ৯১ হাজার টাকায়।
একইভাবে ‘দি ওয়ার্কিং অব পার্লামেন্টারি কমিটিস ইন ওয়েস্টমিনস্টার সিস্টেম’, ‘লেসনস ফর বাংলাদেশ’ নামের বইটির মলাট ও নাম পরিবর্তন করে পৃথক বই হিসেবে সরবরাহ করা হয়েছে। আসল বইয়ের নাম পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে ‘পার্লামেন্টারি কন্ট্রোল অ্যান্ড গভর্নমেন্ট অ্যাকাউন্টিবিলিটি : সাউথ এশিয়া : এ কম্পারেটিভ অ্যানালাইসিস অব বাংলাদেশ’। এ বইয়ের মলাটে সম্পাদকের নাম লেখা হয়েছে তাইবুর রহমান, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। আসল বইয়ের সম্পাদনায় আছেন নিজাম আহমেদ ও এটিএম ওবায়দুল্লাহ। প্রেস হিসেবে আছে দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের নাম। মলাট পরিবর্তন ও বিকৃত করা হলেও বইয়ের পৃষ্ঠা ঠিক রাখা হয়েছে। আসল ও নকল দুটি বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৪৪।
দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের সিল!
এদিকে সরবরাহ করা বইয়ের মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলসহ কয়েকটি বইও পাওয়া যায়। এসব বই সৌজন্য সংখ্যা হিসেবে থাকলেও কয়েক হাজার টাকায় কেনা হয়েছে বলে দেখান ঠিকাদার মুস্তাফিজ। সংশ্লিষ্টরা জানান, একাই দরপত্র অংশ নিয়ে মুস্তাফিজ বই সরবরাহের কাজ পাচ্ছেন গত কয়েক বছর ধরে।
অনিয়মে অবাক স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার
গত ১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়াকে বিষয়টি অবগত করেন এ প্রতিবেদক। ডেপুটি স্পিকার সংসদ লাইব্রেরির পরিচালক নাসিরউদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে পরিচালক জানান, বইগুলো ফটোকপি কি না তা তিনি যাচাই করেননি।
এর আগে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সংসদের টাকায় কেনা দেড় লাখ টাকার বইয়ের মধ্যে সবগুলো বুঝে না পেলেও লাইব্রেরি পরিচালক ডেপুটি স্পিকারকে বলেন, ‘২০-২৫টার মতো বই দিতে পারেনি ঠিকাদার। তবে পেমেন্ট দিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
বই বুঝে না পেলেও কেন টাকা দেওয়া হয়েছে এ ব্যাপারে নাসিরউদ্দিনের কাছে জানতে চান ফজলে রাব্বী। নাসিরউদ্দিন বলেন, ‘ঠিকাদার একটা চেক দিয়ে গেছে এবং প্রস্তাব দিয়েছে ওই বই না থাকলে বিকল্প কোনো বই দেওয়া হবে। তখন ডেপুটি স্পিকার বলেন, ‘না, এমন হবে না। যদি বই দিতে না পারে তবে টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দিতে হবে। আপনি কীভাবে টাকা পরিশোধ করলেন?’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গ্রন্থাগার গবেষণা বিভাগের উপপরিচালক জেব-উন-নেসা সব বই বুঝে পেয়েছেন বলে সনদপত্র দেন সংসদ সচিবালয়কে। এরপরই চেকের মাধ্যমে টাকা ছাড় দেওয়া হয়।
এদিকে বই নিয়ে এ ধরনের অনিয়ম জানতে পেরে গত ২ ফেব্রুয়ারি লাইব্রেরি পরিদর্শনে যান ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া। তিনি লাইব্রেরি পরিদর্শনে গিয়ে সেখানকার কর্মকর্তাদের তিরস্কার করেন। একই সঙ্গে বইগুলো যাচাই ও বাছাই করার নির্দেশ দেন। বই কেনা নিয়ে কোনো ধরনের অনিয়ম মেনে নেওয়া হবে না বলে তিনি কঠোরভাবে জানিয়ে দেন।
বই নিয়ে অনিয়মের ঘটনায় অবাক হয়েছেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি জাতীয় সংসদের অতিরিক্ত সচিব গোলাম কিবরিয়াকে আহ্বায়ক করে এক সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। এ ছাড়া সংসদ লাইব্রেরির কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে তিন সদস্যবিশিষ্ট আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ডেপুটি স্পিকার বিষয়টি বই কিনতে গঠিত যাচাই-বাছাই কমিটির কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত দেন।
‘ভুল হয়েছে’
বই নিয়ে অনিয়ম প্রসঙ্গে ঠিকাদার মুস্তাফিজ বলেন, ‘এসব বই আসলে যাচাই করে দেখিনি। আমি ভারতে যার কাছ থেকে বই সংগ্রহ করেছি সে ঠকিয়েছে। সংসদ সচিবালয়কে বলেছি যেসব বইয়ে ত্রুটি ধরা পড়েছে তা পরিবর্তন করে দেওয়া হবে।’ তিনটি বইয়ের দাম ৯১ হাজার টাকা কীভাবে জানতে চাইলে মুস্তাফিজ বলেন, ‘এটা আসলে আমি ভেবে দেখিনি। তবে ওয়াদা করেছি এসব বই পরিবর্তন করে দেওয়া হবে। দামও ঠিক ধরা হবে। যা কিছু হয়েছে ভুল হয়েছে।’
এ বিষয়ে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, ‘সংসদে এ ধরনের অনিয়ম সত্যিই দুঃখজনক! এভাবে কোনো বই নেওয়া হবে না।’
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের লাইব্রেরিটি এশিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধ একটি লাইব্রেরি। এখানে বই-ম্যাগাজিন, জার্নাল, সরকারি গেজেটসহ ৮৫ হাজারের বেশি গ্রন্থ ও দুর্লভ দলিল-দস্তাবেজ আছে।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
আহা চিকুনগুনিয়া !
ঈদের দিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে মেঝেতে পা দিয়ে আমিবিস্তারিত পড়ুন
‘দৃষ্টিশক্তি থাকা, কিন্তু জীবনে লক্ষ্য না থাকা অন্ধত্বের চেয়েও খারাপ’
চক্ষু, কর্ন, জিহবা, নাসিকা, ত্বক – মানুষের এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়েরবিস্তারিত পড়ুন
ধর্ষিতা মেয়েটির গল্প
পারিনি সেদিন নিজেকে শোষকদের হাত থেকে রক্ষা করতে, পারিনি সেদিনবিস্তারিত পড়ুন