হতাশা কাটছে না তিস্তাপাড়ের ২ কোটি মানুষের
স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও আদায় হয়নি উত্তরবঙ্গের প্রাণ তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা। এক সময়ের ক্ষরস্রোতের নদীটিতে বন্যার সময় থাকে থৈথৈ পানি থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে পরিণত হয় মরুভূমিতে। পানিবন্টন চুক্তির বিষয়ে একাধিকবার আলোচনা হলেও এর কোনো সুরাহা হয়নি।পানি পাওয়ার বিষয়ে তিস্তাপাড়ের মানুষ আশায় বুকবাধলেও সেই আশা পূরণ হয়নি। বার বার হতাশ হয়েছে ওই অঞ্চলের মানুষ।এতে তিস্তাপাড়ের মানুষের জীবন জীবিকায়ও পরেছে অনিশ্চয়তার ছায়া।উত্তরবঙ্গকে মরুকরণ থেকে রক্ষা করতে তিস্তা নদীর পানির সমবণ্টন অনেকটাই জরুরি হয়ে পরেছে।
আজ ২৫ সেপ্টেম্বর বিশ্ব নদী দিবস। এ উপলক্ষে তিস্তার ন্যায্য হিস্যা দেয়ার দাবি করেছেন এ অঞ্চলের মানুষ।পাশাপাশি বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষে তিস্তা নদীকে জাতীয় নদী ঘোষণার দাবি তুলেছেন উত্তরাঞ্চলের মানুষ।
নদী বিশ্লেষকরা বলছেন, তিস্তাকে জাতীয় নদী করা হলে তিস্তাচুক্তির অমীমাংশিত ইস্যুটি ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সমানভাবে গুরত্বপাবে। সেইসঙ্গে পরিবেশ ও প্রকৃতিকে বাঁচাতে প্রয়োজন এই মৃতপ্রায় নদীকে জীবিত রাখা।
২০১১ সালে বাংলাদেশ সফরে আসেন তৎকালীন ভারতের প্রধানমমন্ত্রী মনমোহন সিং, মমতা ব্যানার্জী এবং দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও বাংলাদেশ সফর করেছেন। তাদের সফরেও তিস্তা নিয়ে আলোচনা হলেও এর কোনো সুরাহা হয়নি। এতে চরম ক্ষুব্ধ ও হতাশায় তিস্তা পাড়ের ২ কোটি মানুষ।
তিস্তায় বর্ষায় পানিতে থৈথৈ আর প্রয়োজনের সময় পানি না থাকায় বিপর্যয় দেখা দিয়েছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন যাত্রায়। অকার্যকর হয়ে পড়েছে দেশের অন্যতম বৃহত্তম সেচ প্রকল্প-তিস্তা ব্যারেজ। পরিবেশ প্রকৃতি ধংস হয়ে যাচ্ছে। ৪৫ বছর ধরে ভাটির এই বাংলাদেশ আকুতি জানিয়ে আসলেও তিস্তা ইস্যুতে একটুও বরফ গলেনি প্রতিবেশি ‘বন্ধু’ রাষ্ট্র ভারতের।
জানাগেছে, এক সময় এদেশে ১২শ’ নদীর অস্তিত্ব থাকলেও এখন ২শ’র বেশি নদী বাস্তবে চলমান নাই। এর মধ্যে শীত কালে ৬০-৬৫টির বেশি নদীর পানি প্রবাহ থাকে না। উত্তারাঞ্চলের জীবনরেখা তিস্তারও এখন মরণ দশা। তাই প্রয়োজনের সময় পানি না পাওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে এ অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা।
নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিন্ন নদীর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন, দুই পক্ষের সমঝোতা এমন কি মানবিক আবেদন উপেক্ষা করে উজান থেকে এক তরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে দিন দিন পানির জন্য হাহাকার বাড়ছে শস্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত দেশের উত্তরাঞ্চলে। তবুও ভারতের পানি না দেয়াটা অনৈতিক ঢিলেমি, একগুয়েমিতা ও আন্তর্জাতিক অভিন্ন নদী আইনের অবমাননা বলছেন সবাই।
জানা গেছে, দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দুই দেশের মন্ত্রী পরিষদের এক বৈঠকে তিস্তার পানি বন্টনে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ ও ৩৯ ভাগ ভারত এবং ২৫ ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়।
কিন্তু ঐ সিদ্ধান্তে তিস্তার পানি প্রবাহের পরিমাণ, কোন কোন জায়গায় পানি ভাগাভাগি হবে এরকম কোনো বিষয় উল্লেখ না থাকায় তা আর আলোর মুখ দেখেনি। অন্যদিকে ২০০৭ সালের ২৫ , ২৬ ও ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ ভাগ দু’দেশের মধ্যে বন্টন করে বাকি ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেয়ার জন্য প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ভারত সেই প্রস্তাব গ্রহণ না করে উল্টো তিস্তার কমান্ড এরিয়া তাদের বেশি-এই দাবি তুলে বাংলাদেশ তিস্তার পানির সমান ভাগ পেতে পারে না বলে যুক্তি দেখায়। শুধু তাই নয়, ভারত তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের সেচ এলাকা কমিয়ে দ্বিতীয় প্রকল্প বাতিল করার জন্য চাপ দেয়। পরবর্তীতে ভারত এক চিঠিতে তিস্তার মাত্র ২০ ভাগ পানি ভাগাভাগি করার বিষয়টি জানিয়ে দিয়ে চরম হঠকারী বন্ধুর পরিচয় দেয়। ফলে শুষ্ক মৌসুমে পানি শূন্য হয়ে তিস্তা হয়ে যায় মরুভূমি। আর কারণে-অকারণে বর্ষাকালে গজলডোবার গেট খুলে তিস্তায় পানি ছেড়ে দিয়ে ভারত তিস্তা ও এর আশেপাশের অর্ধকোটি মানুষকে বন্যায় বন্দী করে ফেলে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের থাবায় বিপর্যস্ত এখন এই অঞ্চলের প্রকৃতিতে।
সূত্র জানিয়েছে, ২০১০ সালের ৪ জানুয়ারি ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লীতে নদী কমিশনের সচিব পর্যায়ের সর্বশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করেন। পরে ১৮ ও ১৯ মার্চ নদী কমিশনের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বেশ কয়েক দফায় বৈঠকের পর ২০১১ সালের মনমোহন সিংহের বাংলাদেশ সফরের সময় তিস্তার চুড়ান্ত চুক্তি হওয়ার কথা। কিন্তু সেই সফরেও মমতার ব্যানার্জীর মন না গলার কারণে তিস্তা চুক্তি নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো হয়নি। যদিও সেসময় মমতাকে গজলডোবা পয়েন্টের ২৫ ভাগ পাবে বাংলাদেশ আর ৭৫ ভাগ পাবে ভারত বলে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল ভারত।
চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি মমতা বাংলাদেশ সফরে আসেন এবং তিস্তা চুক্তির বিষয়ে আশ্বাস দিয়ে যান। কিন্তু সে আশ্বাস আর আলোর মুখ দেখেনি। এর পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আসলেও তিস্তা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। ফলে তিস্তা চুক্তির ভবিষ্যত অন্ধকার ভাবছেন উত্তরাঞ্চলের মানুষ। এজন্য ক্ষুব্ধ ও হতাশ তারা।
১৭৮৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত তিস্তা নদীই ছিল উত্তরবঙ্গেরই প্রধান নদী। এই নদীর যৌবনা অবয়বের কারণে উত্তরবঙ্গের প্রকৃতি ছিল শীতল, শান্ত ও মায়াময়। কিন্তু পানি বণ্টনের ব্যাপারে ভারতের একগুয়েমিতায় তিস্তা তীরবর্তি ও আশেপাশের প্রকৃতি রুক্ষ হয়ে ওঠেছে। তলদেশে অজস্র পাথর, নুরি, বালি আর পলি পড়ে তিস্তার বুক জুড়ে শুষ্ক মৌসুমে থাকে বালুময়।
অন্যদিকে বর্ষাকালে মূল গতিপথ বদলে তিস্তা প্রচ-ভাবে আছরে পড়ে দুই তীরে। ফলে নির্দয় ভাঙনে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ বাড়িঘর, গাছপালা, আবাদি জমি হারিয়ে পথে বসছে। তিস্তার পানি ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা সেচ প্রকল্পটিও স্থবির হয়ে পড়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সেচ প্রকল্প এলাকায় সেচ দেয়া এবং নদীর প্রবাহমাত্রা ঠিক রাখতে তিস্তায় স্বাভাবিক প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন ২০ হাজার কিউসেক পানি। শুধু সেচ প্রকল্প চালাতেই প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন ১৪ হাজার কিউসেক এবং নদীর অস্তিত্ত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজন ৪ হাজার কিউসেক পানি। কিন্তু ডিসেম্বর মাসের পর থেকে তিস্তায় পানি প্রবাহ মারাত্বকভাবে কমে যায়। এই সময়ে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তায় পানির প্রবাহের মাত্রা বিগত বছরগুলোতে ছিল গড়ে ৭০০ কিউসেকের কিছু ওপরে। অন্যদিকে বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানির কারণে ব্যারেজ ও পাশ্ববর্তী এলাকার ফসল ও বাসাবাড়ি ঝুঁকির মুখে পড়ে। তখন ব্যারেজের ৪৪ টি গেট ২৪ ঘণ্টা খুলে দিয়েও পানি সরানো সম্ভব হয় না। এই অতিরিক্ত পানি অপসারণের জন্য প্রকল্পের উত্তরে ৬১০ মিটার একটি বাইপাস খাল নির্মাণ করা হয়। ১৯৯৮ সালের বন্যায় এই খাল ধ্বংস হয়ে অনেক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কার্যত ব্যারেজ প্রকল্পটিই এখন অকার্যকর। ফলে সেচ প্রকল্প এলাকায় প্রথম ও দ্বিতীয় ফেজে প্রায় ৭ লাখ হেক্টর জমিতে প্রতিবছরই পানির তীব্র সংকট বিরাজ করে। চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হন।
এ অঞ্চলের মানুষদের অভিমত, দেশের অন্যতম প্রধান এ নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পেলে শুষ্ক মৌসুমে এ অঞ্চলের চাষাবাদে আসবে নতুন চাঞ্চল্য, জীববৈচিত্র রক্ষা পাবে বিরূপ প্রভাব থেকে। শুধু তাই নয়, তিস্তা ফিরে পাবে তার পুরোনো দিনের খরস্রোতা চিরচেনা রূপ।
তিস্তার খেয়াঘাটের মাঝিরা জানান, পানি না থাকায় এক সময়ের খরস্রোত তিস্তা দিনে দিনে খালে পরিণত হচ্ছে। শুধুমাত্র বর্ষার ৪/৫ মাস নৌকা চালালেও বছরের বাকি সময় বন্ধ থাকে। নদীর মাছ আর শুঁটকি বিক্রি করে পরিবার চালিয়েছেন তারা। এখন নদীতে পানি না থাকায় খাওয়ার জন্যই মাছ পাওয়া যায় না। পরিবারের সবাই মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। পানি পেলে আবারো সেই আগে দিনের মত নৌকা চালিয়ে জীবন নির্বাহ করা যাবে বলে জানান মাঝি-জেলেরা।
তিস্তা তীরবর্তী কৃষক হযরত আলী, রহমান, বেলাল হোসেন জানান, পানি না থাকায় ধান, পাট, আলুসহ বিভিন্ন ফসলি জমিতে সেচ দিতে গুণতে হয়েছে বাড়তি খরচ। তিস্তায় পানি পেলে সে বাড়ি খরচ হবে না।
রিভাইন পিপলস বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠনের পলিট ব্যুরো সদস্য অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, আমরা মনে করি উত্তরাঞ্চলের আকাশ বাতাসকে বাঁচাতে সবার আগে প্রয়োজন তিস্তাকে জীবিত করা। এই তিস্তাকে জীবিত করা না গেলে এক সময় এ অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবে। আমাদের দাবি এবারের নদী দিবসে তিস্তাকে জাতীয় নদী ঘোষণা করা হোক।
‘তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও’ আন্দোলন কমিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, মোদির বাংলাদেশ সফরে আমাদের প্রত্যাশা ছিল তিস্তা চুক্তি হবে। ২০১১ সালে মনমোহন সিংয়ের সফরেও কিছু হয়নি। উল্টো ২০১৪ সালে অভিন্ন তিস্তার উজান থেকে সব পানি প্রত্যাহার করে কাজে লাগিয়েছে ভারত।
তিনি বলেন, তিস্তা অভিন্ন নদী। সেখানে অভিন্ন অধিকার আমাদের। যেভাবেই হোক তিস্তাকে নদীকে বাঁচাতে সব ধরনের উদ্যোগ নেবে সরকার এমনটাই আশা তাদের।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
উপদেষ্টা মাহফুজ: সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন,“গণ-অভ্যুত্থান ও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থেবিস্তারিত পড়ুন
বড় ব্যবধানে অ্যান্টিগা টেস্টে হারলো বাংলাদেশ
চতুর্থ দিনেই অ্যান্টিগা টেস্টের ফল কোন দিকে গড়াচ্ছে, তা নির্ধারণবিস্তারিত পড়ুন
কিশোরগঞ্জে মা-বাবা ও ২ সন্তানের মরদেহ উদ্ধার
কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলায় একই পরিবারের চার জনের মরদেহ উদ্ধার করেছেবিস্তারিত পড়ুন