এক বীরাঙ্গনার কথা
পাইকগাছা উপজেলার দেলুটিয়া ইউনিয়নের একটি গ্রাম ফুলবাড়ি। এ গ্রামের গুরুপদ মণ্ডল পেশায় দর্জি হলেও সৎ ও পরোপকারী স্বভাবের জন্য সবার কাছে ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র। ২ ছেলে ও ২ মেয়ে আর স্ত্রী গুরুদাসী মণ্ডলকে নিয়ে ছিল তার সুখের সংসার। ১৯৭১ সালে রাজাকার আর পাকবাহিনীর রোষানলে গুরুপদ মণ্ডলের সুখের সংসার ছারখার হয়ে যায়। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাস। এ সময় সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকহানারদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছে। একদিন ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই এদেশীয় রাজাকারদের ইন্ধনে পাকহানাদার বাহিনী গুরুপদ মণ্ডলের বাড়িতে হামলা চালায়। একে একে পরিবারের সব সদস্যকে বাড়ির উঠানে জড়ো করা হয়। তার সুন্দরী স্ত্রী গুরুদাসী মণ্ডলের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি পড়ে পাকসেনাদের।
স্ত্রীর সম্ভ্রম রক্ষা করতে এগিয়ে এলে গুরুদাসীর সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয় তার স্বামী, বড় ছেলে অংশুপতি, ছোট ছেলে খোকন ও বড় মেয়ে অঞ্জলিকে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাদের মৃতদেহ বীভৎস করে দেওয়া হয়। এরপর কোলের শিশুকন্যা পারুলকে মাতৃক্রোড় থেকে কেড়ে নিয়ে বাড়ির পাশে কাদায় পুঁতে গুলি করে হত্যা করার পর গুরুদাসী জ্ঞান হারায়। তারপর রাজাকাররা গুরুদাসীকে বটিয়াঘাটার বারআড়িয়া রাজাকার ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। এই ক্যাম্পে নির্বাক নিঃসঙ্গ গুরুদাসীকে তারা পালাক্রমে প্রতি রাতে ধর্ষণ করত। গুরুদাসীকে পরিণত করেছিল যৌনকর্মীতে। স্বামী-সন্তানদের বিভীষিকাময় মৃত্যু আর নিজের ওপর প্রচ- পাশবিক নির্যাতনে পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন গুরুদাসী। গুরুদাসী তখন উন্মাদিনী। তাকে বেশ কিছুদিন এই ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নির্যাতনের এক মূর্তপ্রতীক হয়ে আছে গুরুদাসী মণ্ডল।
অবশেষে এলো ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাস। বটিয়াঘাটা থানার মুজিববাহিনীর কমান্ডার বিনয় সরকারের নেতৃত্বে বারআড়িয়া রাজাকার ক্যাম্প দখল করে মুজিববাহিনী। এই ক্যাম্প দখলে যুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ হন জ্যোতিষ ও আজিজ নামে খুলনার দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধারা গুরুদাসীকে অর্ধমৃত ও বেআব্রু অবস্থায় উদ্ধার করে নিয়ে যায় তাদের ক্যাম্পে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী খুলনার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কাইয়ুম বলেন, ‘ক্যাম্প দখলের পর আমরা যখন সবাই লঞ্চে উঠেছি তখন গুরুদাসী কাঁদতে কাঁদতে আমাদের লঞ্চে এসে ওঠে। তখন তার দুরবস্থার কথা ভেবে আমরা তাকে গ্রহণ করি।’
প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে কিছুদিন পর সাময়িকভাবে সুস্থ করা গেলেও গুরুদাসী ছিলেন প্রাণহীন পাথরের মূর্তি। দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন পর মুক্তিযোদ্ধারা তাকে নিয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধকালীন খুলনা জেলা কমান্ডার শেখ কামরুজ্জামান টুকুর আশ্রয়ে। সেখানে গুরুদাসী কিছুদিন অবস্থান করেন।
মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে গুরুদাসী ছুটে বেরিয়ে পড়তেন খুলনা শহরের অলি-গলিতে। হয়ত হাজারো মানুষের ভিড়ে খুঁজে ফিরতেন তার হারিয়ে যাওয়া চেনা মুখগুলো। কিছুদিন পর গুরুদাসী ঘুরতে ঘুরতে চলে আসে স্বামী-সন্তানের স্মৃতি বিজড়িত খুলনার পাইকগাছায়। পাইকগাছা-কপিলমুনির পথে পথে ঘুরতে থাকেন উদ্দেশ্যহীনভাবে। দেশ স্বাধীনের পর গুরুদাসীর খবর আর কেউ রাখেনি। সব হারিয়েছেন যে দেশের জন্য, সেই দেশ গুরুদাসীর যথাযথ মর্যাদা দিতে পারেনি। মানসিক ভারসাম্যহীন গুরুদাসী ভিক্ষা করে জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যান। এভাবে গুরুদাসীর দিন কাটতে থাকে। তিনি হয়ে ওঠেন এলাকার সবার কাছের মানুষ, পরিচিত মুখ। কোথাও এক মুহূর্ত বসতেন না তিনি। সারা দিন হাঁটাই ছিল তার কাজ। কখনো কখনো আনমনা হয়ে যেতেন। তখন কেউ সামনে এলে জিজ্ঞেস করতেন ‘কবে বিচার পাবেন’। সবার কাছে তিনি ‘মাসি’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তবে খুলনার মুক্তিযোদ্ধারা তাকে ‘মা’ বলে ডাকতেন।
এরপর মুক্তিযুদ্ধকালীন খুলনা জেলা কমান্ডার শেখ কামরুজ্জামান টুকুর সার্বিক সহযোগিতায় খুলনা মহকুমা কমান্ডার ও তৎকালীন পাইকগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট স ম বাবর আলী, পাইকগাছা থানা কমান্ডার শেখ শাহাদাত হোসেন বাচ্চু, শেখ বেলাল উদ্দিন বিলু এবং অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তৎকালীন পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিহির কান্তি মজুমদারের মাধ্যমে গুরুদাসীর স্থায়ী বসবাসের জন্য কপিলমুনি বাজারে সরকারি জায়গায় একটি কুঁড়েঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়। এছাড়া গুরুদাসীর নামে ১০ হাজার টাকা ব্যাংকে ‘ডিপোজিট’ করা হয়; যাতে ওই টাকার লভ্যাংশ দিয়ে তিনি দিনাতিপাত করতে পারেন। ১৯৮৭-৮৮ সালে পাইকগাছা উপজেলা পরিষদের অনুদানে মুক্তিযোদ্ধাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গুরুদাসীর কুঁড়েঘরটি পাকা করে দেওয়া হয়। গুরুদাসীর মা তখন জীবিত ছিলেন। গুরুদাসীর দেখাশোনার জন্য তাকে নিয়ে এসে রাখা হয় তার সঙ্গে। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি গুরুদাসীর সঙ্গেই বসবাস করতেন।
সমাজের কাছে অনেক প্রশ্ন রেখে গুরুদাসী মণ্ডল ২০০৮ সালের ৭ ডিসেম্বর ভোর রাতে কপিলমুনিতে নিজ বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গুরুদাসীর জীবনের শেষ সময় বসবাসের জন্য কপিলমুনির ছোট ঘরখানি আজ অযত্নে-অবহেলায় পড়ে আছে। একদিন হয়ত ওই ঘরের সঙ্গে মুছে যাবে গুরুদাসীর শেষ চিহ্নও। তাই এই মহতী বীরাঙ্গনার স্মৃতি রক্ষার জন্য মৃত গুরুদাসীকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া আবশ্যক।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
চা কন্যা খায়রুন ইতিহাস গড়লেন
চা শ্রমিকদের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে সব মহলেই পরিচিত হবিগঞ্জেরবিস্তারিত পড়ুন
চার্জ গঠন বাতিল চেয়ে রিট করবেন ড. ইউনূস
শ্রমিক-কর্মচারীদের লভ্যাংশ আত্মসাতের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড.বিস্তারিত পড়ুন
ড. ইউনূসের মন্তব্য দেশের মানুষের জন্য অপমানজনক : আইনমন্ত্রী
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, কর ফাঁকি দেওয়ার মামলাকে পৃথিবীর বিভিন্নবিস্তারিত পড়ুন