সাবধান, ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু!
আকস্মিক আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে চলতি বছর রাজধানীসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু জ্বর। এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে একের পর এক মানুষ। আবহাওয়ার এই বিরূপ আচরণের কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বেড়ে যাবে বলে এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) সূত্রে জানা যায়, বৃষ্টির কারণে এবার বেড়েই চলেছে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। সাধারণত জুন-জুলাই-আগস্ট মাস ডেঙ্গুর মৌসুম। অন্যান্য বছর এই সময়ে ডেঙ্গুর কিছুটা প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। কিন্তু এ বছর বৈরী আবহাওয়ার কারণে অক্টোবর-নভেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব থাকবে বলে জানানো হয় আইইডিসিআর থেকে। সাম্প্রতিক সময়ে করা একটি গবেষণার তথ্যমতে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের মধ্যে ডেঙ্গু হেমোরেজিকের সংখ্যা বাড়ছে। এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, একবার আক্রান্ত হলে দ্বিতীয় দফায় তাদের ডেঙ্গু হেমোরেজিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা অতীব জরুরি।
বাড়ছে ডেঙ্গু : দেশে বছরের প্রথম ৯ মাসে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিয়েছেন দুই হাজারেরও বেশি মানুষ। স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে পাঁচ শতাধিক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। সূত্র আরও জানায়, এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ অন্য যে কোনো বছরের চেয়ে বেশি। এই জ্বরের নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষেধক বা ওষুধ নেই। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। তার আগে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের ছেলে আমান মমতাজ মওদুদ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। স্বাস্থ্য বিভাগ জানায়, ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত দুই হাজার মানুষের মধ্যে চারজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। অতিবৃষ্টিতে এডিস মশার বংশবিস্তারের গতি বেড়ে যাওয়ায় এ রোগের প্রকোপ বাড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
ডাইরেকটরেট জেনারেল অব হেলথ সার্ভিসের ন্যাশনাল ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্র জানায়, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে ডেঙ্গু রোগী পাওয়া না গেলেও মার্চ-এপ্রিল থেকে ডেঙ্গুর বিস্তার শুরু হয়। চিকিৎসকদের মতে, অতিবৃষ্টি, অত্যধিক তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা এডিস মশার বংশবৃদ্ধি প্রভাবিত করছে। ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলজির ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের পরিচালক প্রফেসর মাহমুদুর রহমান প্রতিবেদককে বলেন, ডেঙ্গু সম্পর্কে জনমনে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মশার বংশবৃদ্ধি রোধ করার জন্য কাজ করতে হবে।
ঘাতক ঢাকা ফিভার : ডেঙ্গু জ্বর এক সময় খুবই আতঙ্কের ছিল। ‘ঘাতক ঢাকা ফিভার’ হিসেবে এর পরিচিতি ছিল তখন। ১৯৬৬ সালে এই ডেঙ্গু জ্বর প্রথম ঢাকায় দেখা দেয়। ওই সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণার তেমন কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এর প্রকৃত কারণ নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তবে বিশেষজ্ঞরা ওই সময় এর নাম দিয়েছিলেন ‘ঢাকা ফিভার’। এই জ্বরে ওই সময় বেশ কিছু লোক মারা যান। ২০০০ সালে ডেঙ্গু জ্বরের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব ঘটে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ শতাধিক লোক ডেঙ্গু জ্বরে মারা যান। আক্রান্ত হয়েছিলেন কয়েক হাজার। তখন এই রোগের উৎপত্তি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত হলেও দু’একজন বিশেষজ্ঞ ছাড়া এ রোগের চিকিৎসা ছিল সবার অজানা।
এ সময় দেশব্যাপী আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। জরুরি ভিত্তিতে থাইল্যান্ড থেকে ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসকদের আনা হয়। প্রয়াত মেয়র মো. হানিফের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ওই সময় ডেঙ্গু জ্বরের বিষয়ে চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা এবং প্রতিরোধ নিয়ে সভা-সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এরপর স্বল্প সময়ের মধ্যেই এই রোগের চিকিৎসা হয়ে ওঠে স্বাভাবিক। এই জ্বর নিয়ে তখন থেকে আর দেশে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের ওপর একটি গবেষণা চালায়। এতে প্রমাণ পাওয়া যায়, এবার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের মধ্যে হেমোরেজিকের সংখ্যাই বেশি। কারণ, তারা আগেও এক দফা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন। হেমোরেজিক হলে রক্তপাত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। এর প্রাদুর্ভাব আরও বাড়বে বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা সতর্ক করেছেন।
বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু চার ধরনের ভাইরাস দ্বারা হয়ে থাকে। এই ভাইরাসের বাহক এডিস মশা। একবার ডেঙ্গু হওয়ার পর দ্বিতীয় দফা ওই ব্যক্তি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে এক্ষেত্রে হেমোরেজিকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তবে এতে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এক্ষেত্রে শুধু সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। ডেঙ্গু জ্বরে চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা সব চিকিৎসকেরই জানা।
৯ মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ১৪০০ জন : গত এক মাসে রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশে নতুন করে আরও ৮শ’ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গত ৯ মাসে এ নিয়ে প্রায় ১৪০০ লোক এই জ্বরে আক্রান্ত হলেন। গত ৯ বছরের মধ্যে এটি ডেঙ্গু আক্রান্তের সর্বোচ্চ সংখ্যা। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। আইইডিসিআর জানিয়েছে, ২০১৩ সালে ১৭৪৯ জন এবং ২০১৪ সালে ৩৭৫ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল। তবে ওই দুবছর এই জ্বরে কারো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি।
আইইডিসিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, গত ৯ বছরের মধ্যে ২০১৫ সালে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। চলতি বছর ডেঙ্গুতে চারজন মারা যাওয়ায় আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
ডেঙ্গু নিয়ে সাবধানতা : এডিস মশার মাধ্যমে এই জীবাণু মানুষের শরীরে আসে এবং এডিস মশাই আক্রান্ত রোগীর রক্ত খাওয়ার মাধ্যমে এই রোগ সুস্থ মানুষের দেহে ছড়িয়ে দেয়। এ বিষয়ে প্রতিবেদককে বিস্তারিত জানিয়েছেন ডা. স্নিগ্ধ জৌতি চৌধুরী মিঠুন।
তিনি বলেন, শুনতে খটকা লাগলেও ডেঙ্গু জ্বর মূলত অভিজাত শ্রেণির মানুষদের রোগ। বস্তিতে, ডোবার আশপাশে বসবাসকারী মানুষের এই রোগ খুব কম হয়। বরং বাড়ির আশপাশে, বারান্দায় টবে গাছ চাষ করেন যাঁরা, তাদেরই এই রোগ বেশি হতে দেখা যায়। কারণ, গাছের টবে বা অন্যান্য স্থানে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা বংশবিস্তার করে।
লক্ষণ : ডা. মিঠুন বলেন, ডেঙ্গু জ্বরকে সাধারণত তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়, ফেব্রাইল, অ্যাফেব্রাইল ও ক্রিটিকাল। এই চিকিৎসক জানান, ফেব্রাইল পর্যায়ে রোগীর প্রচণ্ড জ্বর থাকে। সঙ্গে শরীর, হাত, পা, মাথা ও চোখের চারপাশে ব্যথা হতে পারে। রোগী প্রচ- দুর্বল অনুভব করবে। সাধারণত তিন দিন পর্যন্ত এই পর্যায় থাকে। এরপর জ্বর সেরে যায় এবং শুরু হয় অ্যাফেব্রাইল পর্যায়। এই পর্যায় বেশি বিপজ্জনক। জ্বর সেরে যাওয়ার পর রোগীর রক্তের শ্বেতকণিকা, অনুচক্রিকার পরিমাণ কমতে শুরু করে। পাশাপাশি দাঁত মাজার সময় রক্তক্ষরণ, পায়খানার সঙ্গে রক্ত যাওয়া, শরীরে ছোট লাল দানা দেখা দেওয়া ইত্যাদি হতে পারে। অরুচি, প্রচ- দুর্বলতা, মাথা ঘোরা, পেটে ব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদিও থাকতে পারে।
প্রতিরোধ : পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাই এর মূল প্রতিরোধ ব্যবস্থা। বাসার আশপাশে কোথাও যাতে পানি জমে থাকতে না পারে, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। নিয়মিত মশার ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। মশার বংশবৃদ্ধি রোধ, মশা নিধন ও প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। ঘরের আঙিনা, ফুলের টব, বারান্দা, এসির নিচে জমানো পানি নিয়মিত পরিষ্কার করে রাখতে হবে। দিনের বেলা এডিস মশা কামড়ায় বলে দিনে মশানাশক স্প্রে বা মশারি ব্যবহার করতে হবে। শিশুদের ফুলপ্যান্ট পরানো উচিত। আক্রান্ত ব্যক্তিকে আলাদা বিছানায় মশারির ভেতর রাখতে হবে।
চিকিৎসা : ডা. স্নিগ্ধ জৌতি বলেন, ডেঙ্গু জ্বর সাধারণত পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যেই সেরে যায়। জ্বর হলে পূর্ণ বিশ্রামে থাকুন। পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে পানি, স্যালাইন, ডাবের পানি, ফলের শরবত পান করা উচিত। স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানিতে ভেজানো কাপড় দিয়ে বার বার শরীর মুছে দিতে পারেন। জ্বর কমাতে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খাওয়া যাবে। তবে কোনো অবস্থায়ই ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া যাবে না। ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে।-ভোরের পাতা
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশবাসীকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপকবিস্তারিত পড়ুন
দুই দফা কমার পর ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম
টানা দুই দফা কমার পর দেশের বাজারে ফের স্বর্ণের দামবিস্তারিত পড়ুন
চট্টগ্রামে দুর্ঘটনার কবলে হাসনাত-সারজিসের বহরের গাড়ি
আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের কবর জিয়ারত শেষে ফেরার পথে সড়কবিস্তারিত পড়ুন