গ্রাম পাড়া ও ইউনিয়নে ক্ষোভ অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে
ঝিনাইদহে গরিবের চালে ধনীদের ভাগ নির্বিকার প্রশাসন
ঝিনাইদহ প্রতিনিধিঃ
‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি।’ কবিগুর“র বিখ্যাত কবিতা ‘দুই বিঘা জমি’র এমন উক্তি বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছে ঝিনাইদহে ১০ টাকা কেজি চালের কার্ড বরাদ্দের ক্ষেত্রে।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ডেফলবাড়ি গ্রামের জামিরুল ইসলাম ও জাহিদুল ইসলাম স্কুলে চাকরী করেন। অথচ শ্রমিক সাজিয়ে হতদরিদ্রদের জন্য দেয়া সরকারে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ১০ টাকা কেজি চালের কার্ড বরাদ্দ হয়েছে তাদের নামে। শিক্ষক জামিরুল ইসলাম গত ২৭ সেপ্টম্বর ৩০ কেজি চাল তুলেছেন। অন্যদিকে অপর শিক্ষক জাহিদুল ইসলাম চাল তুলেছেন ৩০ সেপ্টম্বর।
কুমড়াবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দেওয়া তাদের কার্ড নং যথাক্রমে ৯২৫ ও ৯২৭। চরম দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে এ ভাবে জেলার ৬৭টি ইউনিয়নে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের দুস্থ সাজিয়ে হাজার হাজার ভুয়া কার্ড দেওয়া হয়েছে।
এ নিয়ে খোদ সরকারী দলের মধ্যে ক্ষোভ এবং অসোন্তাষ ছড়িয়ে পড়েছে। ইউপি মেম্বরদের বাদ দিয়ে দলীয় চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা তালিকা করায় ১০ টাকা কেজির চাল যাদের পাওয়ার কথা সেই হতদরিদ্রদের ভাগ্যে জোটেনি।
প্রশাসনিক ভাবে কোন যাচাই বাছাই ছাড়াই কার্ড অনুমোদন দিয়েছেন উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোঃ হাসান মিয়া। ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসন এমন হাজারো পাহাড়ের মধ্যে নিবর্কিার। কোন পদক্ষেপ নেই। ফলে পরিবেশ আরো জটিল হয়ে উঠছে।
১০ টাকা কেজির কার্ড নিয়ে গ্রামে গ্রামে হাসাহাসি ও সমালোচনার খোরাক যোগাচ্ছে। ঝিনাইদহ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রন অফিস সুত্রে জানা গেছে ঝিনাইদহ জেলায় ৪৩ হাজার ৬৭৯টি কার্ড বিতরণ করা হয়েছে।
এর মধ্যে সবচে বেশি হতদরিদ্র দেখানো হয়েছে ঝিনাইদহ সদর উপজেলায়। সদরে কার্ড বরাদ্দ হয়েছে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ১৯৭ জনের। এ ছাড়া হরিণাকুন্ডুতে ৪ হাজার ৬২৯টি, কোটচাঁদপুরে ২ হাজার ৪৩১টি, মহেশপুরে ৬ হাজার ৫২৫টি, কালীগঞ্জে ৫ হাজার ৭৫৮টি ও শৈলকুপায় ৮ হাজার ৩৯ জনকে কার্ড দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ইউনিয়নে খোজ নিয়ে জানা গেছে, বরাদ্দকৃত ১০ টাকা কেজির চাল বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন ও ধনীদের পকেটে উঠছে।
এ তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মী, জনপ্রতিনিধিদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধব, চাকর-বাকর, চেয়ারম্যানের বডিগার্ড, প্রভাবশালী মাতুব্বর, স্বচ্ছল কর্মক্ষম ব্যক্তি। এমনকি তালিকায় আছে সরকারি বেসরকারী চাকুরেরা।
আবার তালিকায় অনেক নাম আছে যাদের বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। সেসব নামের বিপরীতে চাল তুলে তা আত্মসাৎ করা হচ্ছে। অনেক অসচ্ছল ব্যক্তি ১০ টাকা কেজি চালের একটি কার্ড পাওয়ার আশায় দিনের পর দিন ঘুরে বেড়িয়েছেন এলাকার মেম্বার, চেয়ারম্যানদের দ্বারে দ্বারে, কিন্তু পাননি।
সদর উপজেলার বংকিরা গ্রামের ইমদাদুল ইসলামের ছেলে নাসির অভিযোগ করেন, তার মা ৩/৪ বছর ধরে প্যারালাইসড হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। নিজের জমি জায়গা নেই। অথচ তাকে কার্ড না দিয়ে দলীয় ভাবে চাল দেওয়া হচ্ছে।
গান্না ইউনিয়নের কাশিমপুর গ্রামের খালেক মাষ্টারের ছেলে আঃ আলিম, রাজা জোয়ার্দারের ছেলে বাদশা, ভাদু সর্দারের ছেলে আলম ডাক্তার ও সাদুল্যর ছেলে মোস্তফা কার্ড পেলেও পায়নি ভিক্ষুক সোবাহান মোল্লা, অচল প্রতিবন্ধি আব্দুর রশিদ ও দিন মুজুর তাজুর মত লোকজন। স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা সিরাজ মালিথা অভিযোগ করেন, এক সময় ১০ টাকা কেজি চালের কার্ড এই ইউনিয়নে নৌকার ভরাডুবির কারণ হবে।
তিনি বলেন, বিএনপি ও জামায়াত পরিবারকে কার্ড দেওয়া হয়েছে। তবে চেয়ারম্যান নাসির মালিথা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তালিকা যাচাই বাছাই করে সচ্ছল পরিবার বাদ দেওয়া হচ্ছে।
অসচ্ছল ব্যক্তি যেই হোক দল বেদল বুঝি না, সবাই কার্ড পাবে। ঘোড়শাল ইউনিয়নের চাঁন্দো গ্রামের বেদানা খাতুন, ফরিদা খাতুন ও মনজেরা বেগম অভিযোগ করেন, তাদের গ্রামের আসাদ শিকদার নামে এক ব্যক্তির মাঠে ২২ বিঘা জমি। চেয়ারমান মাসুদ পারভেজ লিন্টন সেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে তাকে কার্ড দিয়েছেন। একই গ্রামের শামছুদ্দীন মন্ডলের স্ত্রী, সন্তান, মেয়ে ও ছেলের বউরা ৫টি কার্ড পেয়েছেন।
এক বাড়িতে এতো কার্ড দেওয়ায় চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া চাল বিক্রিতে নির্ধারিত ৩০ কেজি চাল না দিয়ে কম দেয়া হচ্ছে। ঘোড়শাল ইউনিয়নের আতিয়ার রহমান মোল্লা অভিযোগ করেন, তিন’শ টাকা নিয়ে তাকে ৩০ কেজির পরিবর্তে ২৪ কেজি চাল দেওয়া হয়েছে। চালের ডিলারও চেয়ারম্যান লিন্টনের ভাই অলিম্পিক। এ জন্য ২৪ কেজি করে চাল দিলেও কেও প্রতিবাদ করেন না।
পোড়াহাটী ইউনিয়নের মধুপুর বাজার এলাকায় গ্রাম্য মাতুব্বররা দরিদ্রদের কার্ড না দিয়ে নিজেরা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। শৈলকুপা উপজেলার দিগনগর ইউনিয়নের তমালতলা বাজারে শুক্রবার রাতে ১০ টাকা কেজি চালের কার্ড বরাদ্দ নিয়ে জাফর মেম্বর ও চেয়ারম্যান জিলুর রহমান তপনের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে এলাকায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। তবে চেয়ারম্যান জিলুর রহমান তপন জানিয়েছেন, প্রতিপক্ষরা হেয় প্রতিপন্ন করতে এমন অপপ্রচার চালাচ্ছেন।
এদিকে কুমড়াবাড়িয়া ইউনিয়নসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে চালের ডিলার হয়েছেন চেয়ারম্যানের আপন ভাই ও আত্মীয় স্বজনরা। ফলে তারা ওজনে কমসহ নানা কারসাজির সাথে জড়িয়ে পড়েছে। গান্না ইউনিয়নের শৈলমারী বাজারে সেনা মন্ডল নামে এক ডিলার ওজনে কম দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি শৈলমারী বাজারে ১০ টাকা কেজি চালের ডিলার সোনা মন্ডলের কাছে চাল নিতে আসেন রঘুনাথপুর স্কুলের নাইটগার্ড হায়দার আলী।
ওজনে কম দেয়ার প্রতিবাদ করায় তাকে মারধর করেন ডিলার লোকজন। এ ঘটনার কোন প্রশাসনিক কোন পদক্ষেপের কথা শোনা যায় নি। অনেক সময় কার্ডধারী ব্যক্তিদের চাল না দিয়ে খোলাবাজারে বিক্রি, ডিলার নিয়োগে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠে এসেছে এ কর্মসূচিতে।
তালিকা তৈরিতে অনিয়ম ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ ওঠায় জেলার গান্না ইউনিয়নে কয়েজজন চাকরীজীবীর কার্ড বাতিল করেছেন স্থানীয় চেয়ারম্যান নাসির উদ্দীন মালিথা।
জেলার অন্যান্য ইউনিয়নে হাজারো অনিয়মের নজীর থাকলেও জেলা প্রশান, ইউএনও বা খাদ্য বিভাগ কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। এদিকে বিভিন্ন এলাকা থেকে অভিযোগ পেয়ে ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে আট সদস্যের একটি তদারকি কমিটি গঠন করেছে। কমিটি অনিয়ম চিহ্নিত করে দ্রæত দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। এছাড়া মন্ত্রণালয় থেকে প্রত্যেক জেলা প্রশাসককে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
একটি গোয়েন্দা সংস্থাকেও অনিয়মের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমপ্রতি জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে ১০ টাকার চাল বিতরণে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও এই চাল বিক্রিতে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তারপরও ঝিনাইদহে পক্ষপাতদুষ্ট ১০ টাকা কেজি চালের কার্ড নিয়ে কারো তেমন উচ্চবাচ্চ পরিলক্ষিত হচ্ছে না বলে অভিযাগ উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসক মাহবুব আলম তালুকদার বলেছেন, অভিযেঙাগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
আনার হত্যার মাস্টারমাইন্ড শাহীনকে ধরতে ডিবির পরিকল্পনা
গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ধারণা, ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমবিস্তারিত পড়ুন
তৃতীয়বার আনারকে মনোনয়ন দিয়েছি জনপ্রিয়তা দেখে: কাদের
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম (আনার) স্বর্ণ চোরাচালানকারীবিস্তারিত পড়ুন
মাস্টারমাইন্ড শাহীনের অগাধ রহস্য
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার ভারতের কলকাতায় হত্যাকাণ্ডেবিস্তারিত পড়ুন