১৯৭১: যে প্রতিবেদন ইতিহাসের মোড় পাল্টে দিয়েছিল

১৯৭১ সালের ১৩ জুন, বৃটেনের ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকায় বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভয়াবহ নির্যাতনের উপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর প্রতিবেদককে পরিবারসহ আত্নগোপনে যেতে হয়েছিল কিন্তু ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিয়েছিল সে প্রতিবেদন।
২৪ বছর বয়সী এক বাঙালী যুবকের করুণ ভাগ্যের বর্ণনা ছিল সে প্রতিবেদনে, যাকে পাকিস্তানি বাহিনী গুলি করে হত্যা করে।
প্রতিবেদনটি তৈরি করেছিলেন পাকিস্তানের সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস, প্রকাশিত হয়েছিল বৃটেনের বিখ্যাত সানডে টাইমস পত্রিকায়। ১৯৭১ সালে পূর্ব পকিস্তানের জনগণের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের বর্বর নির্যাতনের কথা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল এ প্রতিবেদনটির মাধ্যমেই।
অনেকে মনে করেন, মাসকারেনহাসেনর ওই প্রতিবেদনটি যুদ্ধ দ্রুত শেষ হতে ভূমিকা রেখেছে। প্রতিবেদনটি সারা বিশ্বে পাকিস্তানি নির্যাতনের বিরুদ্ধে ও বাঙালিদের পক্ষে জনমত ও সমর্থন তৈরিতে সাহায্য করেছে। একই সঙ্গে ভারতকেও এ যুদ্ধে ভূমিকা রাখতে উদ্বুদ্ধ করে থাকতে পারে এ প্রতিবেদন।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পরবর্তীতে সানডে টাইমসের তৎকালীন সম্পাদক হ্যারল্ড ইভান্সকে বলেছিলেন, প্রতিবেদনটি তার মনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে যার প্রেক্ষাপটে তিনি ব্যাক্তিগত উদ্যোগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মস্কোতে গিয়ে এ যুদ্ধে ভারতের অংশগ্রহণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন।
হ্যারল্ড ইভান্স এক স্মৃতি কথায় লিখেছিলেন, ‘যুদ্ধে প্রভাব রাখার কোনো চিন্তাই ছিল না মাসকারেনহাসের। তিনি ছিলেন খুব ভালো একজন প্রতিবেদক এবং নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের কাজটাই করেছিলেন।’
হ্যারল্ড লিখেছেন, ‘তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী। পাকিস্তানে তখন সেনা শাসন চলছে। তিনি জানতেন প্রতিবেদনটি প্রকাশ হলেই তাকে ও তার পরিবারকে দেশ ছাড়তে হতে পারে। এত বড় ঝুঁকি নেয়াটা তখন খুব সোজা ছিল না।’
মাসকারেনহাসের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী একবার বলেছিলেন, ‘তার (মাসকারেনহাস) মা তাকে সবসময় সত্য ও ন্যায়ের পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি সবসময় আমাকে বলতেন, আমার সামনে একটা পাহাড় দাঁড় করিয়ে দাও, আমি সেটি অতিক্রম করতে পারব। কিন্তু কখনো দমে যাব না।’
মাসকারেনহাস ছিলেন করাচির একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক। পাকিস্তানের সংখ্যালঘু গোয়ান খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন তিনি।
১৯৭০’র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করলেও পশ্চিম পাকিস্তানিরা ক্ষমতা ছাড়েনি। তারপরের প্রেক্ষাপট আস্তে আস্তে যুদ্ধের দিকে গড়ায়। আওয়ামী লীগ অসহযোগিতার আহবান জানায়। চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হয় ২৫ মার্চ রাতে।
সেদিন রাতেই পাক বাহিনী প্রথম যুদ্ধাপরাধ সংগঠিত করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘুমন্ত ছাত্রদের উপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে তারা। সমস্ত ঢাকায় চালায় নারকীয় তাণ্ডব।
ঢাকায় নারকীয় তাণ্ডব চালানোর পরই পাকবাহিনী বাহিনী গ্রামাঞ্চলের দিকে যুদ্ধ শুরু করে। তখনই পাক বাহিনী কিছু পাকিস্তানি সাংবাদিককে ঢাকায় এনে ‘স্বাধীনতাকামীদের’ পরাজিত করার বাহবা নেয়ার পরিকল্পনা করল।
তখন ইতোমধ্যেই ঢাকায় বিদেশি সাংবাদিক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মাসকারেনহাসসহ আরও দশজন পাকিস্তানি সাংবাদিককে ১০ দিনের এক সফরে পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে আসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ফিরে গিয়ে সাতজনই সেনাবাহিনীর কথামতো প্রতিবেদন লিখল।
কিন্তু বাধ সাধল একজন।
মাসকারেনহাসের স্ত্রী সেদিনের ঘটনা স্মরণ করে বলেন, ‘আমার স্বামী সেদিন বিধ্বস্ত অবস্থায় বাসায় ফিরেছিল। তার এমন অবস্থা আমি কখনো দেখিনি। তিনি ছিলেন শোকস্তব্ধ, আবেগাক্রান্ত ও হতাশ।’
তিনি আমাকে বললেন, পূর্ব পাকিস্তানে তিনি যা দেখেছেন, তা যদি লিখেন, তাহলে এরপর আর একটি শব্দও লিখতে পারবেন না।
স্পষ্টতই এটা পাকিস্তানে হতে পারত না। সবগুলো সংবাদপত্রে প্রতিবেদনগুলো সেনাবাহিনী যাচাই করে দিত। সেনা বাহিনীর আদেশ অমান্য করে প্রতিবেদন লিখলে তাকে গুলি করা হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন মাসকারেনহাস।
এ অবস্থায় অসুস্থ বোনকে দেখার নাম করে মাসকারেনহাস লন্ডন চলে গেলেন। লন্ডনে গিয়ে সানডে টাইমের অফিসে গিয়ে সোজা পত্রিকাটির সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করলেন তিনি।
সেদিনের সাক্ষাতের কথা স্মরণ করে হ্যারল্ড লিখেছেন, ‘বাঙালিদের উপর নির্যাতনের ভয়াবহতায় মাসকারেনহাস ছিলেন খুবই বিচলিত। সেনাবাহিনী সেখানে যে তাণ্ডব চালিয়েছে, সেটি ছিল জঘন্য, ভয়াবহ।’
মাসকারেনহাস হ্যারল্ডকে বলেছিলেন, বহু হত্যাদৃশ্য ও হত্যা পরিকল্পনার কথা তিনি নিজের প্রত্যক্ষ করেছেন। এমনকি সেনা কর্মকর্তারা এসব হত্যাকেই ‘চূড়ান্ত সমাধান’ হিসেবে বর্ণনা করার কথাও তিনি নিজে সরাসরি শুনেছেন।
হ্যারল্ড তার পত্রিকায় প্রতিবেদনটি ছাপাতে রাজি হলেন। তবে তিনি স্ত্রী ও সন্তানদের পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসার পরামর্শ দিলেন মাসকারেনহাসকে।
মাসকারেনহাস তার স্ত্রীকে সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে লন্ডনে আসার জন্য একটি সাংকেতিক টেলিগ্রাম পাঠান। একটি মাত্র স্যুটকেস নিয়ে সন্তানদের সঙ্গে করে লন্ডনে চলে আসলেন তার স্ত্রী। যেদিন মাসকারেনহাসের পুরো পরিবার লন্ডনে চলে আসে, সেদিন সানডে টাইমসে প্রতিবেদনটি ছাপা হয়। বড় করে কালো রঙে শিরোনাম করা হয়- ‘জেনোসাইড’।
প্রতিবেদনটি ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। মাসকারেনহাস ছিলেন পাকিস্তানের সর্বমহলে বিশ্বাসযোগ্য একজন ব্যাক্তি এবং সেনাবাহিনীর মধ্যেও তার এতটাই গ্রহণযোগ্যতা ছিল যে, তিনি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রায়ই সময় কাটাতেন।
প্রতিবেদনটির উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দিক-
‘শহর এবং গ্রামে মানুষদের হত্যা ও এরপর পুড়িয়ে ফেলার ঘটনা আমি নিজ চোখে দেখেছি।’
‘আমি পুরো গ্রামকে ধংস করে দিতে দেখেছি’
‘সেনাদের একটি মেসে সারাদিন কে কতটি খুন করেছে, তা নিয়ে গর্ব করতে দেখেছি, চিৎকার করে আনন্দ প্রকাশ করতে দেখেছি’
পাকিস্তানি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি বেইমানের মতো কাজ করেছেন। এবং তাকে ‘শত্রু’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। কিন্তু তারপরও সেনাবাহিনী তাদের কৃতকর্মের কথা অস্বীকার করে। বরং ওই প্রতিবেদনকে ভারতের প্রোপাগান্ডা বলে দাবি করে পাকিস্তান।
তারপরও তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলেন। ১৯৭৯ সালে পাকিস্তানের পরমানু অস্ত্র তৈরির কথা প্রথম প্রকাশ করেন মাসকারেনহাস।
বাংলাদেশে মাসকারেনহাসকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয় এবং দেশটির মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এখনো প্রতিবেদনটি প্রদর্শন করা হয়।
বিবিসি অবলম্বনে
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ

ব্যাংকক থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা
ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ শেষে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদবিস্তারিত পড়ুন

বিশ্বকবির ম্যুরাল থেকে কালি মুছে দিল উপজেলা প্রশাসন
কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ম্যুরালে কালি দিয়ে মুখবিস্তারিত পড়ুন

ফখরুল: ইউনূস–মোদির বৈঠক আশার আলো দেখাচ্ছে
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীবিস্তারিত পড়ুন