গোটা দেশটাই যেভাবে যুক্ত মানবপাচারে : থাইল্যান্ড
মানবপাচারের ‘জমজমাট ব্যবসার’ খবর যখন বিশ্বজুড়ে আলোচনায়, ঠিক তখন থাইল্যান্ডের জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে আধুনিক এই ‘দাস ব্যবসার’ সঙ্গে প্রায় পুরো থাই সমাজের জড়িয়ে থাকার রোমহর্ষক তথ্য তুলে এনেছেন বিবিসির এক সাংবাদিক। গত মাসের শেষ দিকে আন্দামান সাগরে থাইল্যান্ডের একটি দ্বীপে পাচারের শিকার মানুষের গণকবরের সন্ধান পাওয়ার খবর যখন বাতাসে ভাসছে, তখন একদল থাই স্বেচ্ছাসেবীর সঙ্গে ওই এলাকায় যান বিবিসির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া প্রতিবেদক জোনাথন হেড।
পাচারকারীরা কীভাবে তাদের কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, ভাগ্য বদলের আশায় কাঠের নৌকায় সাগরে ভাসা মানুষকে জিম্মি করে কীভাবে তারা মুক্তিপণ আদায় করছে, এবং থাই প্রশাসন কীভাবে তাতে সহযোগিতা দিচ্ছে তার বিস্তারিত উঠে এসেছে শুক্রবার বিবিসিতে প্রকাশিত হেডের প্রতিবেদনে। থাইল্যান্ডের শংখলা প্রদেশের ওই দ্বীপে পৌঁছানোর আগেই জায়গাটি মানবপাচারের আস্তানা হিসাবে ব্যবহৃত হওয়ার খবর হেডের কানে আসে। আর যে জায়গায় গণকবর পাওয়া গেছে, সে স্থানটি পাচারকারীরা ব্যবহার করছিল অবৈধ অভিবাসীদের সাময়িকভাবে রাখার ক্যাম্প হিসাবে। সময় সুযোগ মতো সেখান থেকে তাদের পাঠানো হত দক্ষিণে, মালয়েশিয়ার সীমান্তের দিকে।
হেডের সঙ্গে থাকা স্বেচ্ছাসেবীরা জলাকাদার মধ্যে গভীর করে মাটি খুঁড়ে প্রথমে এক টুকরো হাড়ের সন্ধান পান। এরপর পাওয়া যায় ভেজা কাপড়, যার মধ্যে পাওয়া যায় হলদে হয়ে আসা এক নারীর কঙ্কাল।হেড লিখেছেন, “তিনি কে ছিলেন, কীভাবে তার মৃত্যু হল তা আমরা হয়তো আর জানতে পারব না। তবে এটা প্রায় নিশ্চিত, তিনি পাচারের শিকার হাজারো মানুষের একজন ছিলেন।
“সাগরপথে কঠিন এক যাত্রার পর তিনি হয়তো বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপে এসে পৌঁছেছিলেন। মালয়েশিয়ায় একটু ভালো জীবন পাওয়ার আশায় তার পরের পথটুকু হয়তো আরও অনেক বেশি দুর্বিষহ হতো।”
হেড লিখেছেন, “তাকুয়া পা জেলার কর্মকর্তারা এক দল অভিবাসীকে উদ্ধার করেছে শুনে আমরা ব্যাংকক থেকে ছুটে গিয়েছিলাম। স্থানীয় কমিউনিটি হলে আমরা মারাত্মক বিপর্যস্ত ৮১ জন পুরুষকে পেলাম; তারা কাঁদছিলেন এবং প্রার্থনা করছিলেন।”
মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে কয়েক বছর ধরে রোহিঙ্গা মুসলিমরা পালিয়ে সেখানে যাচ্ছে- এমন খবর প্রচলিত থাকলেও জোনাথন হেড যাদের দেখা পেলেন তারা ছিলেন বাংলাদেশি। তারা আমাদের বলেন, তাদেরকে জোর করে নৌকায় তুলে এখানে আনা হয়েছে।”
জঙ্গলের যে জায়গাটায় নারীর কঙ্কাল পাওয়া যায়, তার কাছাকাছি ওই জায়গায় হেডকে নিয়ে যান জেলার প্রধান মনিত পিয়ানথং। সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, ওই মানুষদের মারধর করা হয় এবং বেশ কয়েকদিন ধরে তারা অভুক্ত রয়েছে।
জোনাথন হেড বলেন, “মনিত আমাদের বলেন, নৌকা থেকে অভিবাসীদের ট্রাকে স্থানান্তরের জায়গা হিসেবে তার জেলাটিকে দীর্ঘদিন ধরে পাচারকারীরা ব্যবহার করছে। তিনি এটাকে বন্ধ করতে চাইলেও কেন্দ্রীয় সরকার বা স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে তেমন সহযোগিতা পাচ্ছেন না।
তিনি বলেন, “বেশ কয়েকদিন ধরে আমি দেখলাম, তিনি ক্ষুব্ধ সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশের ফোন ধরায় ব্যস্ত ছিলেন। গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার জন্য তারা তাকে ধমকাচ্ছিল। একইসঙ্গে মনিত বাংলাদেশিদের অভিবাসন হেফাজত কেন্দ্রে পাঠাচ্ছে দাবি করে তাকে বকছিল। “এখানে পাঠানো অভিবাসীদের অনেককেই যে পাচারকারীদের কাছে বেচে দেওয়া হয়- তা মোটমুটি ‘ওপেন সিক্রেট’।”
অস্থায়ী ওই ক্যাম্পগুলির সন্ধানে মনিত নিজের কর্মীদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ব্যবহার করতেন। ট্রাকবোঝাই অভিবাসীদের থামাতে তিনি দক্ষিণমুখী প্রধান সড়কে ২৪ ঘণ্টা পাহারা বসান। এমনকি, জেলেদেরও তিনি বলে রাখেন, যাতে তারা কোনো নৌকা আসতে দেখলেই তাকে খবর দেন।
বিবিসির এই সাংবাদিকের পর্যবেক্ষণ, “রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাড়তে থাকা বাংলাদেশিদের আগমন প্রমাণ করে যে ‘আদম ব্যবসা’ বিস্তৃত হচ্ছে এবং আশ্চর্যের কিছু নেই যে, এটা অত্যন্ত মুনাফাযোগ্য ব্যবসা।”
বিজনেস মডেল
জোনাথন হেড লিখেছেন, “রাবার গাছগুলোর নিচে ছিল হাঁস ফাঁস করা গরম। পাহাড়ে উঠতে আমার যখন দম ফুরিয়ে আসছিল, তখন উজ্জ্বল কমলা রঙয়ের শার্ট পরা এক যুবক আমার সামনে চলে এল। সামনে দৃশ্যমান কোনো পথ ছিল না। যুবকটি থেমে তাড়াতাড়ি কথা বলতে শুরু করলো।”
ওই যুবক বললো, ছয় মাস আগে আরো ৬০০ জনের সঙ্গে তাকেও সেখানে আনা হয়। ছাদবিহীন অবস্থায় কীভাবে ঘুমাতো- তা বুঝাতে সে ঝরা পাতা ও পোকামাকড়ের উপর শুয়ে পড়লো।
সেখানে একটা তাবুতে তাদের এনে রাখে পাচারকারীরা। অর্থের জন্য তাদের বাবা-মার কাছে ফোন করতে বাধ্য করে তারা। টাকা দিতে না পারলে তাদের পেটানো হয়। কিছু দূরে ইঙ্গিত করে যুবকটি দেখালো, ওখানে এক নারীকে ধর্ষণ করতে দেখেছে তারা। পাচারের শিকার এসব মানুষের মৃত্যু হলে ট্রাকে করে তাদের লাশ সরিয়ে নেওয়া হতো।
হেড বলেন, “এটাই ছিল বিজনেস মডেল। থাই পাচারকারী চক্র অভিবাসীদের নৌকায় বোঝাই করে আনতো। থাই পুলিশসহ বেশ কয়েকটি সূত্র আমাদের বলেছে, ৩০০ মানুষের একটা নৌকার জন্য তারা ২০ হাজার ডলার বা তার বেশি অর্থ আদায় করে। পরিবারের কাছ থেকে এই মুক্তিপণ আদায়ের জন্য অভিবাসীদের জঙ্গলে আটকে রাখা হয়। মালয়েশিয়াতে স্বল্প মজুরির কাজের জন্য এসব মানুষের কাছ থেকে তারা জনপ্রতি দুই থেকে তিন হাজার ডলার করে আদায় করে।”
থাইল্যান্ডের গ্রামবাসীর সামনে পাচারকারীরা কীভাবে এই ব্যবসা চালাচ্ছে তারও অনুসন্ধান চালিয়েছেন জোনাথন হেড। বয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে হেড বলেন, “পুরো গ্রামবাসী এর সঙ্গে যুক্ত; শুধু অর্থের জন্য। পাচারকারীরা সবাইকে ভাড়া করে। ক্যাম্পের উপর নজরদারির জন্য ও রোহিঙ্গাদের খাবার সরবাহের জন্য তারা লোক ভাড়া করে। লোক ভাড়া করতে তারা গ্রামের সব ঘরে ঘরে যেতো।”
ওই অঞ্চলের প্রধান উৎপাদিত পণ্য রাবারের দাম পড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে উপার্জনের মোক্ষম বিকল্প হিসেবে গ্রামবাসীরা এই কাজ বেছে নেয়। “ছেলেটি আমাকে বলেছে, প্রণোদনা হিসেবে যুবকদের মধ্যে মাদকও সরবরাহ করা হতো। অভিবাসীরা পালালেও সহজেই ধরা পড়তো এবং ক্যাম্পের প্রহরীরা তাদের নৃশংসভাবে পেটাতো।”
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
ধর্ষণের অভিযোগের তদন্ত চলায় এমবাপ্পেকে বিজ্ঞাপন থেকে সরাল রিয়াল
আর্থিক দ্বন্দ্বের মধ্যে পিএসজি ছেড়ে রিয়াল মাদ্রিদে আসার পর একেরবিস্তারিত পড়ুন
মিয়ানমারে বন্যায় মৃতের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে ২২৬
ঘূর্ণিঝড় ইয়াগির প্রভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমারে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণেবিস্তারিত পড়ুন
ইসরাইলি হামলায় আরও ৩৮ ফিলিস্তিনি নিহত
গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলি বাহিনীর তান্ডবে প্রাণ গেছে আরও ৩৮বিস্তারিত পড়ুন