এটাই কি ভালোবাসা?
বিয়ের পর পরই তুলিকে নিয়ে উঠি আজিমপুর কলোনীতে এক ফ্যামিলির সাথে সাবলেটে এক বাসায়। ছোট্ট একটা রুম, দুপাশে দুটো জানালা, মলিন দেয়াল, রঙচঙা এক দরজা। বাসায় একমাত্র জিনিস বলতে ছিল একটা আয়না দেয়ালে সাঁটানো, তাও ছিল ঘোলা, নিজের চেহারা ভালো করে দেখা যায় না। উত্তল লেন্সের মতো ঐ আয়নায় তাকালে চেহারা বেঢপ আকৃতি ধারণ করত। আমি ছাপোষা মানুষ, কাওরান বাজারে এক কোম্পানিতে টাইপরাইটার তখন, বেতন অতি সামান্য, সাড়ে চার হাজার টাকা, যা দিয়ে একজনেরই চলে না আবার দুজন! আমি আসলে এ অবস্থায় বিয়ে করতে চাই নি, তুলির বাসা থেকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে, আমাকে তাদের তেমন একটা পছন্দ নয়, বেতন কম বলে এবং সামাজিক অবস্থানে অনেক ছোট তাই। ওদিকে সে তার বাবার বিশাল অর্থসম্পদ ছেড়ে আমার সাথে গাছতলায় থাকতেও রাজি! আমি বিয়ের আগে পশ্চিম রাজাবাজারে এক মেসে থাকতাম, বিয়ে করে তো আর বউ নিয়ে মেসে থাকা যায় না। আর মাসের মাঝামাঝিতেও হুট করে বাসা পাওয়া যায় না, এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে ঠাঁই হলো আজিমপুর কলোনীতে।
বাসায় উঠার পর দুদিন পর্যন্ত আমরা মাটিতে আমার আগের মেসের সিঙ্গেল তোষকে চাপাচাপি করে ঘুমালাম। সংসারের জন্যে তেমন কিছুই নাই যার যার কাপড় চোপড় ছাড়া, অনেক কিছু কেনাকাটা দরকার। টাকা পয়সার তখন খুব সংকট, বেতনের টাকা বিয়ের খরচাপাতিতেই চলে গেছে। বিয়েতে খরচাপাতি বলতে তেমন কিছুই না, কাবিন-কাজী আর যাতায়াতের খরচ সামান্য। বিয়ে করছি তাই স্ত্রীকে একটা নতুন শাড়ি পরানো দরকার। তুলির কাছে অবশ্য দুটো শাড়ি ছিল তার নিজস্ব। কিন্তু পুরোনো শাড়ি কী আর বিয়ের দিনে পরানো যায়? বিবেকে বাঁধল আমার তাই রাজনকে নিয়ে গিয়ে বঙ্গবাজার থেকে সস্তায় একটা জর্জেটের নীল শাড়ি কিনে নিয়ে আসি, দাম পড়েছিল সাড়ে পাঁচশ টাকা। বিয়ের শাড়ি হওয়া উচিত লাল, জামদানী কিন্তু কেন যে আমি নীল শাড়ি কিনি তখন তা নিজেও বুঝতে পারি নি। মার্চ মাসের এক শুক্রবারে বাদ জুম্মা আমাদের বিয়ে হয়ে গেল তিনবার কবুল বলে। তুলি ঝটপট কবুল বলে ফেললেও তখন তার চোখে পানি ছিল, টপটপ করে পড়ছিল তার শাড়ির উপর। আমি পাশের চেয়ারে বসে তা দেখছিলাম, কবুল বলার সময় আমি কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম, মাথার উপর কেমন যেন অনেক বড় দায়িত্ব অনুভব করলাম। এতদিন একা ছিলাম, একার দায়িত্ব থাকে না কিন্তু যে মেয়ে আরাম আয়েশের জীবন ছেড়ে আমার মতো বাউন্ডুলের কাছে এসেছে তার জন্যে অনেক দায়িত্ব থেকে যায় আমার।
তুলির বাসায় যখন বিয়ের আলাপ চলছিল তখন একদিন হুট করে সে আমার অফিসে এসে হাজির। এর আগে কখনও তাকে আমার অফিসে নিয়েও আসি নি কিংবা সেও আসে নি। তাকে হঠাত্ দেখে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম, কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি তাকে অন্য কোন কিছু জিজ্ঞেস না করে প্রথমেই জিজ্ঞেস করি, ‘সকালে নাস্তা খাও নি বুঝি? মুখটা অনেক শুকনো দেখাচ্ছে তো।’
সে আমার প্রশ্নের ধার না ঘেঁষে বলল, ‘শফিক, আমি বাসা থেকে চলে এসেছি তোমার কাছে, বিয়ে করব, আমাকে বিয়ে করবে?’
আমার চোখ তখন কপালে উঠে গিয়েও উঠল না কারণ আমি জানতাম এমন কিছু একটাই হবে যেহেতু তার বাসায় বিয়ের আলাপ আসছে অনেকদিন ধরে এবং সে একটার পর একটা পাত্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিচ্ছে। আমি পিয়ন সোহাগকে ঢেকে এক গ্লাস পানি আনিয়ে ঢকঢক করে গিলে ফেললাম একটানে। তাকে বলে দিলাম যেন বাইরে থেকে দুটো সিঙ্গারা আর একটা কোলা নিয়ে আসে। তুলি সেসব পাত্তা না দিয়ে বলল, ‘কী হলো! বলছো না কেন বিয়ে করবে কিনা?’
আমার মাথায় তখন হাজারো চিন্তা, তখনও বেতন পাই নি মাসের। মাসোয়ারা পেলে পরে বাড়িতে কিছু পাঠাতে হবে মায়ের চিকিত্সার জন্যে, শরীরটা তার খারাপ যাচ্ছে অনেকদিন ধরে। ছোট বোন অনেকদিন ধরে বায়না ধরেছে তাকে একটা দামী ঘড়ি কিনে দিতে হবে শহর থেকে। বাবাকে জানানোর দরকার বিয়ে করছি যে কিন্তু এত তাড়াতাড়ি জানানো কিভাবে সম্ভব! একটা আর্জেন্ট টেলিগ্রাম করতে হবে। বাবা নিশ্চয়ই টেলিগ্রামের অর্থোদ্ধার করতে না পেরে চিন্তিত হয়ে পড়বেন। তাছাড়া বিয়ে করে বউ নিয়ে থাকব কোথায়, মেসে থাকা সম্ভব না, টাকা পয়সাও নাই। তার চেয়ে বড় কথা, তুলি আমাকে বিয়ে করতে চাইছে কেন? আমাদের মধ্যে কি প্রেম ছিলো? আমরা তো কখনও ভালবাসাবাসির কথা বলি নি। মনে হয় না তখনও কোন দিন হাত ধরেছিলাম কিনা। একবার বোধহয় তার হাতে আমার হাত লেগেছিল ভীড়ের মধ্যে, আমি সবসময় তার সাথে আমার স্পর্শ বাঁচিয়ে রেখে চলতাম। তবে একটা জিনিস বুঝতাম সে আমাকে পছন্দ করে, তার চোখের দিকে তাকালে বুঝতাম সে আমাকে ভালবাসে, সবসময় কাছে থাকতে চায়। আমি যে তাকে চাইতাম না এটা কিন্তু না, তার কাজল মাখা চোখে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগত, সরাসরি সবসময় তাকাতে পারতাম না তাই চোরা চোখে তাকাতাম। সে যখন কথা বলত আমি ঠিক তাকিয়ে থাকতাম তার ডানপাশে উপরের পাটির গ্যাঁজা দাঁতের দিকে, কখনও বা তা ঠোঁটের নিচের ছোট্ট তিলের দিকে। এটাকে ভালবাসা বলে কিনা জানি না। যদি ভালবাসা হয় তাহলে তাকে আমি অনেক ভালবাসতাম, মাঝে মাঝে তার জন্যে বুকে অনেক হাহাকার জন্মাত, একা একা শূণ্যতা অনুভব করতাম।
তুলিকে সেদিন কোনমতে বুঝিয়ে বাসায় পাঠালাম এই বলে যে, আমার দুটোদিন সময় দরকার, হুট করেই বিয়ে করা যায় না। সামনের শুক্রবারে যেন সে তার সবকিছু নিয়ে চলে আসে। শুক্রবার সকালে সে তার বাবামাকে বলে চলে আসে, তার মা কান্নাকাটি করলেও তার বাবা শক্ত গলায় বললেন, ‘নিজের সুখ যখন নিজেই খুঁজে নিয়েছো তো কী আর করা! আমাদের চিন্তা করতে হবে না। আর বাসা থেকে চলে যাচ্ছো ভালো কথা, দ্বিতীয়বার যেন বাসায় ফেরার কথা মাথায় না আসে।’ চোখের জলে নাকমুখ ভাসিয়ে তুলি এসে তখন হাজির হয়েছিল আমার মেসে।
বিয়ে উপলক্ষে অফিস থেকে দুসপ্তাহের ছুটি নিলাম, বস চশমার ফাঁক দিয়ে চোখ বাঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বিয়ে করে বউ পালবে কী করে এ বেতনের টাকায়?’
আমি তখন কিঞ্চিত মুচকি হেসে বললাম, ‘স্যার আমার এক খালা সাহস দিয়েছেন, তিনি বলেছেন, ‘সিগারেটের পয়সা আর বউ পালার পয়সা ভূতে জোগায়।’
তাই স্যার সাহস করে বিয়ে করে ফেলব।’
তিনি আমার রসিকতা আমলে না নিয়ে বললেন, ‘ক্যাশিয়ারকে বলে রাখব সামনের মাসে যেন তোমাকে বেতনের সাথে আরও পাঁচশ টাকা বাড়িয়ে দেয়। কতদিন হলো এখানে চাকরি করো?’
‘স্যার একবছর তিনমাস।’
দু সপ্তাহ ছুটির প্রথম সপ্তাহ কেটে গেল ব্যস্ততায়, কেনাকাটায়; বন্ধু জাকিরের কাছ থেকে হাজার তিনেক টাকা ধার করে ঢাকা কলেজের সামন থেকে কিনে ফেললাম একটা সেমিডাবল খাট। দুজন অনায়াসে ঘুমানো যাবে, তবে একটু চেপে ঘুমাতে হবে, ব্যাপার না সে তো আমার বুকেই ঘুমাবে। ব্যাপারটা খাট কেনার সময় চিন্তা করে লজ্জায় হেসে উঠলাম। নীলক্ষেত থেকে মশারি, পর্দা আর নিউমার্কেট থেকে হাড়িপাতিলসহ অনেক বাজার সদাই করে বাসায় ফিরে আমি অবাক হয়ে গেলাম। যে মেয়ে কখনও নিজে কষ্ট করে গ্লাসে পানি ঢেলে খায় নি সে কিনা পুরোদস্তুর গিন্নীর মতো শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে ঘর ঝাড়ু দিয়ে গোছগাছ করছে।
আমার কাছে ব্যাপারটা অনেক ভালো লাগলো, বুকের ভিতর কাঁপিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হলো যাক মেয়েটা তাহলে মানিয়ে নিতে পারবে। দুজন মিলে ঘরদোর সবকিছু পরিষ্কার করে সাজিয়ে নিলাম। ঘরের জন্যে যে পর্দা কিনে এনেছিলাম তা দরজা জানালায় লাগানোর পরেও একটা বিশাল অংশ বাকী রয়ে গেল। বুদ্ধিমতী তুলি সেটা ঘরের মাঝ বরাবর টাঙিয়ে একটা রুমকে দুই রুমে পরিণত করলো। খাটের চেয়ে তোষক ছোট হয়ে যাওয়ায় একদিনেই নীলক্ষেত থেকে পুরোনো তোষকটা ভাঙ্গিয়ে বড় করে নিয়ে আসলাম। পর্দার একপাশে খাট, মানে খাটটা পর্দার আড়ালে পড়ে থাকলো আর অপর পাশে ঘরের বাকী জিনিসপত্র। তখন ঘরে কোন আসবাবপত্র ছিল না শুধু আমার পায়াভাঙ্গা টেবিলটা ছাড়া।
রান্নাবান্নার কষ্ট এড়াতে প্রথম কয়েকদিন পাশের ফ্যামিলির সাথে যৌথভাবে খেলাম। ভাবী নিজ থেকেই উনাদের সাথে খেতে বলেছিলেন। একদিন হঠাত্ তুলি বলল, ‘মানুষের হাতের রান্না তোমাকে আর খেতে হবে না, কালকে বাজার করে নিয়ে আসবে, আমি রান্না করব।’ প্রথমদিনের রান্না মুখে দেওয়ার জো ছিল না তবুও কিছু না বলে মুখ হাসি হাসি রেখে খেলাম। সে বুঝতে পারল রান্না ভালো হয় নি। খাওয়ার পর এসে দেখি সে বিছানায় বসে নিঃশব্দে কাঁদছে, আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার কাঁদছো কেন?’
‘রান্না ভালো হয় নি, না? তাহলে খেলে কেন?’
আমি তার কাছে বসে আস্তে করে বললাম, ‘রান্না খারাপ হয় নি তো, তুমি যদি ধুতুরা ফুল এনে রান্না করে দাও, তাও আমি খেয়ে বলব, ভালো হয়েছে রান্না। কারণ তোমার রান্না খাওয়াতে একটা তৃপ্তি আছে।’
তার চোখের পানি মুছে দিতেই সে আমাকে জড়িয়ে ধরে আবার হোঁ হোঁ করে কেঁদে উঠলো, তার কান্না দেখে আমার চোখও ভিজে ঝাপসা হয়ে গেল।
বিয়ের পর এক সপ্তাহ ব্যস্ততায় কেটে গেলেও পর সপ্তাহে যেন সারাদিন বাসায় সময় কাটছিলো না। এক রাতে তাকে বললাম, ‘চল কোথাও থেকে ঘুরি আসি?’
সে চোখ পাকিয়ে বলল, ‘টাকা কোথায়?’
‘টাকার জন্যে চিন্তা করো না, ব্যবস্থা হবে। সেদিন অফিসের কলিগ মানিক সাহেবকে বলে এসেছি, বাড়িতেও কিছু টাকা পাঠাতে হবে। তিনি বলেছেন, গিয়ে টাকা নিয়ে আসতে।’
‘দরকার নাই যাওয়ার, শুধু শুধু টাকা নষ্ট। এটাকা থাকলে একটা আলনা কেনা যাবে, কাপড় এখনও ব্যাগে রাখার মতো জায়গা নাই।’
আমি তার কথা পাত্তা না দিয়ে বললাম, ব্যাগে কাপড় আছে সে তো ভালোই, কষ্ট করে ব্যাগ গোছাতে হবে না, পরশু সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে তৈরী হয়ে নিও।
মানিক সাহেবের কাছ থেকে টাকা এনে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে বাড়িতে টাকা পাঠালাম, একটা আলনা কিনলাম আর একটা বাঁশের র্যাক জিনিসপত্র রাখার জন্যে। সেদিন ছিল সোমবার নাহ মঙ্গলবার, সকালে উঠেই ট্রেনে রওনা দিলাম দুজনে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। বাসে রাস্তাঘাট ভালো না, অনেক সময় লাগে। আমার উদ্দেশ্য কক্সবাজারে যাওয়া। দিনে দিনে যাওয়ার জন্যে সকাল সকাল ট্রেনে উঠা, আর তার পরদিন ছিল পূর্ণিমা।
পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হলে গেল সেদিন, কলাতলীতে এক কলিগের পরামর্শমতো মোটামুটি দামী একটা হোটেলে রুম ভাড়া করলাম। ভেলভেটের শুভ্র চাদর ছড়ানো নরম গদির বিছানা, রুমের সাথেই লাগোয়া বাথরুমে আধুনিক সব সরঞ্জাম, ছোট্ট একটা বারান্দা আছে যা দিয়ে দূরে সমুদ্র দেখা যায়, বেশ মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। সারাদিনের জার্নিতে ক্লান্ত হয়ে সেদিনের মতো বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুম চলে আসলো।
পরের দিন সকালে নাস্তা করেই সমুদ্রে গেলাম, সমুদ্রে দুজনে ঝাপাঝাপি করলাম অনেকক্ষণ, ঘোড়ার উপরে চড়লাম দুজনে। ঘোড়ার উপরে সে ভয়ে আমার হাত চেপে ধরে রাখলো শক্ত করে। বারবার একটা কথাই মনে আসছিল, জীবন অনেক সুন্দর। স্মৃতিগুলো সেলুলয়েডের ফিতার ধরে রাখার জন্যে সমুদ্রতীরে ঘুর ঘুর করা একজন ক্যামেরাম্যান দিয়ে ছবিও তুলালাম, বেশ দাম নিয়ে নিল। দুপুরে রুমে ফিরে গোসল করে খেয়ে আবার সন্ধ্যার আগে আগে সমুদ্রে গেলাম।
সূর্যাস্তের সময় প্রফুল্ল মনে দুজনে ভাটার পানিতে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সে শাড়ি একটু তুলে রেখেছে যাতে পানিতে শাড়ি ভিজে না যায়। আমার চোখে তখন হঠাত্ পড়ল সে বিয়ের নীল শাড়িটা পড়ে এসেছে। আকাশী নীল শাড়ি, কাজলমাখানো চোখ, মায়াবী মুখে কনে দেখার আলো তার ছোট্ট তিলে পড়ে কেমন যেন চিক চিক করছে। আমার চোখ ভিজে এল, আমি কেঁদে দিলাম। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, ‘কী হয়েছে?’
‘কিছু না, চোখে মনে হয় কিছু পড়েছে’ মিথ্যেটা আসলে বলতেই হলো চোখের পানি মুছতে মুছতে।
রাতের বেলাটা ছিল আরও কয়েক ডিগ্রি বেশি আবেগের, দুজনে অনেকটা সময় বালিতে শুয়ে ছিলাম। ভাটার পানি এসে আস্তে আস্তে শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছিলো, হাত ধরে দুজনে শুয়ে শুয়ে হলদে চাঁদ উঠা থেকে শুরু করে পুরো জোছনা দেখছিলাম। আমার বুকে যখন সে মাথা রাখলো তখন মনে হচ্ছিল আমি হয়ত মারা যাব। পৃথিবীতে কোন লোকই হয়ত তীব্র সুখে এর আগে মারা যায় নি। তীব্র সুখের আবেশে বারবার আমার চোখের জল তার চুল ভিজিয়ে দিচ্ছিলো। আমি বারবার একটা জিনিসই চিন্তা করছিলাম, এত সুখ কেন? এত সুখ কেন? এতে সুখে যদি আমি মরে যাই? পর মূহুর্তেই চিন্তা করি, নাহ তাকে ছেড়ে মরতে পারব না। সারাটা জীবন এভাবেই তাকে বুকে আগলে ধরে রেখে বাঁচতে চাই।
ভুলেও যদি কখনও আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়
তখন আমি প্রাণপনে আরেকবার নিঃশ্বাস নিতে চেষ্টা করব
আরও একবার চোখ মেলে দেখতে চাইব তোমায়
তোমার ঐ কাজলকালো চোখ, গ্যাঁজা দাঁতের হাসিতে গালে টোলপড়া, ঠোঁটের পাশের ছোট্ট তিলটা।।
আমাকে বারবার দীর্নবিদীর্ন করে দেয়া তোমাকে আরও একটাবার দেখতে চাইব।
আচ্ছা এটাকে কি ভালবাসা বলে? না মৃত্যু?”
মধুচন্দ্রিমা সেরে ঢাকায় আসার পর আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আবার অফিসের কাজে। টাকাপয়সা অনেক ধার করে ফেলেছিলাম বিয়ের পরে, রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছিলাম সামলাতে গিয়ে। একদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে দেখি রুমে তুলি নেই, খানিকটা অবাক হলাম এমন তো হওয়ার কথা না, ও সবসময়ই বাসায় থাকে। পাশের রুমের ভাবীকে জিজ্ঞেস করায় জানতে পারলাম, সে নাকি টিউশনি নিয়েছে, বাড়িওয়ালার ছেলেমেয়েকে পড়াবে। কিছুটা রাগ হলেও বুঝতে পারলাম সে আমাকে অভাবের চিন্তা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যে সাহায্য করছে।
আসলে তখনকার দিনগুলো অন্যরকম ছিলো, প্রতিদিন সকালে অফিসে যাওয়ার সময় সে রান্না করে খাবার দিয়ে দিত টিফিন ক্যারিয়ারে। দুপুর বেলা অফিসের কলিগদের সাথে ঠাট্টা মশকরা করতে করতে তার হাতের রান্না খাওয়া হত। একদিন আচমকা জানতে পারলাম সে নাকি দুপুরে খায় না, রাতে তাকে কড়া করে জিজ্ঞাসা করার পর বলল, ‘তোমাকে ছাড়া আমি একা খেতে পারি না।’
আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলাম ওভাবেই। এরপর থেকে দুপুর বেলা বাসায় এসে খেয়ে যেতাম, দেরি হয়ে যায় অফিসে ফিরতে বলে মাসখানেক পর একটা বাইসাইকেলও কিনে নিয়েছিলাম। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার পরপরই সে একগ্লাস লেবুর শরবত দিত। রাতে খাওয়ার পর আমি এক কাপ চা খেতাম কড়া লিকারের আর বিলাসিতা হিসেবে ক্যাপস্টেন সিগারেট। প্রতিটা রাতে সে গুটলি পাকিয়ে আমার বুকের কাছে মাথা রেখে ঘুমাত, আমি সন্তর্পনে তার উপরে একটা হাত তুলে জড়িয়ে রাখতাম। মাঝে মাঝে ভয় হত আমার বুকের ধুকপুকানিতে কিনা তার ঘুম ভেঙ্গে যায় কিনা। তার ঘুমন্ত চোখের দিকে তাকিয়ে আমি জেগে থাকতাম অনেক রাত পর্যন্ত, ফ্যানের বাতাসে তার চুল এসে পড়ত মুখে, ভ্যান্টিলেটরের ফাঁক দিয়ে আসা স্ট্রিটলাইটের আলোতে আমি মোহাবিষ্টের মতো তাকিয়ে থাকতাম তার চোখে মুখে ঠোঁটে তবুও যেন তৃপ্তি মিটত না।
আমি চিরকাল চেয়েছিলাম এরকমই একজন সুনয়না
যার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি অমল বিশ্বাসে নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারি।
লেখক : আকিব আরিয়ান
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
চা কন্যা খায়রুন ইতিহাস গড়লেন
চা শ্রমিকদের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে সব মহলেই পরিচিত হবিগঞ্জেরবিস্তারিত পড়ুন
চার্জ গঠন বাতিল চেয়ে রিট করবেন ড. ইউনূস
শ্রমিক-কর্মচারীদের লভ্যাংশ আত্মসাতের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড.বিস্তারিত পড়ুন
ড. ইউনূসের মন্তব্য দেশের মানুষের জন্য অপমানজনক : আইনমন্ত্রী
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, কর ফাঁকি দেওয়ার মামলাকে পৃথিবীর বিভিন্নবিস্তারিত পড়ুন