সারাজীবন জানাজানির ডরেই কাটাইলাম
সন্ধ্যা রাণী। বয়স আনুমানিক ৬১। থাকেন বাইপাইলে। প্রায় ২০ বছর আগে সতিনের ছেলে রাসেল তাকে নিয়ে আসেন। রাসেল ছোট থেকে তাকে মা বলেই ডাকে। রাসেল জানে তার মায়ের কথা, কিন্তু মা জানেন না তিনি যার কাছ থেকে সব লুকিয়ে রেখেছেন বলে মনে করেন সেই রাসেল ঠিকই খুঁজে বের করেছে মায়ের ভয়ের জায়গা। কেন মা নিজেকে লুকিয়ে রাখেন। রাসেলের সূত্র ধরেই আমরা খুঁজে পাই সন্ধ্যাকে।
১৯৭১ সালের মে মাসের দিকে (আনুমানিক) তিনি ধর্ষণের শিকার হন নিজ এলাকার রাজাকারদের মাধ্যমে। সিরাজগঞ্জের ১৬ বছরের মেয়ে সন্ধ্যা ধর্ষণের শিকার হয়ে বাবা-মার ঘরে জায়গা পেলেও শরীরে সেসময় শক্তি না থাকায় হেঁটে তাদের সঙ্গে পাড়ি দিতে পারেননি ভারতে। রয়ে গেছেন এপারে মাসির বাড়িতেই। তিনমাস গেলে মাসি প্রথম বুঝতে পারেন তিনি সন্তানসম্ভবা। যুদ্ধে ততদিনে পুড়ে গেছে পথঘাট, বাড়ি। মেয়ের এই ‘কলঙ্ক’ কীভাবে ঢাকবে চিন্তা করতে করতে ৬ মাস পার। আর তারপর কবিরাজের খোঁজ মেলে, শেকড়ের সন্তান পান। সেই খেয়ে গর্ভপাত ঘটানো হয় সন্ধ্যার। তারপর লুকিয়ে ভারতে নিয়ে গিয়ে আরেক শরণার্থীর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয় তাকে। বরের হাত ধরে যুদ্ধের পর সন্ধ্যা দেশে ফেরেন ঠিকই কিন্তু তিন বছরেই ভেঙে যায় সংসার। কারণ সন্ধ্যা গর্ভধারণে অক্ষম।
অস্ট্রেলীয় চিকিৎসক ডক্টর জিওফ্রে ডেভিসের লেখা ‘দ্য চেঞ্জিং ফেস অব জেনোসাইড’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, দেশ স্বাধীন হবার একদম পরপরই বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অনুরোধে তাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়েছিল ১৯৭২ সালে ধর্ষিত বীরাঙ্গনাদের চিকিৎসা এবং গর্ভপাতের জন্য। ধর্ষণের শিকার গর্ভবতীদের ১০ ভাগ দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই সন্তান জন্ম দিয়েছেন। এভাবে ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ অবাঞ্ছিত গর্ভবতীদের সংখ্যা ছিল সাড়ে তিন লাখ। তিনি বলছেন, যেসব জেলা আমি ঘুরেছি, বেশির ভাগ জেলাতেই দেখা গেছে অবাঞ্ছিত গর্ভবতীদের সংখ্যাটা ছিল গ্রাম পিছু ১০ জন করে! ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ থানা পিছু ছিল দেড় হাজার করে এবং জানুয়ারির শেষ নাগাদই গ্রামের দাই, হাতুরে ও হোমিওপ্যাথরা মিলে এদের বেশির ভাগেরই ব্যবস্থা করে ফেলে। রয়ে যায় অল্প কজনা। থানা পিছু দেড় হাজার করে ৪৮০টি থানায় ৩ লাখ ৬০ হাজার গর্ভবতীর সন্ধান পাওয়া যায়।
বাইপাইলে রাসেলের বাসায় সন্ধ্যার সঙ্গে কথা হয়। একদিন, দুইদিন, তিনদিন কথা বলার পর এতদিন না বলা কথা উসকে দিতে মাসির পরিচয় ধরে আলাপ শুরু হয়। একাধিকবার গিয়ে, ফোনে কথা বলে একসময় তিনি রাজি হন সেসময়ের অভিজ্ঞতাগুলো জানাতে।
-আপনার গর্ভপাতের সময়টা মনে আছে?
কেন থাকবে না? একটা ঘরে আমাকে আটকে রাখা হয়েছিল। এমনিতেই খাওয়া-দাওয়ার অভাব ছিল সেসময়, তারপরও আমাকে খাওয়া দেওয়া হতো না। কারণ না খাইয়ে যদি মেরে ফেলা যায়। মাসি-মেসো তখন গর্ভপাতের কোনও রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। আর আমার বাইরে বের হওয়া বারণ। যদিও এলাকায় সেই অর্থে তখন আর কেউ নেই।
-তারপর?
তারপর আমাকে লবনপানি খাওয়ানো হলো, আমাকে কিসব শেকড় খাওয়ানো হলো এবং পাশের গ্রামের এক পরিচিত মাসি এসে টেনে বের করে বলল, ব্যাটা হইতো। আমার কোন অনুভূতি ছিল না। কারণ আমি শুরু থেকে জানি আমাকে জোর করে এমনকিছু করেছে যার কারণে সবাই আমাকে খারাপ হিসেবে দেখছে। তখনও যুদ্ধ বুঝি নাই। কিন্তু শত্রুপক্ষ কি বুঝেছি। তারা আমাদের ইজ্জত নিয়ে, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে জিততে চায় এটুকু বুঝেছি।
-কোথায় গেলেন তারপর?
নভেম্বরে আমাকে ‘খালাস’ করার পর আমরা সবাই মালদা দিয়ে ভারতে বহরমপুরে গেলাম। সেখানে সব লুকিয়ে আমার আত্মীয়ের বাসায় এপারেরই একজনের সঙ্গে আমার বিয়ে দেওয়া হলো। দুইমাস পর আমরা ফিরলাম এদেশে। কিন্তু পরিবারের অন্যরা ফিরল না। আমি বরের কর্মসূত্রে খুলনায় বসবাস শুরু করলাম। ততদিনে দেশে আর শত্রুরা নাই, স্বাধীন হয়েছে শুনছি, কিন্তু বুঝিনি বিষয়গুলো। তবে আমার পরিবারের আর কেউ আমাদের সঙ্গে আর তেমন সম্পর্ক রাখেননি।
এদিকে আসার পর আমার মতো অনেক মেয়েকে আমি দেখেছি। যারা ধর্ষণের শিকার হয়ে গর্ভবতী হয়েছিল, তারা কেউ কেউকে মুখ ফুটে কিছু বলত না, স্থানীয় ক্লিনিক হয়েছিল, ঘরে ঘরে জানতে চাওয়া হতো কারওর গর্ভপাত লাগবে কিনা। কিছু মুখ ফুটে বলত না কিন্তু আমি বুঝতাম, কারণ ওদের মতো কষ্ট আমি করেছি। এভাবে তিন বছর কাটার পর আমার বিয়েটা টিকলো না। তিন বছরে গর্ভবতী না হওয়ায় আমার বর বুঝতে পারে আমার সমস্যা আছে। তারপর সতিনের ঘর।
-সাভারে এলেন কীভাবে?
আমার সতিনের ছেলে হয় তারও দুই বছর পর ৭৬ সাল হবে তখন। আমি বাড়ির পেছনের ছাপড়ায় থাকতাম। কাজ-কর্ম করতাম যতটুকু পারতাম। এই যেভাবে চলে আর কি। কিন্তু সতিনের ছেলেটা আমার খুব ভক্ত ছিল। আমার কাছে গল্প শুনতো। আমার কাছে কাছে থাকতো আর লুকিয়ে মা ডাকতো। সে ঢাকায় চাকরি নিয়ে আসে হাসিনার আমলে। তখন আমাকে নিয়ে আসে। তখন তার ঘর দেখে রাখি, রান্না করিয়ে রাখি। সে আমাকে মা পরিচয় দেয়। আমারতো আর মা হওয়া হয়নি।
-আপনারা তো নারী মুক্তিযোদ্ধা, জাতির বীর- সরকার আপনাদের সম্মান দিতে চায়। যদি আপনি আপনার কথা না বলেন তাহলে তো সেটা সম্ভব না। জানাতে চান সবাইকে?
আমি জানি আমি কোনও ভুল করিনি। কিন্তু সারাজীবন আমাকে ‘ডরে’ কাটাতে হলো। কেউ যেন না জানে। আমি মনে করি, আমার কাছে গল্প শুনে আমার ছেলে কিছু একটা ধারণা করে। তারপরও এটা বলার আর সময় এখন নাই। ছেলের বিয়ে হয়েছে। তারও জীবন আছে। এসময় এসব বলা ভালো দেখায় না। তবে হ্যা, কোন ‘ডর’ ছাড়া মরতে পারলে ভালো হয়, সম্মান আর লাগবে না। সেই যুদ্ধসময় থেকে কেবল আমার ওপর অত্যাচারের কথা এই বুঝি কেউ জেনে গেলো সেই ডরেই তো কাটালাম।-বাংলা ট্রিবিউন
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
আহা চিকুনগুনিয়া !
ঈদের দিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে মেঝেতে পা দিয়ে আমিবিস্তারিত পড়ুন
‘দৃষ্টিশক্তি থাকা, কিন্তু জীবনে লক্ষ্য না থাকা অন্ধত্বের চেয়েও খারাপ’
চক্ষু, কর্ন, জিহবা, নাসিকা, ত্বক – মানুষের এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়েরবিস্তারিত পড়ুন
ধর্ষিতা মেয়েটির গল্প
পারিনি সেদিন নিজেকে শোষকদের হাত থেকে রক্ষা করতে, পারিনি সেদিনবিস্তারিত পড়ুন