সেই ক্ষমতাধর মুজাহিদের শুরু-শেষ যেভাবে
মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। শনিবার রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এরই মধ্যে তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে। আলী আহসান মুজাহিদ ১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার পশ্চিম খাবাসপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মাওলানা আব্দুল আলী ছিলেন বৃহত্তর ফরিদপুরের প্রখ্যাত আলেম ও কোরআনের মুফাসসির। বাবার কাছেই মুজাহিদের শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি। প্রথমে তিনি ফরিদপুরের ময়েজউদ্দিন হাইস্কুলে ভর্তি হন। পরে ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করে এবং ১৯৬৪ সালে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন। সে সময় ১৯৬৫ সালে স্বৈরশাসন বিরোধী ছাত্ররাজনীতি করার কারণে দু’বার কারাবরণ করেন তিনি। এরপর আলী আহসান মুজাহিদ ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন ও ইসলামী ছাত্রসংঘের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এরপর তিনি ওই বছরই প্রথমে ঢাকা জেলা ছাত্রসংঘের সভাপতি ও পরে পূর্ব-পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। আর ১৯৭১ সালে মুজাহিদকে পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেয়। সে সময়ের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। ট্রাইব্যুনালে মুজাহিদের বিপক্ষে তদন্তসংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পূর্ব-পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর ১৭ অক্টোবর রংপুরে ইসলামী ছাত্রসংঘের একটি সভার আয়োজন করেন এবং সেখানে উপস্থিতদের আল-বদরে যোগদানে উদ্বুদ্ধ করেন মুজাহিদ। তিনি ছিলেন আল-বদর বাহিনীর সেকেন্ড-ইন কমান্ড ছিলেন। ট্রাইব্যুনালের রায়ে মুজাহিদকে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বিচারক উল্লেখ করেন, মুজাহিদ ১৯৭১ সালের অক্টোবরে মতিউর রহমান নিজামীর কাছ থেকে সুপ্রিম কমান্ডার হিসেবে আল-বদরের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। আলী আহসান মুজাহিদ ১৯৭২ সালে ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জে বসবাস শুরু করেন। ১৯৭৩ সালে সংসার জীবন শুরু করেন। এরপর তিনি নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন এবং পাশাপাশি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরে মুজাহিদ ১৯৭৫ সালে ‘নারায়ণগঞ্জ আদর্শ স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তিনি ওই স্কুলের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরই মধ্যে ১৯৭৭ সালে মুজাহিদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করেন। ইতোমধ্যে ছাত্ররাজনীতি শেষ করে জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন আলী আহসান মুজাহিদ। রাজনীতির কারণে তিনি ১৯৮১ সালে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্ব পালন শেষে ১৯৮২ সালে মুজাহিদ ঢাকা মহানগর জামায়াতের আমির নির্বাচিত হন। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদেই ছিলেন। এরপর ১৯৮৯ সালে দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন। ২০০০ সালের ৮ ডিসেম্বর সে দায়িত্ব থেকে মুজাহিদ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন, ফাঁসির আগ পর্যন্ত সে দায়িত্বে ছিলেন তিনি। এরই মধ্যে ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন মুজাহিদ। পরে ওই নির্বাচনে বিপুল জয়ে সরকার গঠন করলে তিনি সমাজ কল্যাণমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। মন্ত্রিত্ব অবস্থায় একনেক, জাতীয় নারী উন্নয়ন কাউন্সিল, সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি, কারা সংস্কার কমিটি, এসিড ও ড্রাগ প্রতিরোধ সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি, ক্ষুদ্রঋণ সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি এবং জাতীয় কিশোর সংশোধন সংক্রান্ত কমিটির সদস্য ছিলেন। এরপর ২০০৭ সালের জাতীয় নির্বাচন ঘিরে দেশে সহিংস পরিস্থিতির মধ্যে ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। এরপর সেনা নিয়ন্ত্রণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নেয়। তাদের অধীনে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে ফরিদপুর থেকে অংশ নিলেও মুজাহিদ পরাজিত হন। অবশ্য এর আগে তিনি ১৯৮৬, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনেও অংশ নিয়ে জিততে পারেননি। মুজাহিদ নিজ জেলা ফরিদপুরে আরামবাগ ইয়াতিম খানা, ফরিদপুর বায়তুল মোকাদ্দেম মসজিদ এবং ফরিদপুর মুসলিম মিশনের মত প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে ২০১০ সালের ২৯ জুন আলী আহসান মুজাহিদকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাকে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। ২০১২ সালের ২৬ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে রায় ঘোষণা করে। ২০১৩ সালের ১১ আগস্ট আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ খালাস চেয়ে আপিল করেন। ২০১৫ সালের ১৬ জুন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বিভাগ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখে। বেঞ্চের অন্য বিচারপতিরা হলেন— বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। এরপর গত ৩০ সেপ্টেম্বর মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মানবতাবিরোধী মামলার চূড়ান্ত রায় প্রকাশ করে। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর নিয়ম অনুযায়ী ১৫ দিনের মধ্যেই তারা রিভিউ আবেদন করেন, যেটি ১৮ নভেম্বর খারিজ করে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে আপিল বিভাগ। আর ২১ নভেম্বর রাতে ফাঁসি কার্যকরে শেষ হলো মুজাহিদের আলোচিত-সমালোচিত রাজনৈতিক জীবন।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
সাময়িক বরখাস্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ঊর্মির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনেবিস্তারিত পড়ুন
কমলা হ্যারিসের ভোটের প্রচারণায় বাজবে এ আর রহমানের গান
আগামী নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন উপলক্ষে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী কমলা হ্যারিসেরবিস্তারিত পড়ুন
উপদেষ্টা আদিলুর: পূজায় বিশৃঙ্খলাকারীদের ছাড় দেওয়া হবে না
দুর্গাপূজায় বিশৃঙ্খলাকারীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলে সতর্ক করেবিস্তারিত পড়ুন