৪ বিচারককে বহিষ্কার
দুর্নীতি ও বিচারবিভাগীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে চার বিচারককে চূড়ান্তভাবে বহিষ্কার (চাকরিচ্যুতি) অনুমোদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। জাগো নিউজকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন সুপ্রিম কোর্ট সূত্র। অপরদিকে ফুলকোর্ট সভা থেকে দুর্নীতি ও অসদাচরণের অভিযোগে আরো দুই বিচারককে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
একইসঙ্গে বরখাস্ত হওয়া ওই চার বিচারকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অসদাচরণের অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করার জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্ট।
এই চারজন হলেন- কুমিল্লার সাবেক নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক (জেলা জজ) এসএম আমিনুল ইসলাম, ঠাকুরগাঁওয়ের সাবেক জেলা জজ মো. রুহুল আমিন খোন্দকার, জামালপুরের সাবেক অতিরিক্ত জেলা জজ মো. সিরাজুল ইসলাম ও খুলনার সাবেক অতিরিক্ত জেলা জজ মঈনুল হক। তারা বর্তমানে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত আছেন।
বিচারিক কাজে কর্মরত থাকাকালে এই চার বিচারক বিভিন্ন সময়ে অজামিনযোগ্য মামলায় জামিন, আদালতে কর্মচারী নিয়োগসহ বিভিন্ন বিষয়ে দুর্নীতি ও অসদাচরণের আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
চার বিচারককে চাকরিচ্যুত করে বরখাস্তের অনুমোদনের নথি বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে গেছে বলে সূত্র জানিয়েছে। এখন আইন মন্ত্রণালয় বরখাস্তের আদেশ (প্রজ্ঞাপন) জারি করবে।
বিচারকদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি এবং অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি দেখভাল করে জিএ (জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) কমিটি। ওই কমিটির প্রধান হলেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহা। জিএ কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী এই নথি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
নির্দেশ মোতাবেক সংশ্লিষ্ট চার বিচারকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে তদন্ত করে সেই প্রতিবেদন জিএ কমিটির কাছে পাঠানো হয়। জিএ কমিটি ওই বিচারকদের বরখাস্তের বিষয়টি ফুলকোর্ট সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করে। তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে ফুলকোর্ট সভায় চার বিচারককে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
গত ১০ আগস্ট বুধবার সুপ্রিম কোর্টের ফুলকোর্ট সভায় এই চার বিচারকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। অন্যদিকে ফুলকোর্ট সভায় নিম্ন আদালতের তিন বিচারকের পদোন্নতিও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
পদোন্নতি পাওয়া তিন বিচারক হলেন, মাগুরার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ ইসমাইল, মাদারীপুরের সাবেক চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বর্তমানে পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সের আইন কর্মকর্তা (অতিরিক্ত জেলা জজ) প্রশান্ত কুমার বিশ্বাস ও মাগুরার জেলা ও দায়রা জজ মো. রুস্তম আলী।
অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন যে দুইজন তারা হলেন- কক্সবাজারের সাবেক চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বর্তমানে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা জজ সৈয়দ হুমায়ুন আজাদ ও ময়মনসিংহের জেলা জজ আদালতের অধীন ঈশ্বরগঞ্জ চৌকি আদালতের সাবেক সিনিয়র সহকারী জজ মোহাম্মদ কামাল খান।
জেলা জজ আমিনুল ইসলাম
কুমিল্লার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক এসএম আমিনুল ইসলাম ২০১১ সালে ঢাকা জেলা জজ আদালত ও ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অবকাশকালীন বিচারকের দায়িত্ব পালনকালে একাধিক মামলায় গুরুতর অনিয়ম ও দুর্নীতি করেন। তিনি রাজধানীর হাজারীবাগ থানার চাঞ্চল্যকর নাদিয়া হত্যা মামলায় আসামি মো. শিকদার শফিকুর রহমানকে জামিন দেন। এই আসামি স্ত্রীকে হত্যা করে লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে নিজ গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়ার সময় শাহবাগ এলাকায় হাতেনাতে ধরা পড়েন। পরবর্তীতে তিনি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন। বিষয়টি সে সময় চাঞ্চল্যকর উল্লেখ করে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
শফিকুরের বিরুদ্ধে স্ত্রী হত্যার অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ার পরও হত্যাজনিত কোনো বিষয় না উল্লেখ করেই ওই বিচারক জামিন দিয়ে দেন।
এছাড়াও তিনি জাল টাকা তৈরির একাধিক মামলা, ইয়াবা এবং ফেনসিডিলের প্রায় ২০টি মামলার আসামিকে জামিন প্রদান করেন।
এসব জামিন দেয়া নিয়ে তখন ওই বিচারকের বিরুদ্ধে গুরুতর অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এ অভিযোগের তদন্ত করে প্রমাণ পাওয়া যায়। এরপর সুপ্রিম কোর্টের জিএ কমিটি তাকে চূড়ান্তভাবে বরখাস্তের সুপারিশ করেন। বুধবার প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বিভাগের সব বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত ফুলকোর্ট সভায় তাকে বরখাস্তের চূড়ান্ত প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়।
জেলা জজ রুহুল আমিন
ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা ও দায়রা জজের দায়িত্ব পালনকালে বিচারক মো. রুহুল আমিন খোন্দকারের বিরুদ্ধে জামিন, চাকরি, জমির ইজারা প্রদানসহ বেশকিছু বিষয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। স্ত্রী হত্যার দায়ে অভিযুক্ত আসামি ২০০৮ সালের ২৪ জুলাই ওই বিচারকের আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন না দিয়ে ছেড়ে দেন এবং উৎকোচের বিনিময়ে একই বছরের ১৩ আগস্ট জামিন প্রদান করেন।
২০০৭ সালে দুদক আইনে করা একটি মামলা জরুরি বিধিমালা অনুযায়ী জামিন অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও উৎকোচ গ্রহণ করে জামিন প্রদান করেন। ২০০৮ সালের একটি হত্যা মামলার আসামিদের জামিন শুনানি মুলতবি রেখে যেদিন তিনি কর্মভার অর্পণ করে বিদায় নেন, সেদিন আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যার সুস্পষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও উৎকোচ গ্রহণ করে জামিন দিয়ে যান। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা জজ আদালত চত্বরের জায়গার ইজারা প্রদান, চাকরি প্রদানের ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির মোট ৭টি অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগের তদন্ত করে প্রমাণ পায় তদন্ত কর্মকর্তা। এরপর সর্বশেষ তাকে চূড়ান্তভাবে বরখাস্ত করা হয়।
অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মঈনুল হক
২০০৮ সালে খুলনার ১ম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারকের দায়িত্ব পালনকালে মঈনুল হকের বিরুদ্ধে গুরুতর অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। ওই সময় খুলনার জেলা জজ তদন্ত করে দেখতে পান, ৬৫টি ক্রিমিনাল আপিল, ১২টি ক্রিমিনাল রিভিশন, ৬৪টি সিভিল আপিলসহ মোট ১৪১টি মামলা শুনানি করে রায়ের জন্য স্তূপাকারে রেখে দেন। এই বিপুল পরিমাণ নথি রায়ের জন্য ফেলে রেখে দেয়ায় তার সততা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
খুলনা বার সমিতির ৬৮ জন আইনজীবী মঈনুল হকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন। তারা বলেন, মঈনুল হক ১৫০টির বেশি আপিল শুনানি করে টাকার বিনিময়ে রায় দিয়েছেন। তিনি বিচারক এবং কর্মচারীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দলাদলি সৃষ্টি করেন। এসব উল্লেখ করে খুলনার জেলা জজ ওই বিচারককে খুলনা থেকে অপসারণের জন্য আবেদন জানান। পরবর্তীতে তদন্তে এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়।
অতিরিক্ত জেলা জজ সিরাজুল ইসলাম
২০০৯ সালে জামালপুরের অতিরিক্ত জেলা জজের দায়িত্ব পালনকালে এই বিচারকের বিরুদ্ধে স্থানীয় আইনজীবী সমিতি, মামলায় সম্পৃক্ত আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা একাধিক অভিযোগ তোলেন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলায় ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ ওঠে। এজলাস কক্ষে বিচার চলাকালে একটি মামলার বাদিনী মালা রাউথ প্রতিপক্ষের আইনজীবী ও অতিরিক্ত পিপি সুদীপ দে মিঠুকে বিচারকের প্রচ্ছন্ন ছত্রছায়ায় চড় মেরে অপদস্থ করেন। গৃহপরিচারিকার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক এবং তার স্বামী একটি মামলায় জামিনে থাকা সত্ত্বেও পুলিশি হয়রানি করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে এই বিচারকের বিরুদ্ধে, যা পরবর্তীতে তদন্তে প্রমাণিত হয়।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
ড. ইউনূসের মন্তব্য দেশের মানুষের জন্য অপমানজনক : আইনমন্ত্রী
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, কর ফাঁকি দেওয়ার মামলাকে পৃথিবীর বিভিন্নবিস্তারিত পড়ুন
ময়মনসিংহে ওসি-এসপি’র বার্ষিক কর্ম সম্পাদন চুক্তি স্বাক্ষর
সরকারি দায়-দায়িত্ব ও কর্মকান্ডে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি, সম্পদের যথাযথবিস্তারিত পড়ুন
ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় জনগণের সাথে রায়েছে বিচার বিভাগ
দেশের মানুষের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বিচার বিভাগ জনগণের সঙ্গে আছেবিস্তারিত পড়ুন