“সম্পর্ক তো অনেকের সঙ্গেই হয়, যোগাযোগটা থাকে না পরে”
২০০১ সালে ৮ নভেম্বর টেস্ট ক্যাপ মাথায় তুলেছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। মঙ্গলবার পূর্ণ হচ্ছে তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ১৫ বছর। একান্ত আলাপচারিতায় পেছন ফিরে তাকালেন বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক। ১৫ বছর পূর্তির প্রাক্কালে শোনালেন ১৫ টুকরো গল্প।
১. প্রথম আন্তর্জাতিক ক্যাপ
টেস্ট ক্যাপই তো প্রথম ক্যাপ। তখন বুঝতাম কম। খেলাটাকে গুরুত্বই দেইনি। এখনকার লেভেলে ভাবার তো প্রশ্নই আসে না। বয়স মোটে ১৮। খেলার চেয়ে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আড্ডা, মজা করতেই বেশি ভালো লাগত।
আমাকে ক্যাপ পরিয়ে দিয়েছিলেন তখনকার প্রধান নির্বাচক মাইনু ভাই। আলাদা কোনো অনুভূতি হয়নি। টেস্ট ক্যাপ ব্যাপারটির মাহাত্মই বুঝতাম না তখন। আর দশটা ক্যাপের মতোই ভেবেছি। সত্যি বলতে, ২০০৩ বিশ্বকাপে যাওয়ার পর আমি সত্যিকার অর্থে বুঝতে শিখি, দেশের হয়ে খেলা কত বড় ব্যাপার।
পরে টেস্ট ক্যাপের গুরুত্বও বুঝতে পেরেছি। ৩৬ টেস্ট ওই ক্যাপ পরেই খেলেছি। এক সময় দেখলাম স্টিভ ওয়াহর ক্যাপ ছেঁড়া, রঙ জ্বলে গেছে। ওটা পরেই খেলে। আমারও স্বপ্ন ছিল ক্যাপ ওরকম ছেঁড়া, তালি দেওয়া হবে, রঙ উঠে যাবে। এটা পড়ে খেলব। ইনজুরি না থাকলে আজ হয়ত ৭০-৭৫টা টেস্ট খেলতাম। ক্যাপ ওরকমই হতো। সেই স্বপ্ন অনেক আগেই শেষ। আমার টেস্ট ক্যাপ উজ্জ্বল সবুজই থেকে গেছে। ক্যারিয়ার পরিসংখ্যান হয়ে গেছে বিবর্ণ!
২. প্রথম বল
প্রথম বল খেলেছিল ডিওন ইব্রাহিম। যথারীতি বিশেষ কিছু মনে হয়নি। দুর্জয় ভাই (অধিনায়ক নাঈমুর রহমান) বল দিলেন, আমি ছুটলাম। বললাম না, টেস্ট খেলার গুরুত্বই বুঝতাম না! বোলিং বা খেলা আমার কাছে ছিল বোঝা। ঝামেলা। কেবলই মনে হতো, কবে খেলা শেষ হবে, কবে বাড়ি যাব!
আমি জানতাম, বল দিয়েছে, বোলিং করতে হবে। ব্যস। শুধু চাইতাম জোরে বল করতে। বল যদি ঠিকমত পাইলট ভাইয়ের (উইকেটকিপার খালেদ মাসুদ) হাতে না যেত, যদি তার গ্লাভসে ধপাস করে না লাগত, শব্দ না হতো, তাহলে আমার ভাল লাগত না। পাইলট ভাইকে বলতাম, ‘ভাই, আজকে মনে হয় বল আস্তে হয়েছে!’ তিনি বলতেন, ‘কই, না তো!’ আমি তবু শান্তি পেতাম না। শুধু এটা নিয়েই ভাবতাম।
৩. প্রথম উইকেট
ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় দিনে পেলাম প্রথম উইকেট। গ্রান্ট ফ্লাওয়ার। অফ স্টাম্প ঘেষা বলটি গুড লেংথ থেকে একটু লাফিয়েছিল। স্লিপে রোকন ভাই (আল শাহরিয়ার) ক্যাচ নিয়েছিলেন। একটা ব্যাটসম্যানকে আউট করেছি, উদযাপন করলাম। ওইটুকুই। প্রথম উইকেট, স্মরণীয় ব্যপার, এরকম কিছু তখন মনে হয়নি।
৪. প্রথম বিদেশ সফর
জাতীয় দলের আগে তো ‘এ’ দলের হয়ে ভারত গেলাম। সেটি আমার জীবনেই প্রথমবার বিদেশ সফর। জাতীয় দলের হয়ে প্রথম গেলাম নিউ জিল্যান্ড। বিশ্বাস করেন, আমি খুব আপসেট ছিলাম। কেন যেতে হবে আমাকে? বাড়ির সবাইকে, বন্ধু-বান্ধব, নড়াইল রেখে আমার যেতে ইচ্ছে করেনি।
২৯ দিনের সফর ছিল, আমি শুরু থেকেই দিন গুণেছি। বোলিং কেমন হচ্ছে, খেলছি কিনা, গায়ে ব্যথা, এসব কিছুই ভাবতাম না। সবাই বলত এত সুন্দর দেশ, আমার তাকিয়ে দেখতেই ইচ্ছে করত না। ২০০৩ বিশ্বকাপে ইনজুরি নিয়ে ফিরলাম। আমি তবু খুশি, নড়াইল তো যাচ্ছি! এ রকমই ছিল তখন ভাবনা।
৫. প্রথম রুম মেট
জাভেদ ওমর বেলিম। হোটেল সোনারগাঁয়ে। দরজা ঠেলে ঢুকলাম, গোল্লা ভাই বললেন, “মাশরাফি আসছিস, আয়।” এরপর অনেক কথা বললেন, “এভাবে থাকবি, এভাবে চলবি। ভালো করে খেলবি, শরীরের যত্ন নিবি”, এসব কথা। আমি ভাবতাম, “কি বলে এসব? আমার চিন্তা বাড়ি যাব কখন!” পরে জেনেছি, গোল্লা ভাই নিজেই আমাকে রুম মেট হিসেবে নিতে চেয়েছিলেন।
৬. ক্যারিয়ারের সেরা ডেলিভারি? প্রিয় ডেলিভারি?
রাহুল দ্রাবিড়কে ইনসুইঙ্গারে বোল্ড করা ডেলিভারি। ইনজুরির কারণে ১২ মাস বাইরে থাকার পর খেলতে নেমেছিলাম (২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে)। ২০০৭ বিশ্বকাপে বিরেন্দ্র শেবাগকে বোল্ড করা বলটিকেও পাশাপাশিই রাখব। যদিও ইনসাইড এজ ছিল, কিন্তু বলটি বাইরে থেকে অনেক ভেতরে ঢুকেছিল।
তবে প্রিয় ডেলিভারি বললে দ্রাবিড়েরটাই বলব। তার মানের একজন ব্যাটসম্যানকে শূন্য রানে বোল্ড করা, পেস ছিল, ইনসু্ইং বুঝতে পারেনি। সব মিলিয়েই ওটা সবচেয়ে প্রিয়।
৭. সেরা উইকেট? প্রিয় উইকেট?
শচিন টেন্ডুলকার। ২০০৪ সালে চট্টগ্রামে। দিনের প্রথম বলে আউট করেছিলাম। ৩৬ অপরাজিত থেকে দিন শুরু করেছিল, প্রথম বলেই এলবিডব্লিউ। ব্যাটসম্যানের নাম শচিন বলেই আমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান উইকেট।
প্রিয় উইকেট কোনো একটি বলব না। এমনিতে প্রিয় শিকার ছিল শেবাগ। সামনে এলেই আউট হতো। এমনকি ২০০৭ সালে যখন আফ্রো-এশিয়া কাপ খেলতে গেলাম ভারতে, নেটে শোয়েব-আসিফদের সমানে মারছিল শেবাগ। কিন্তু আমি বলে-কয়ে আউট করেছি।
৮. সেরা ইনিংস? প্রিয় শট?
ভারতের বিপক্ষে ৭৯। আমি আর রাজিব (শাহাদাত হোসেন) মিলে ফলো অন বাঁচালাম (২০০৭ সালে চট্টগ্রামে)। তখন বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিংও খুব ভালো হচ্ছিল। নবম উইকেটে ৮০ রানের মতো জুটি গড়েছিলাম আমরা (৭৭ রান)।
একটি শট বেছে নেওয়া কঠিন। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, মাথায়া এনটিনির বলে একটি শট। ২০০৭ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর ম্যাচে। ১৬ বলে ২৫ করেছিলাম। এনটিনিকে ছক্কা মেরেছিলাম ওর মাথার ওপর দিয়ে।
৯. সেরা জয়
প্রথম টেস্টের জয় দারুণ স্মরণীয়, ২০০৫ সালে। ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতকে হারানো। ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়।
একটিকে বেছে নিতে বললে ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতকে হারানোই বলব। ওদের দলটা ছিল অসাধারণ, ওদের দল নিয়ে হাইপও ছিল অনেক। একই হোটেলে ছিলাম আমরা। কেউ আমাদের দিকে তাকিয়েও দেখছিল না। ম্যাচের পর সব পাল্টে গেল। ওদের কেউ দেখে না, আমাদের নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল!
আর আমার না খেলার কথা বললে, এবার মিরপুর টেস্টে ইংল্যান্ডকে হারানো। এটিই আমাদের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় জয়।
১০. যাদের বিপক্ষে বোলিং করেছেন, তাদের মধ্যে সেরা ব্যাটসম্যান
কুমার সাঙ্গাকারা। তার টেকনিক, টেম্পারামেন্ট বা ইমপ্যাক্ট তো ছিলই। তবে আমি সেরা বলছি আরেকটা কারণে। আমরা হয়ত অ্যানালাইসিস করে একটা পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামলাম, সে ঠিকই সেটা বুঝে ফেলে জবাব প্রস্তুত করে রাখত। বাধ্য হয়ে তখন পরিকল্পনা বদলাতে হতো। প্রতিপক্ষের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে থাকত।
১১. ক্রিকেটে সবচেয়ে কাছের বন্ধু
রানা। মানজারুল ইসলাম। ওর সঙ্গে সম্পর্কটা এমন ছিল, বলে বোঝানোর নয়। খুলনায় কী সব সময় যে কেটেছে ওর সঙ্গে! ওর বাসা নিজের বাসার মতোই ছিল। ওর মাকে বলতাম, ‘কাকি, রান্না করে রাখেন, আসতেছি।”
সফরে গেলে একসঙ্গে থাকতাম। ঘুমাতাম। আমার জন্য ওকে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে হতো। আমি আলো ছাড়া ঘুমাতে পারতাম না। রানা আলোতে ঘুমাতে পারত না। দেখা গেল রাত দুটা-তিনটায় আমি ঘুমানোর পর লাইট বন্ধ করে, দরজার নীচে তোয়ালে গুজে একদম ঘুটঘুটে অন্থকার করে ও ঘুমাতে আসত। রানা ছিল আমার কাছে সতীর্থ, বন্ধু বা ভাইয়ের চেয়েও অনেক বেশি কিছু।
রানা চলে গেল। পরে রাজ্জাক-রাসেল খুব ভালো বন্ধু হয়েছে। এখন বয়সে অনেকটা ছোট হলেও তামিম খুব কাছের। ওর সঙ্গে সময় কাটে বেশি।
১২. ক্যারিয়ারে পাওয়া সেরা প্রশংসা
অনেকেই তো অনেক সময় অনেক কিছু বলেছেন। এই মুহুর্তে মনে পড়ছে শচিন টেন্ডুলকারের কথা। ২০০৭ সালে টেস্ট শেষে এই মিরপুর মাঠেই খেলা শেষে নিজে থেকেই আমাকে ডেকে নিয়েছিলেন। বললেন যে, “তোমার এত ইনজুরির পরও যে এভাবে বোলিং করতে পারছো, এটা বিস্ময়কর। খুব ভালো হচ্ছে। এটা ধরে রাখো।” আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তুমি তো আমার বল খেললে, কোন জায়গাটায় উন্নতি কতে হবে?” শচীন বলেছিল, “কোনো ঘাটতি নেই। পেস, সুইং, লইন-লেংথ সবই খুব ভালো আছে। শুধু এটা ধরে রাখো।”
২০০৭, ২০০৮ সালে আমি ক্যারিয়ারের সেরা বোলিং করছিলাম। পেস দারুণ ছিল। নেটে বলে বলে আউট সুইং, ইনসুইং দিতে পারতাম। এরপর যে ইনজুরিতে পড়লাম, পরে আর কখনোই ওই সময়ের বোলিংটা আর ফিরে পাইনি।
১৩. ক্রিকেটে দেশের বাইরের ভালো বন্ধু
যুবরাজ সিং। হরভজন সিংও। ২০০৭ সালে আফ্রো-এশিয়া কাপ খেলতে গিয়ে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়েছে। কথা, সম্পর্ক তো অনেকের সঙ্গেই হয়। যোগাযোগটা থাকে না পরে। ওদের সঙ্গে, বিশেষ করে যুবরাজের সঙ্গে থেকে গেছে। ওই আফ্রো-এশিয়া কাপে যুবরাজ, হরভজন, জহির খান আমরা সিনেমা দেখতে গেছি, মজা-টজা করেছি অনেক।
১৪. সবচেয়ে বড় আক্ষেপ বা অপ্রাপ্তি
২০১১ বিশ্বকাপে দেশের মাটিতে খেলতে না পারার কথা হয়ত বলবে অনেকে। আমি আসলে ১৫ বছর পর এসে ভাবি অন্যরকম। মাঝে মঝে মনে হয়, টেস্টে আমার ৩০০ উইকেট, ওয়ানডেতে ৪০০ উইকেট আমার থাকতে পারত। খুব সম্ভব ছিল।
এখনই ২১৬ উইকেট। অন্তত ১০০ ওয়ানডে মিস করেছি। ক্যারিয়ার শেষে সাড়ে তিনশ-চারশ উইকেট অসম্ভব ছিল না। টেস্টে এখন ৭৮ উইকেট। টেস্ট ক্যারিয়ারে অন্তত ১০ বার ইনজুরি থেকে আসতে হয়েছে, আবার বাইরে যেতে হয়েছে। দীর্ঘ সময় বাইরে থাকার পর নিজেকে ফিরে পেতেই সময় লাগে অনেক। টানা খেলতে পারলে উইকেট অন্তত ১২০টির কাছে থাকত। সব মিলিয়ে এখন হয়ত খেলতে পারতাম ৭০-৭৫ টেস্ট। আড়াইশ উইকেট অনায়াসে থাকত।
এক সময় খাতায় লিখতাম, কতগুলো টেস্ট উইকেট পেলাম, কতগুলি পেতে চাই। ভাবতাম, অন্তত ৩০০ উইকেট নেবই। তার পর যা পাই বোনাস। ইনজুরি সব শেষ করে দিয়েছে।
তবে আরও বেশি আক্ষেপ লাগবে, এখন আমাদের প্রতিশ্রুতিশীল বোলার যারা এসেছে, তারা যদি ৩০০-৪০০ উইকেট না পায়। এজন্য সবাইকে সব সময়ই বলি, “শুরু ভালো হয়েছে, খুব ভালো কথা। কিন্তু লম্বা সময় খেলতে হবে, সার্ভিস দিতে হবে।” আমার অনেক অপ্রাপ্তি আছে, তার পরও ১৫ বছর খেলেছি। আশা করি, এটাকে অন্তত ওরা উদাহরণ হিসেবে নিয়ে দীর্ঘ সময় ফিট থেকে খেলতে পারবে। মুস্তাফিজ বা অন্যদের যে স্কিল আছে, এরা অনেক বেশি উইকেট পাবে।
১৫. ক্যারিয়ারের প্রাপ্তি
লোকের ভালোবাসা। এই যে মানুষ চেনে আমাকে, এত ভালোবাসে, একজন মানুষ এর চেয়ে বেশি কী চাইতে পারে! এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর হতে পারে না। কেউ ৫০০ উইকেট নিতে পারে বা ১০ হাজার রান, তার ভক্ত সমথক অনেক থাকবেই। আমি সে রকম কিছু করিনি। তবু লোকে ভালোবাসে। নিজেকে দিয়ে বুঝেছি যে ভালোবাসা আসলে রান-উইকেট, এসব দিয়ে বিচার করা যায় না। প্রতিভা লাগে, কঠোর পরিশ্রম করতে হয়, সব ঠিক। পাশাপাশি সবার দোয়া, ভালোবাসা না থাকলে এত দিন খেলতে পারতাম না।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
নারী ফুটবল দলের বেতন বকেয়া, দ্রুত সমাধানের আশ্বাস
টানা দ্বিতীয়বার সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতে ঢাকায় এসে পৌঁছেছেবিস্তারিত পড়ুন
প্রোটিয়াদের রানের পাহাড়, টাইগাররা নামতেই বদলে গেল পিচের ধরন!
চট্টগ্রাম টেস্টে প্রথম ৫ সেশনেরও বেশি সময় ব্যাটিং করেছে দক্ষিণবিস্তারিত পড়ুন
নেপালকে হারিয়ে সাফ চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ
নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে স্বাগতিকদের ২-১ গোলে হারিয়ে সাফবিস্তারিত পড়ুন