একজন সাদা মনের আসাধাণ মানুষের গল্প, মহাসমুদ্রের ঔদার্য্যের পুরোটাই হৃদয়ে ধারণ করেছেন….
ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক মানে বিরাট ব্যাপার। ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়ক ফ্র্যাংক ওরেল থেকে শুরু করে কত বড় বড় নাম… আমি স্যার ওরেলের উত্তরাধিকারী। এটা অনেক বড় সম্মান। ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক মানে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটের গৌরবময় ঐতিহ্যের জিম্মাদার। এটা এত বড় একটা দায়িত্ব যে, আমি এর জন্য জীবন দিয়ে দিতে পারি।”
এক.
সাগর পাড়ের মানুষ তিনি। সুবিশাল মহাসমুদ্রের ঔদার্য্যের পুরোটাই হৃদয়ে ধারণ করেছেন। বন্ধু-শত্রু নির্বিশেষে বুকে টেনে নেন, প্রায়ই চওড়া এক হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে রাখেন আইডি কার্ডের মতো। আমুদ-আহ্লাদে উপভোগ করেন জীবনের কঠিন-বিপদ সংকুল সময়গুলোও।
তিনি সেন্ট লুসিয়ার প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার, প্রথম টেস্ট ক্রিকেটার। এবং প্রথম অধিনায়ক তো বটেই!
পূর্ব ক্যারিবীয়ান সাগরপাড়ে অবস্থান সেন্ট লুসিয়া দ্বীপদেশটির। পড়শী বার্বাডোজ উড়ালপথে মাত্র ৪৫ মিনিটের যাত্রা। অথচ কী আশ্চর্য দেখুন, যেখানে বার্বাডোজ থেকে বিশ্বক্রিকেট পেয়েছে শ্রেষ্ঠ সব ক্রিকেটার, সেখানে সেন্ট লুসিয়া থেকে তিনিই ছিলেন প্রথম ক্রিকেটার, তাও আবার ২০০৪ সালে!
ফরাসী উপনিবেশই নাকি ছিল এর কারণ। তবে তাকে দেখে এখন আর সেখানে যে সে অবস্থা নেই, তা তো বুঝতেই পারছেন। ছোট্ট দ্বীপদেশটির জাতীয় নায়ক তিনি। তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছে ক্রিকেট স্টেডিয়াম। ক্যারিবিয় সাগর থেকে সোবার্স, লারা, মার্শাল… কত গ্রেট উঠে এসেছেন। কিন্তু একটা গোটা স্টেডিয়ামের নাম রাখা হয়েছে শুধু দুজনের নামে। একজন অ্যান্টিগায় স্যার ভিভ রিচার্ডস, আরেকজন ড্যারেন স্যামি। নিজের নামে স্টেডিয়ামে খেলে ম্যাচসেরাও হয়েছেন স্যামি, আর কটা ক্রিকেটারের সেই সৌভাগ্য হয়েছে?
এক জীবনে এর চেয়ে সম্মানের আর কি পেতে পারতেন তিনি?
স্যার ফ্র্যাংক ওরেল ছিলেন ক্যারিবীয়ান ক্রিকেটের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়ক। আর তিনি স্বদেশ থেকে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের প্রথম প্রতিনিধি।
দুই.
বিশ্বক্রিকেট তাকে চেনে ‘স্মাইল ম্যান’ নামে। মুখে সদা লেপ্টে থাকে ঝকঝকে দাঁতের দিলখোলা হাসি। খেলোয়াড়ী সত্ত্বার সাথে আমুদে সত্ত্বার মিশ্রণ ঘটিয়ে অনন্য এক ব্যক্তিত্বে রুপান্তরিত হয়েছেন তিনি। যে ব্যক্তিত্ব, এই তিল পরিমাণ ছাড় না দেয়া মানসিকতার যুগে তাকে নিয়ে গেছে অন্য এক উচ্চতায়।
ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্টেই পেয়েছিলেন সাত উইকেট। কিন্তু ধারাবাহিকতার অভাবে দ্রুতই দলে প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে ফেলেছিলেন। না ব্যাটসম্যান, না বোলার টাইপ হয়ে পরিচয় সংকটেও হয়তো ভুগছিলেন। সেই সংকট থেকে তাকে উদ্ধার করলো, তাঁর ওই অনন্য ব্যক্তিত্ব।
ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটের প্রতি তাঁর নিবেদনটাও সবসময় স্বার্থহীন, নিখাদ। সতীর্থরা যখন সবাই খেলতে অস্বীকৃতি জানাল, তখন তিনি এলেন ত্রাতা হয়ে। সাত অভিষিক্তের ম্যাচে সহ-অধিনায়ক হয়ে যথা সম্ভব চেষ্টা করলেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের সম্মান রক্ষার। পারেননি। সেবার বাংলাদেশের বিপক্ষে দুটি টেস্ট ও তিনটি ওয়ানডেতেই হেরেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দুটি টেস্টে দু’বার করে পাঁচ উইকেট নিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারেননি তিনি।
টেস্ট অভিষেকেও নিয়েছিলেন সাত উইকেট
পরের বছর পূর্ণ অধিনায়কত্ব পেয়েছিলেন। প্রায় সতেরো ম্যাচ ও সাতাশ মাস পর এনে দিয়েছিলেন দারুণ এক টেস্ট জয়। স্লো ইনসুইঙ্গিং মিডিয়াম পেস দিয়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই জয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি, হয়েছিলেন ম্যাচসেরা।
“যখনই সুযোগ পেয়েছি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছি।” অকপটে জানিয়েছিলেন তিনি। সত্যিকার অর্থেই তিনি ক্যারিবীয়ান ক্রিকেটের ঐতিহ্যের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিতে প্রস্তুত ছিলেন, যে কোন সময়, যে কোন মুহূর্তে।
তিন.
ছয় বলে ১২ রান দরকার। সময়ের সেরা স্লগ ওভার বিশেষজ্ঞ জেমস ফকনার বোলিং করছেন। স্যামি ব্যাটিংয়ে। প্রথম বলে সহজ সিংগেল এড়িয়ে গেলেন, ওপ্রান্তে ১২ বলে ২৭ রান করা ডোয়াইন ব্রাভো থাকা সত্ত্বেও। পরের বলও ডট। আর তার পরের দুই বলে দুই ছয়ে ম্যাচের শেষ ঘোষণা করলেন স্যামি। এভাবে কেন শেষ করলেন তিনি? কেন সহজ সিংগেলটা নিলেন না?
“খেলার আগে অনেক কিছু বলা যায়। কিন্তু করে দেখাতে হয় খেলার মাঠে। আমরা সেটা করে দেখিয়েছি। আমার মনে হয় ফকনার আমাদের আর একদমই পছন্দ করবে না।” ম্যাচ শেষ করে ফকনারের ‘আমি ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের পছন্দ করি না’ কথাটার জবাবে বলেছিলেন স্যামি।
অগোছালো, নড়েবড়ে একটা দলকে দিনের পর দিন অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন ওই অদম্য মনোবল দিয়েই। ক্যারিবীয়ানের নানা প্রান্ত থেকে উঠে আসা ছেলেগুলোকে এককাট্টা করার কঠিন ব্রতে লিপ্ত হয়েছিলেন তাঁর মতো করেই। তাই প্রেমাদাসায় শ্রীলংকান শোকগাঁথায়, গ্যাংনাম-উচ্ছ্বাসে উল্লসিত দলটির নেতা ছিলেন তিনিই। তেত্রিশ বছর পর বিশ্ব আসরে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে গৌরবান্বিত করেছিলেন। ক্যারিবীয়ান ক্রিকেটের মহান ঐক্যকে সবার উর্ধ্বে তুলে ধরে, গেইল-স্যামুয়েলসদের নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পতাকার জন্য লড়াই করেছেন, সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেনও। ঠিক যেন স্যার ওরেলের মতো। সতীর্থদের হৃদয় নিংড়ে বের করে এনেছেন সেরাটা।
এবারের বিপিএলেও ছড়িয়েছেন মুগ্ধতা
চার.
“নিজে হৃদয় দিয়ে খেলব এবং সবার জন্য এমন এক অবস্থা তৈরী করবো যেন তাঁরা সেরা খেলাটা খেলতে পারে।” এমনই সহজ সরল দর্শন স্যামির।
তাই যেসব খেলোয়াড়দের দ্রোহের সুযোগে তিনি দলে সুযোগ পেয়েছিলেন, তাঁরাই তাঁর অধীনে খেলেছে কোন সমস্যা ছাড়াই। তিনি গেইলের সাথে গ্যাংনাম-জোয়ারে ভেসেছেন, ব্রাভোর সাথে মেতেছেন ‘চাম্পিয়ন’ উৎসবে। ব্রাভোদের সমস্যা হয়নি, তাঁর সাথে। তিনিও সুযোগ দেননি কোন ঝামেলার। তাঁর অধীনে এক সুখী পরিবার গড়ে তুলেছিলেন। সেজন্যেই হয়তো, বোর্ডের ন্যুনতম সহযোগিতা না পেয়েও নন্দন কাননে ‘চাম্পিয়ন-ফুল’ হয়ে ফুটেছিল তাঁর দল। একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে দু’দুবার ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত আসরের বিশ্বসেরার মুকুট মাথায় পড়েছেন।
যোগ্য নেতার মতোই সতীর্থদের পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের সমস্যার সমাধান চেয়েছেন। পরের ম্যাচ খেলতে পারবেন কি পারবেন না, তা না ভেবেই নির্মম সত্যিটা অকপটে তুলে ধরেছেন। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের পরেই অর্থ;ইপ্সু বোর্ডকে চাবুক মেরেছিলেন। সেটার জন্যই তাঁকে মূল্য দিতে হয়েছে অধিনায়কত্ব হারিয়ে। তবে নতমস্তকে নয়, মাথা উঁচু করেই, বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক হিসেবে।
তিনি যে গৌরবময় ঐতিহ্যের জিম্মাদার। সেই ঐতিহ্য যে শির উন্নত রাখার শিক্ষাই তাকে দিয়েছে।
পাঁচ.
গত কুড়ি বছরে তাঁর অধীনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ(সবচেয়ে বেশী লারার অধীনে ১০টি) আটটি টেস্ট জিতেছে। দুটি টি-টোয়েন্টি শিরোপা জিতেছে।
টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি সব ধরণের ক্রিকেটেই তাঁর স্ট্রাইক রেট একশ’র উপরে হলেও, ব্যাটিং-বোলিং রেকর্ড বড্ড সাদামাটা। তাঁর অধিনায়কত্ব নিয়ে স্যার ভিভদের মতো মহা তারকারা প্রায়শই সমালোচনা করেছেন। অনেকে বলেছেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুরবস্থা বোঝাতে স্যামিকে দেখলেই হয়। তাঁর মতো একজন দলটির দলপতি! মার্ক নিকোলাস তাঁর দলকে বলেছেন নির্বোধের আখড়া।
এসবে কিছু যায় আসে না তাঁর। তিনি শুধু খেলাটিকে উপভোগ করেন। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটের ঐতিহ্যকে লালন করেন। ক্যারিবীয়ান সাগর পাড়ের উচ্ছ্বলতা হৃদয়ে ধারণ করেন। ক্যারিবীয়ান সাগর পাড় থেকে বঙ্গোপোসাগর পর্যন্ত ছড়িয়ে দেন উপভোগ-মন্ত্র। এই তো কদিন আগে, বাংলাদেশে এসেও রাজশাহী কিংসের হয়ে ছড়িয়ে গেছেন সেই মন্ত্র। যে রাজশাহীকে টুর্নামেন্টের শুরুতে তেমন কেউ গোনায় ধরেনি, তাদেরকেই নিয়ে গেছেন বিপিএলের ফাইনালে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো এই রাজশাহীও তো স্যামির দলই!
তাই একজন ড্যারেন স্যামিতে মুগ্ধ হন, মিরাজ থেকে ফ্র্যাংকলিন, আট থেকে আশি সবাই। তিনি বিনোদনের ফেরীওয়ালা। বিনোদিত করে চলেন ক্রিকেটকে, ক্রিকেটের দর্শকদের। চূড়ান্ত ভদ্রতার মোড়কে সর্বোচ্চ প্রতিদ্বন্দ্বিতার যে দীক্ষা স্যার ওরেল দিয়েছিলেন, সেটাকে মনে-প্রাণে ধারণ করে প্রয়োগ করেন ক্রিকেট মাঠে কিংবা মাঠের বাইরে।
ড্যারেন জুলিয়াস স্যামি যে স্যার ফ্র্যাংক ওরেলের উত্তরসূরী। ক্রিকেট-মানবতার মহান শিষ্য তিনি হবেন না তো, কে হবেন?
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
চা কন্যা খায়রুন ইতিহাস গড়লেন
চা শ্রমিকদের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে সব মহলেই পরিচিত হবিগঞ্জেরবিস্তারিত পড়ুন
চার্জ গঠন বাতিল চেয়ে রিট করবেন ড. ইউনূস
শ্রমিক-কর্মচারীদের লভ্যাংশ আত্মসাতের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড.বিস্তারিত পড়ুন
ড. ইউনূসের মন্তব্য দেশের মানুষের জন্য অপমানজনক : আইনমন্ত্রী
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, কর ফাঁকি দেওয়ার মামলাকে পৃথিবীর বিভিন্নবিস্তারিত পড়ুন