ধর্মীয় স্বাধীনতার পক্ষে কানাডার আদালত !
কানাডার জাতীয় নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, নিকাব নিয়ে বিতর্ক যেন ততই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এই বছরের শুরুর দিকে জুনেরা ইসহাক নামে পাকিস্তানি এক অভিবাসী নারী নাগরিকত্বের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে নিকাব খুলে উপস্থিত হতে আপত্তি জানিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন। নিকাব নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত সেই থেকেই।
এ বছরের ফেব্রুয়ারির ৬ তারিখে কানাডার ফেডারেল কোর্ট এই মামলার নিষ্পত্তি করেন। আদালতের রায়ে বলা হয়, নিকাবের বিষয়ে সরকারি বাধ্যবাধকতা সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট বা নাগরিক আইনের পরিপন্থী। আদালত পর্যবেক্ষণ করেন, নাগরিকত্বের আবেদনকারীর যদি শপথ নেবার সময় মুখ বা ঠোঁটের সঞ্চালন দেখানো আবশ্যক হয়, তাহলে নাগরিকত্ব অর্জন শুধু নিকাবধারীর পক্ষেই অসম্ভব নয়, একইভাবে একজন বোবা ব্যক্তি বা নীরবতা পালনকারী সাধুর জন্য অসম্ভব হওয়ার কথা।
আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেন, সরকারি পলিসির নির্দেশনা মেনে যদি বিচারক নিশ্চিত করতে চান শপথ গ্রহণের সময় আবেদনকারীর মুখ অনাবৃত রয়েছে কিনা, তাহলে নাগরিকত্ব আইনে ধর্মীয় আনুগত্যের সঙ্গে শপথ নেবার যে সর্বোচ্চ স্বাধীনতার কথা আইনে রয়েছে, সেটি লঙ্ঘন করা হয়। আদালত উদাহরণ টেনে বলেন, একজন সাধু যদি নীরবতার কড়া সংযম পালন করেন এবং শপথ গ্রহণের সময় যদি তার সেই নীরবতা ভাঙতে বলা হয়, সেই ক্ষেত্রে বিচারক কীভাবে সেই সাধুর সর্বোচ্চ সম্ভব স্বাধীনতা (গ্রেটেস্ট পসিবল ফ্রিডম) নিশ্চিত করবেন। একইভাবে একজন বোবা আবেদনকারী, যে শারীরিকভাবে শপথ উচ্চারণ করতে অসমর্থ এবং যাকে শপথ উচ্চারণ করতে দেখা যাবে না, বিচারক তার ক্ষেত্রে কীভাবে আইনে প্রদত্ত আনুগত্যের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবেন?
আইনি কাঠামোর বাইরে সরকার প্রদত্ত আদেশের কারণে সিটিজেনশিপ বিচারকের পরিধির ওপর হস্তক্ষেপ হয়েছে কিনা, আদালত এই বিষয়টি বিস্তারিত খতিয়ে দেখেন। সরকার পক্ষ যদিও বলেন, এই আদেশ একটি নির্দেশনা মাত্র যেটি সিটিজেনশিপ বিচারকদের দেওয়া হয়নি। তারা এটি নাও মানতে পারেন।
অভিবাসী নারী তার আবেদনে যদিও সরকারের বিরুদ্ধে নাগরিক অধিকার সনদ (চার্টার রাইটস) ও একই সঙ্গে কানাডার বহু সংস্কৃতি আইন (মাল্টি কালচারাল অ্যাক্ট) লঙ্ঘনের প্রশ্ন উত্থাপন করেন, আদালত সেই বিষয়গুলোকে এই মামলার জন্য প্রযোজ্য নয় বলে মত দিয়েছেন।
শপথ গ্রহণকালে আবেদনকারীর আনুগত্যের সঙ্গে শপথ নেবার স্বাধীনতা রয়েছে এবং ধর্মীয় আনুগত্য লঙ্ঘন হয়, এমন কোনো আদেশ বা রুল সেই স্বাধীনতাকে খর্ব করে। কিন্তু নাগরিকত্ব আইনের বাইরে সরকারি আদেশ বলে চাপিয়ে দেওয়া কোনো রুল সেই বিচারকের দায়িত্বে বাধা হয়ে দাঁড়ায়; আদালতের কাছে এই বিষয়টি আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় আর তাই আদালত সরকারি আদেশের বিপক্ষে রায় দেন। ফেডারেল আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলও নাকচ হয়ে যায়। সারা দেশে আলোড়ন তোলা এই মামলায় জিতে জুনেরা ইসহাক গত ৯ অক্টোবর নিকাব পরেই কানাডার নাগরিক হিসেবে শপথ নিয়েছেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে সরকার বর্তমানে সর্বোচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি সময়ের ব্যাপার মাত্র, যেদিন কানাডার সুপ্রিম কোর্ট নাগরিকত্বের শপথ অনুষ্ঠানে ধর্মীয় আনুগত্যের স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেবেন।
২০১২ সালে এক যুগান্তকারী মামলায় সর্বোচ্চ আদালত রায় দেন, নাগরিক অধিকার সনদের আওতায়, আদালতে বিচার চলাকালীন ধর্মীয় স্বাধীনতা সংকোচন একমাত্র আইন মেনেই সম্ভব। সেই রায়ে আদালত বলেন, নিকাব পরে আদালতে জবানবন্দি দেওয়া যাবে যদি এটি বিচারের ন্যায্যতা প্রশ্নবিদ্ধ না করে।
এটি স্বয়ংক্রিয় কোনো প্রক্রিয়া নয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে তার নিজস্ব ঘটনা এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে করণীয় ঠিক করতে হবে। আদালত তার রায়ে লিখেছিলেন, একদিকে সাক্ষী সব সময় তার নিকাব খুলতে বাধ্য, আবার অন্যদিকে, কখনোই নিকাব খোলা যাবে না, এ দুটিই চরম দৃষ্টিভঙ্গি এবং এর কোনটিই সমীচীন নয়। আদালতের মতে, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও বিচারের ন্যায্যতা এই দুইয়ের যথাযথ ভারসাম্যের মধ্যেই এর উত্তর নিহিত। আদালত আরও বলেন, ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ যা সাক্ষীকে আদালতের দরজায় তার ধর্মকে রেখে আসতে বাধ্য করে, সেটি কানাডার বিচার ব্যবস্থা ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, রাষ্ট্রপক্ষের আপিল আবেদন যখন সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছাবে, তখনো সর্বোচ্চ আদালত একই মূলনীতি অনুসরণ করবে। এই ক্ষেত্রে আদালতের সিদ্ধান্ত নিতে আরও সুবিধে হবে, কারণ নাগরিকত্বের শপথ গ্রহণের সময় নিকাব কোনো দৃশ্যমান ঝুঁকির কারণ হতে পারে না। এমনকি পরিচয় প্রমাণও কোনো ব্যাপার নয়। যেহেতু নাগরিকত্বের আবেদনকারীকে আগেই ছবি শনাক্তকরণের সময় ও অনুষ্ঠানের আগে কর্মকর্তাদের কাছে মুখ অনাবৃত করতে হয়। জুনেরা ইসহাকও তার মামলার আবেদনে পরিচয় শনাক্তকরণের সময় নিকাব খুলতে তার সম্মতির কথা জানান।
প্রথাগত ধারণা এই, রক্ষণশীল অংশটি সব সময় পর্দা প্রথার পক্ষে অথচ উত্তর আমেরিকার অন্যতম এই দেশে হারপার ও তার রক্ষণশীল দল এটির বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন। প্রগতিশীল সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দলগুলো জোরেশোরে নিকাবের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এনডিপির নেতা বলেছেন, এটি নীতির প্রশ্ন। আসলে এতে আইন ও সংখ্যালঘুর অধিকারের প্রশ্ন জড়িত।
হারপার নিকাবের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ভোটের ফল ঘরে তোলার আশা করছেন। কেননা জনমত জরিপে দেখা গেছে, দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এই বিষয়টিতে হারপারের অবস্থানকে সমর্থন করছেন। হারপার তার অবস্থানকে আরেক ধাপ বাড়িয়ে বলছেন, নির্বাচিত হলে কুইবেকের লিবেরাল্দের অনুকরণে ফেডারেল চাকরির ক্ষেত্রেও নিকাব পরাকে আইন করে বন্ধ করে দেবেন। তবে এই বিতর্কে একটা জিনিস তার পক্ষে নেই, সেটি হচ্ছে দেশটির আইন। আইন বিশারদরা বলছেন, এই মামলাটির ক্ষেত্রেও পরিশেষে আইনের জয় অবধারিত।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
ধর্ষণের অভিযোগের তদন্ত চলায় এমবাপ্পেকে বিজ্ঞাপন থেকে সরাল রিয়াল
আর্থিক দ্বন্দ্বের মধ্যে পিএসজি ছেড়ে রিয়াল মাদ্রিদে আসার পর একেরবিস্তারিত পড়ুন
মিয়ানমারে বন্যায় মৃতের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে ২২৬
ঘূর্ণিঝড় ইয়াগির প্রভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমারে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণেবিস্তারিত পড়ুন
ইসরাইলি হামলায় আরও ৩৮ ফিলিস্তিনি নিহত
গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলি বাহিনীর তান্ডবে প্রাণ গেছে আরও ৩৮বিস্তারিত পড়ুন