অটো রিকশা বন্ধ করা কি সম্ভব
কালিহাতী থেকে অসুস্থ বাবা ছোলেমান আলীকে নিয়ে ছেলে ফরিদ আলী আসছেন টাঙ্গাইল জেলা সদরের জেনারেল হাসপাতালে। তার বাহন সিএনজিচালিত অটোরিকশা। কারণ কালিহাতী উপজেলা সদরের হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্স পাওয়ার ক্ষমতা তার মতো দিনমজুরের নেই। বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া দেওয়ার সামর্থ্যও নেই। ভিড়ে গাদাগাদি করে বাসে অসুস্থ বয়োবৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে আসাও সম্ভব নয়। অতএব ৩০০ টাকা ভাড়ায় অটোরিকশাই তার কাছে সবচেয়ে ভালো উপায়।
কালিহাতী থেকে টাঙ্গাইল জেলা হাসপাতালে আসতে হলে প্রায় ১০-১২ কিলোমিটার পথ জাতীয় মহাসড়ক পার হয়ে আসতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। প্রশ্নটা এখানেই, ১ আগস্ট থেকে মহাসড়কে অটোরিকশা চলার সরকারি প্রজ্ঞাপন বাস্তবায়ন হলে ফরিদ আলীর মতো মানুষের যাতায়াতের এ প্রয়োজন মিটবে কীভাবে? এমন প্রশ্ন ফেনীর দাগনভূঞার আবু হানিফেরও। দাগনভূঞা থেকে তার মেয়ের শ্বশুরবাড়ি পরশুরামে যাওয়ার একমাত্র বাহন এখন সিএনজি অটোরিকশা।
‘মুড়ির টিন’ নামে যে লোকাল বাস ছিল, তাও এখন প্রায় বিগত যুগের ইতিহাস। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ব্যবহার ছাড়া ফেনীর পূর্ব-পশ্চিমের উপজেলার ভেতরে যাওয়ার জন্য বিকল্প কোনো রাস্তাও নেই। মহাসড়কে অটোরিকশা না চললে মানুষ কি মহাসড়ক ধরে পাঁচ-সাত কিলোমিটার পথ হেঁটে পার হবে?
আঞ্চলিক সিএনজি অটোরিকশা মালিক ও শ্রমিক সংগঠন এবং ফরিদ আলী, আবু হানিফের মতো সাধারণ মানুষের দাবি, বিকল্প যানবাহন এবং বিকল্প সড়ক সৃষ্টি করে মহাসড়কে স্বল্প গতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করা হোক। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহনের জন্য বিকল্প লেন নেই, কম দূরত্বে যাত্রীরা স্বচ্ছন্দে ভ্রমণ করতে পারে_ এমন বাস বা গণপরিবহন ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হয়নি। ফলে নিদারুণ বাস্তবতাতেই অটোরিকশা, নছিমন, করিমনের মতো যানবাহনে চড়তে বাধ্য হচ্ছে তারা।
যাত্রীদের সংকট এবং বাস্তবতা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত না নেওয়া হলে হঠাৎ করে নেওয়া কোনো ভালো সিদ্ধান্তও বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে। যেমন এর আগে চার দফা সিদ্ধান্ত নিয়েও। নছিমন-করিমন বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।
এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সড়ক বিভাগের সচিব এমএএন সিদ্দিক বলেন, এ মুহূর্তে সড়ক দুর্ঘটনা কমানোকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ কারণেই মহাসড়ক থেকে ছোট এবং কম গতির যানবাহন তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত জেলা প্রশাসক সম্মেলনে জেলা প্রশাসকরা তাকে জানিয়েছেন, বেশিরভাগ এলাকায় মহাসড়ক বাদ দিয়ে উপজেলা বা ইউনিয়ন পরিষদের ভেতরে ছোট সড়ক দিয়ে যানবাহন চলতে পারবে।
কিছু কিছু জায়গায় যেখানে একেবারেই মহাসড়কের বিকল্প নেই, সেখানে বিশেষ ব্যবস্থায় জরুরি প্রয়োজন বিবেচনায় কিছু ছোট যানবাহন চলতে পারে। তিনি আরও জানান, ভবিষ্যতে যত নতুন মহাসড়ক নির্মিত হবে এবং চার লেনে উন্নীত করা হবে, তার প্রত্যেকটিতে স্বল্প গতির যানবাহন চলাচলের জন্য পৃথক উপসড়কও সংযুক্ত থাকবে।
এদিকে মহাসড়কে অটোরিকশা চলাচল নিষিদ্ধের সরকারি সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে বাংলাদেশ অটোরিকশা-অটোটেম্পো সংগ্রাম পরিষদ ধারাবাহিক আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। আগামী ৪ আগস্ট জেলা প্রশাসকদের কাছে স্মারকলিপি পেশ, ৮ আগস্ট সব জেলা সদরে মানববন্ধন, ৯ থেকে ১১ আগস্ট জেলায় জেলায় সমাবেশ ও মিছিল এবং সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় সমাবেশ। এ ছাড়া চট্টগ্রাম ও সিলেটে আজ বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে স্থানীয় অটোরিকশাচালক-মালিকদের স্থানীয় সংগঠনগুলো।
মহাসড়কে অটোরিকশার বাস্তবতা : বিআরটিএ সূত্র জানায়, ঢাকার বাইরে সারাদেশে বর্তমানে প্রায় দুই লাখ সিএনজি অটোরিকশার নিবন্ধন রয়েছে। জেলা পর্যায়ের নিবন্ধন নেওয়া এসব অটোরিকশাই এখন চলছে জাতীয় এবং আঞ্চলিক মহাসড়কে।
বিভিন্ন ব্যুরো ও জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের বেশিরভাগ জেলা শহরের সঙ্গে বিভিন্ন উপজেলার যোগাযোগে ব্যবহৃত হচ্ছে অটোরিকশা। পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য হারে নছিমন-করিমনও চলছে। অটোরিকশার ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার কারণে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা সড়কে লোকাল বাস চলাচলও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ফেনীতে এক সময় দাগনভূঞা, সোনাগাজী থেকে পরশুরাম, ছাগলনাইয়ায় ‘মুড়ির টিন’ নামে পরিচিত লোকাল বাস চলত। ২০০৭ সালের পর থেকে এসব লোকাল বাস চলাচল একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। এখন বেশিরভাগ মানুষ ফেনী থেকে এসব উপজেলায় চলাচল করেন সিএনজি অটোরিকশায়।
সাধারণ যাত্রীরা জানান, আগে যে লোকাল বাস চলত সেগুলোর সেবার মান খুবই নিম্নমানের ছিল। গাদাগাদি করে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি রাস্তায় যত্রতত্র থামত। ফলে দশ-পনেরো কিলোমিটারের দূরত্ব অতিক্রম করতেও এসব লোকাল বাস এক-দেড় ঘণ্টা সময় নিত। ফলে সেসব লোকাল বাসের প্রতি মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই বীতশ্রদ্ধ ছিল। এ বাস্তবতাতে বিকল্প হিসেবে অটোরিকশা চালু হওয়ায় মানুষ এগুলোই বেছে নেয়। একটা অটোরিকশায় চার থেকে পাঁচজন যাত্রী ওঠে। পথে না থামার কারণে দ্রুত গন্তব্যে পেঁাছায়। বিশেষ করে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের পারিবারিক যানবাহন হিসেবে সিএনজিচালিত অটোরিকশাই প্রধান হয়ে উঠেছে।
একমাত্র হাটিকুমরুল থেকে বনপাড়া হয়ে নাটোর মহাসড়ক ছাড়া দেশের আর কোনো মহাসড়কের সঙ্গে নিম্নগতির যানবাহন চলার জন্য সাবওয়ে বা বিকল্প সড়ক নেই। ফলে চট্টগ্রাম, পাবনা, রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, কুমিল্লা, সিলেট প্রভৃতি জেলা শহর থেকে মহাসড়ক ব্যবহার না করে অনেক উপজেলা শহরে যাওয়ার সুযোগই নেই। এসব ক্ষেত্রে মহাসড়কে হঠাৎ করে ছোট যানবাহন চলাচল বন্ধ হলে জেলা শহরের সঙ্গে উপজেলার মানুষের যাতায়াতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলা চেয়ারম্যান এসএম আল মামুন বলেন, বিকল্প সড়ক না থাকার কারণে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কঠিন হবে। যেমন সীতাকুণ্ডের সঙ্গে চট্টগ্রামের যোগাযোগের জন্য ৩২ কিলোমিটার মহাসড়ক ব্যবহার অপরিহার্য, এ এলাকার মানুষও অটোরিকশার ওপর নির্ভরশীল। চট্টগ্রামের অটোরিকশা-অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ বলেন, সারাদেশে কয়েক লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা অটোরিকশার ওপর নির্ভরশীল। মহাসড়কে না চললে অনেক জায়গায় অটোরিকশা চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে জীবন-জীবিকার সংকটে পড়বে অসংখ্য চালকের পরিবার।
সড়ক দুর্ঘটনা কি সত্যিই কমবে? :যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়ক কিংবা মহাসড়কে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ চালকদের বেপরোয়া আচরণ। বিশেষ করে বিপজ্জনক ওভারটেকিং এবং একাধিক গাড়ির মধ্যে পাল্লা দেওয়ার প্রবণতা থেকেই দুর্ঘটনা ঘটছে বেশি। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, গত ঈদের আগে শুধু সিএনজি অটোরিকশার সঙ্গে বাসের সংঘর্ষ হয়নি, দুই বাসেরও মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে সিরাজগঞ্জে।
একটি বাস বেপরোয়া ওভারটেক করতে গিয়ে দ্রুত লেন পরিবর্তন করতে গিয়েই দুর্ঘটনা ঘটে। চালকদের এ ধরনের আচরণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে কে? তিনি বলেন, মহাসড়কে স্বল্পগতি এবং উচ্চগতির যানবাহন একসঙ্গে চলাটা বিপজ্জনক। এ কারণে সরকারি সিদ্ধান্ত ইতিবাচক, কিন্তু যে কোনো সিদ্ধান্তই বাস্তবতা বিবেচনা করে নিতে হবে, একদিকে বিপদ কমাতে গিয়ে আর একদিকে দুর্ভোগ যেন না বাড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্ল্যা বলেন, দেশে দুর্ঘটনা কমাতে হলে মহাসড়কে অটোরিকশা, নছিমন-করিমনের মতো যানবাহন চলাচল বন্ধ করতেই হবে, এর বিকল্প নেই। কারণ মহাসড়কে এসব যানবাহন কোনো নিয়ম মানে না, যত্রতত্র গাড়ি ঘুরিয়ে দুর্ঘটনার সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, চালকদের বেপরোয়া আচরণই একমাত্র সমস্যা নয়। দুর্ঘটনার বড় কারণ মহাসড়কে ছোট ছোট যানবাহন চলাচল বেড়ে যাওয়া। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা গেলে দুর্ঘটনা কমবে, দুর্ভোগও কমবে।
![](https://amaderkonthosor.com/wp-content/uploads/2024/06/cats6-1.jpg)
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
![](https://amaderkonthosor.com/wp-content/uploads/2024/07/1-62-622x350.jpg)
রাজধানীতে আনসার ব্যাটালিয়ন মোতায়েন
ঢাকা মহানগরীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৬ প্লাটুন আনসার ব্যাটালিয়ন সদস্য মোতায়েনবিস্তারিত পড়ুন
![](https://amaderkonthosor.com/wp-content/uploads/2024/07/1-55-622x350.jpg)
ঢাবি বন্ধের সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগে ধন্যবাদ জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হল ছেড়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদেরবিস্তারিত পড়ুন
![](https://amaderkonthosor.com/wp-content/uploads/2024/07/1-54-622x350.jpg)
রাজধানীতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষে সাংবাদিকসহ আহত ২৩
রাজধানীতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষে ছাত্রলীগ, শিক্ষার্থী, মহিলা আওয়ামী লীগবিস্তারিত পড়ুন