জানতাম আমার ছেলেরা আমাকে বাসা থেকে বের করে দেবে: জাহানারা বেগম
নিজের মায়ের জন্য কখনও কেঁদেছেন পাঠক? অনেকেই বলবেন, অবশ্যই কেঁদেছি। আমিও কেঁদেছি। আসেন আজকে অন্য একজন মায়ের জন্য কাঁদি। শুধু কাঁদবেন না, অনেক বেশি ভাববেন। মা তো মা, আরেকজনের মা আবার কি! আজ যে মায়ের গল্প বলছি তার নাম জাহানারা বেগম।
তপ্ত রোদের তাপ মাথায় ভর করে গাজীপুরের খতীব বাড়ি বৃদ্ধাশ্রমে- মা দিবসে মায়েদের মুখে হাসি ফুটাতে। যারা তাদের নিজেদের সন্তান জন্ম দিয়ে তাদের দ্বারাই প্রতারিত হয়েছেন। মানে তাদের সন্তানেরা ভুলে গিয়েছে, সে একজন মায়ের মাধ্যমে পৃথিবীতে এসেছে। যার বুকের দুধ পান করে তার বুদ্ধি বৃদ্ধি হয়েছে।
খতীব বাড়িতে বর্তমানে এমন মায়ের সংখ্যা ১০৬ জন, যারা তাদের সন্তান দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন। এমনই এক মা জাহানারা বেগম। বয়স ৭৫ বছর। যার স্বামী ছিল, সন্তান ছিল, ছিল কুমিল্লাতে বাড়ি। কিন্তু আজ কিছুই নেই। শুধু বৃদ্ধাশ্রমে বসে বসে অপেক্ষা করছেন কখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন। এমন ভাবেই কথাগুলো বলছিলেন আমাকে তিনি। আমার হাতটি তিনি ধরে আমাকে বললেন, ‘কেন আসছো তোমরা এখানে? আমি বললাম, আপনাদের সঙ্গে গল্প করতে, আপনাদের মুখে হাসি ফুটাতে। তিনি বললেন, ‘গল্প শুনলে মানসিকভাবে ঠিক থাকতে পারবা তো?’ আমি বললাম, অবশ্যই পারব। আপনি বলুন। তিনি আবারও বললেন, ঠিক আছে তাহলে দেখি গল্প শুনে কিভাবে আমাকে তুমি হাসাতে পার?। আমি বললাম ঠিক আছে।
পাঁচ বছর আগের কথা, তখন আমি কুমিল্লায় থাকি আমার বাসায়। আমার স্বামী ছিলেন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অফিসার। তিনি মারা গিয়েছেন। আমার চার ছেলে এক মেয়ে। এর মধ্যে এক ছেলে মারা গিয়েছে। সবার বড় যে ছেলে সে আর্মি অফিসার। আর বাকিরা ভালো পজিশনে আছে। তারা সবাই বিবাহিত। আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকেই শুরু হলো আমার উপর মানসিক যন্ত্রণা। আমার সন্তানেরা আমাকে নানা ভাবে কথা শুনাতো কিন্তু যখনই তাদের প্রয়োজন হতো আমার কাছ থেকে ফুসলিয়ে টাকা নিয়ে যেত। কারণ আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর আমার কাছে প্রায় ১০ লক্ষ টাকার মতো ছিল। যা আমার স্বামী আমার জন্য ব্যাংকে রেখে গিয়েছিল। সেই টাকা নিয়েই তারা আমাকে নানা ভাবে যন্ত্রণা দেওয়া শুরু করল। বাড়ির বউরা পর্যন্ত আমাকে টর্চার করত। ঠিক মতো খেতে দিত না। ঘুমাতে পারতাম না তাদের কথার জন্য। এভাবে কি থাকা যায় তুমি বলো? আমি আমার ভাষা হারিয়ে ফেলা শুরু করলাম।
তিনি আবারও বলা শুরু করলেন, ‘এ রকম মানসিক যন্ত্রণা একদিন শেষ হলো। আমার কাছ থেকে বাড়ি ঘর লিখে নিলো তারা। ব্যাংকে যে টাকা ছিল তাও নিয়ে গেল। তখন আমি বুঝতে পারছিলাম আমাকে যে কোন সময় বাসা থেকে বের করে দেবে আমারই সন্তানেরা। যাদের আমি মানুষ করেছি।’ এই বলেই তিনি কান্না শুরু করলেন।
আমি হাত ধরে বললাম আর শুনতে পারছি না মা। আমাকে ক্ষমা করুন। তিনি কেঁদে কেঁদে বলা শুরু করলেন, ‘শেষ পর্যন্ত আমাকে ঘর থেকে তারা বের করে দিলো। আমি বৃদ্ধ মানুষ কি আর করব। কোন মতে এই খতীব বাড়ির খোঁজ নিয়ে চলে আসি এখানে। আজ পাঁচ বছর এখানে।’
আমি তাকে ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘আপনার সন্তানরা যদি আবারও আপনাকে নিয়ে যেতে চায় তাহলে আপনি কি যাবেন? তিনি বললেন, ‘নাহ, কখনও না। আমি এখানেই ভালো আছি। বেশ সুখে আছি। খতীব বাড়ির এখানে যারা আছে সবাই অনেক সেবা যত্ন করে। আমার সন্তানরা ভালো থাকুক, আমি দূর থেকে তাদের জন্য দোয়া করে যাই। এটাই ভালো হয় সবার জন্য।’
আমি দেখলাম তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আমি মুছে দিয়ে বললাম, কেঁদে আর কি হবে মা, এই যে খতীব বাড়ি এত বড় জায়গাতে কখনও ভূত দেখেন নাই? এইবার তিনি হাসি দিলেন। নাহ, কি যে বলে এই ছেলে, ভূত আসল কই থেকে। মানুষের থেকে ভয়ংকর কিছু পৃথিবীতে নেই। আর এখানে তো মুকুল (প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান) ও তো অনেক ভালো মানুষ। খোঁজ খবর নেয় সবার ঠিক মতো। যা আমার সন্তানের কাছ থেকে কোন দিন পাই নাই। মুকুলই এখন আমার সন্তান।
তার হাসি দেখে আমিও হাসি। তার হাতটি ধরে বলি, আপনার এখানে একা একা লাগে নাকি পাঁচ বছরে অনেক বান্ধবী হয়েছে আপনার? তিনি আবারও মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, অনেক বান্ধবী আছে আমার। তাদের সঙ্গে গল্প বলতে আমার ভালো লাগে। তবে নাম বলতে পারব না কিন্তু। কারণ অনেক কিছুই মনে থাকে না। আবার কোন নাম বাদ পড়লে সেই বান্ধবী অভিমান করতে পারে।’
আমি আবারও শেষ প্রশ্ন করি তাকে। এই শেষ বয়সে এসে কি জীবন নিয়ে কি ভাবছেন? তিনি বললেন, ‘এত কিছু ভাবার নেই। শুধু পুরনো স্মৃতিগুলো মনে পড়ে যায়। বিশেষ করে যেই সন্তানদের বুকে তুলে মানুষ করলাম তারাই আমাকে আজ আমার কথা মনে করে না। আমিও বাসা থেকে যখন বের করে দেয় সে সময় বলে এসেছি, একদিন তোদেরও বৃদ্ধ হতে হবে।’
এই বলে আবার তিনি সেই কান্না শুরু করতে গেলেন। আমি প্রশ্ন করে ফেললাম, আপনি তো দেখতে মাশাআল্লাহ অনেক সুন্দর। অল্প বয়সে কতগুলা প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছিলেন? এই বার তিনি লজ্জা পেয়ে মুচকি হাসি দিলেন। আর বললেন, ‘আমাদের সময়ে এখনকার ছেলে মেয়েদের মতো এত বেহায়া ছিল না। হয়তো যুগ বদলাইছে। আমাদের সময়ে এত প্রেম পিরিতি ছিল না। আর আমরা বুঝতামও না। বাবা-মা যাই বলত তাই শুনতাম। বুঝলা?’ আমি হাসি দিয়ে বললাম, হ বুঝছি। তিনি আবারও আমার গালে আদর করে টান দিয়ে বললেন, তা তোমার প্রেমিকা কয়টা? আমি বললাম, এটা তো বলা যাবে না। এই লেখা আমার প্রেমিকাও পড়বে একদিন।’
এই বলে তার হাতে একটি বেলুন, রজনীগন্ধা ও গোলাপ ধরিয়ে দিলাম। তিনি হাসি দিয়ে বললেন অনেকদিন পর কেউ ফুল দিল। ভালো থেকো খোকা আজ আসি। এই বলে তিনি উঠে পড়লেন চেয়ার থেকে। আমাদের গল্পটা শেষ হলো। কিন্তু শেষ হইয়াও হইলো না শেষ। আমি ডুবে গেলাম আরেক গল্পে। ততক্ষণে বেলুন, ফুল, দাবা, লুডু নিয়ে বেশ আনন্দ শুরু হয়ে গিয়েছে। লুডু লেখায় বেশ হৈচৈ শুরু। আবার অনেক বৃদ্ধা মা ফটোশুটে ব্যস্ত। তারা হাসি দিয়ে নানা পোজ দিয়ে ছবি তোলায় বেশ আনন্দিত। এই ফাঁকে মনে হলো আহারে ৩৬৫ দিনই যদি এমন আনন্দে কাটানোর সুযোগ থাকত। প্রিয়.কম
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
চা কন্যা খায়রুন ইতিহাস গড়লেন
চা শ্রমিকদের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে সব মহলেই পরিচিত হবিগঞ্জেরবিস্তারিত পড়ুন
চার্জ গঠন বাতিল চেয়ে রিট করবেন ড. ইউনূস
শ্রমিক-কর্মচারীদের লভ্যাংশ আত্মসাতের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড.বিস্তারিত পড়ুন
ড. ইউনূসের মন্তব্য দেশের মানুষের জন্য অপমানজনক : আইনমন্ত্রী
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, কর ফাঁকি দেওয়ার মামলাকে পৃথিবীর বিভিন্নবিস্তারিত পড়ুন