ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ, মৎস্য বিভাগ ও বিশেষজ্ঞদের ভিন্ন মত
গত কয়েক বছরের মন্দাভাব কাটিয়ে চট্টগ্রামের সাগর উপকূলে এবার জেলেদের জালে ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ। এত ইলিশ এবার ধরা পড়ছে যে মৌসুম শেষে এর পরিমাণ গত বছরের চেয়ে অন্ত:ত চারগুণ বেশি হবে বলে মনে করছে মৎস্য বিভাগ। এছাড়া এবার যে দামে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে গত পাঁচ বছরে সেই দামে চট্টগ্রামে এই মাছ বিক্রি হয়নি বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সাইয়েন্স এন্ড ফিশারিজ ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ড.সাইদুর রহমান জানিয়েছেন, সর্বশেষ ১৯৯৮ সালে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ বাংলাদেশে ধরা পড়েছিল। এরপর গত দেড় যুগে আর এত বিপুল পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়ার নজির নেই।
জেলা মৎস্য অফিসের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, মৌসুমের আরও চার মাস বাকি থাকতেই এই বছর ইলিশ আহরণের পরিমাণ গত বছরের রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত চট্টগ্রামে ইলিশ ধরা পড়েছে ৩১০০ মেট্রিকটন। এই ধারা অব্যাহত থাকলে মৌসুমের বাকি সময়ের মধ্যে আরও কমপক্ষে ৫ হাজার মেট্রিকটন ইলিশ ধরা পড়বে বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রামের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা প্রভাতী দেব বলেন, চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকায় ২০১৩ সালে আমরা মোটামুটি ইলিশ পেয়েছিলাম। এর আগে-পরে গত ছয়-সাত বছর ধরে মন্দাভাব ছিল। তবে এবার শুধু চট্টগ্রামে যে পরিমাণে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে তা অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে দিচ্ছে।
সূত্রমতে, ২০১৩ সালে চট্টগ্রামে ইলিশ সংগ্রহ হয়েছিল ৬ হাজার ২০৭ মেট্রিকটন। ২০১৪ সালে ১ হাজার ৯৫২ মেট্রিকটন এবং ২০১৫ সালে ইলিশ সংগ্রহ হয়েছিল ২ হাজার ৩৩০ মেট্রিকটন।
প্রভাতী দেব বলেন, ২০১২ সাল থেকে এর আগে অন্ত:ত পাঁচ বছর ইলিশ সংগ্রহ হয়েছিল একেবারে নগন্য যা পরিমাণে এক হাজার মেট্রিকটনের বেশি হবে না।
মৎস্য অফিসের কর্মকর্তারা জানান, মা মাছ রক্ষায় ১২ অক্টোবর থেকে ২২ দিনের জন্য সাগরে ইলিশ ধরা বন্ধ থাকবে। এর আগ পর্যন্ত চট্টগ্রাম উপকূলে কমপক্ষে আরও এক হাজার মেট্রিকটন ইলিশ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে মৎস্য অফিস।
এরপর নভেম্বর, ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি পর্যন্ত তিনমাসে আরও কমপক্ষে চার হাজার মেট্রিকটন ইলিশ সংগ্রহ হবে বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।
প্রভাতী দেব বলেন, জানুয়ারি পর্যন্ত ইলিশ পাওয়া যাবে। ফেব্রুয়ারি থেকে ইলিশ কমতে থাকবে। সব মিলিয়ে চলতি মৌসুমে চট্টগ্রামে ৮ হাজার মেট্রিকটন পর্যন্ত ইলিশ সংগ্রহ হবে বলে আশা করছি।
চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী, সন্দ্বীপ, সীতাকুণ্ড ও মিরসরাই উপকূলে জেলেদের জালে ধরা পড়ে ইলিশ। এর মধ্যে আনোয়ারা-বাঁশখালী এবং সন্দ্বীপে সর্বোচ্চ পরিমাণে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রভাতী দেব।
এছাড়া নগরীর কাট্টলী, হালিশহর, আনন্দবাজার, পতেঙ্গা, খেজুরতল উপকূলেও প্রচুর ইলিশ মিলছে বলে তিনি জানান।
বিপুল পরিমাণ ইলিশ সংগ্রহ হওয়ায় দামেও স্বস্ত্বি মিলেছে। নগরীর বাজারগুলোতে ইলিশের দাম এখন মধ্যবিত্তের হাতের নাগালে।
মঙ্গলবার (২০ সেপ্টেম্বর) রাতে নগরীর আইস ফ্যাক্টরি রোড এবং সিরাজউদ্দৌলা রোডে বাজার ঘুরে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম উপকূলীয় এলাকায় ধরা পড়া এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১০০০ টাকায়। আর ৫০০ থেকে ৭০০ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকায়। এর চেয়ে কম ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়।
ঈদুল আজহার আগে একই বাজারে এক কেজি ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকায়। তবে এক কেজি ওজনের ইলিশ এসব বাজারে এতদিন ছিলনা বললেই চলে। কিন্তু এখন এক কেজি ওজনের ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে।
এক কেজির চেয়ে কম ওজনের ইলিশ একই বাজারে ঈদুল আজহার আগে বিক্রি হয়েছে ৮৫০ থেকে ১০০০ টাকায়।
নগরীর অভিজাত বাজার কাজির দেউড়িতে সাধারণত চাঁদপুর এবং নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুর থেকে আসা পদ্মা-মেঘনার ইলিশ বিক্রি হয়।
বুধবার সকালে কাজির দেউড়ি বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, ৮০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকায়। ঈদুল আযহার আগে একই ইলিশ বিক্রি হয়েছিল কেজিপ্রতি ১২০০ টাকায়।
কাজির দেউড়ি বাজারে এক কেজি কিংবা এক কেজি দুইশ-আড়াইশ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১২০০ টাকায় যা ঈদুল আযহার আগে বিক্রি হয়েছিল ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকায়।
কাজির দেউড়ি বাজারের বিক্রেতা রুস্তম সওদাগর বলেন, এবার যে পরিমাণ মাছ আসছে তাতে মনে হচ্ছে দাম আরও কমবে। গত পাঁচ বছরে কাজির দেউড়িতে আমরা কখনও ৭০০ টাকায় ইলিশ মাছ বিক্রি করিনি। এবার মাছ বেশি, তাই দামেও সস্তা।
হঠাৎ ইলিশের এত প্রাচুর্য কেন, জানতে চাইলে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা প্রভাতী দেব বলেন, একটা বিষয় হচ্ছে যে আমরা জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে জাটকা নিধন প্রায় বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছি। যেসব বাণিজ্যিক ট্রলার আছে সেগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে ৬৫ দিন সাগরে যেতে দেয়া হচ্ছে না। এছাড়া জেলা প্রশাসন, কোস্টগার্ড ও মৎস্য বিভাগের মা মাছ নিধন প্রতিরোধে কঠোর নজরদারি তো আছেই।
কোস্টগার্ড পূর্ব জোনের কমান্ডার ক্যাপ্টেন শহীদুল ইসলাম বলেন, মা ইলিশ ও জাটকা নিধন বন্ধ করাকে আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। প্রজনন মৌসুমে প্রত্যেক পয়েন্টে আমাদের আলাদা আলাদা টিম থাকে। জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট এবং মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে সবসময় জোরালো অভিযান পরিচালনা করি। হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ জাল আটক করে পুড়ে ফেলি। এর ফলে জেলেরা ডিমওয়ালা ইলিশ এবং জাটকা ধরায় নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। এর ফলে এবার ইলিশের এত প্রাচুর্য।
তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সাইয়েন্স এন্ড ফিশারিজ ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ড.সাইদুর রহমানের মতামত ভিন্ন। তিনি জানিয়েছেন ইলিশের প্রাচুর্যতার সঠিক কারণ নির্ণয় করতে এর গতিবিধি অনুসরণ করা প্রয়োজন। এর জন্য সাগরে ও নদীতে প্রতি গ্যাপে মনিটরিং সিস্টেম থাকা প্রয়োজন যা বাংলাদেশে নেই।
ড. সাইদুর রহমান বলেন, প্রাথমিক গবেষণার দেখা গেছে প্রশান্ত মহাসাগরে যখন আবহাওয়াগত পরিবর্তন ঘটে তখন বঙ্গোসাগরে এবং এর সঙ্গে যুক্ত নদনদীতে ইলিশের প্রাচুর্যতা দেখা দেয়। ধারণা করা হয়, বৃষ্টিপাত এবং পানিপ্রবাহের পরিবর্তনের কারণে ইলিশ বঙ্গোপসাগরমুখ এবং এর সঙ্গে যুক্ত নদনদীমুখী হয়।
‘১৯৯৮ সালেও প্রশান্ত মহাসাগরে অ্যালমিনোর কারণে বাংলাদেশে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়েছিল। এরপর এই বছরই একইভাবে ইলিশের প্রাচুর্যতা দেখা যাচ্ছে। এর মানে আবার এটা নয় যে, আগামী বছরও চলতি বছরের মতো ইলিশের এত প্রাচুর্যতা থাকবে। আবার থাকতেও পারে। তবে ইলিশের গতিবিধি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হওয়া দরকার। ’
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
চট্টগ্রামে চিনির গুদামে আগুন- ১৭ ঘণ্টা পরও পুরোপুরি নেভেনি
গতকাল (৪ মার্চ) বিকালে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার ঈসানগর এলাকায় অবস্থিতবিস্তারিত পড়ুন
পাল্টাপাল্টি অবস্থানে ছাত্রলীগ চবিতে
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষক আমীর উদ্দিনকে অপসারণ ও লাঞ্ছনার বিষয়েবিস্তারিত পড়ুন
ঋণের বোঝা নিয়ে দম্পতির ‘আত্মহত্যা’
মন্দিরের পাশেই কুঁড়েঘরে থাকতেন পুরোহিত স্বপন দে ও তাঁর স্ত্রীবিস্তারিত পড়ুন