দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন কুষ্ঠ রোগীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে
নিলফামারীতে বসবাস করেন প্রায় ৬৫ বছর বয়সী ধ্যোলি বেওয়া। স্বামী মারা যাওয়ার পর তার ধরা পড়ে কুষ্ঠ রোগ। তাদের যেটুকু ভিটে ছিলো সেখান থেকে তার দেবররা তাকে তাড়িয়ে দেয়। নি:স্ব হয়ে ধ্যোলি বেওয়া দুই সন্তানকে নিয়ে রাস্তায় নামে। নিরুপায় হয়ে দুই সন্তানকে মানুষের বাসায় কাজে দেন। নিজে বেছে নেন ভিক্ষাবৃত্তি। মানুষের বাসায় কাজ করে ছেলে দুটি বড় হয়। বড় ছেলে রশিদুল (৪৭ )ছোট ছেলে দুলাল (৪৫) দিনমজুরি করে, পাশাপাশি অন্যের জমিতে কাজ করে জীবন চালায়।
ধ্যোলি বেওয়া ১৯৭৮ সাল থেকে লেপ্রসী মিশন ক্লিনিকে চিকিৎসা নেয়া শুরু করেন। তার ছেলেরা শ্বশুবাড়িতে মায়ের অসুস্থতার কথা গোপন রেখে বিয়ে করে। একসময় ছেলের বউরা জানতে পারে তাদের শ্বাশুড়ি বেচে আছে। তারাও তাকে ঘৃণা করতে শুরু করে। বর্তমানে ধ্যোলি বেওয়া ভিক্ষাও করতে পারছে না। ভাইয়ের জমিতে ছাপড়া বানিয়ে একা একাই থাকেন সেখানে। লেপ্রসী মিশন থেকে ধ্যোলি বেওয়াকে মাসে ১,১০০ টাকা হারে সিনিয়র এলাউন্স দেয়া হচ্ছে। লেপ্রসী মিশনের কর্মীরা ধ্যোলি বেওয়ার ছোট ছেলের সাথে কাউন্সিলিং করে বুঝিয়েছে তার মাকে তার কাছে যেনো নিয়ে আসে। মার জন্য রান্না করে নিয়ে যায় ছোট ছেলে তব্ওু মাকে তার নিজের কাছে রাখতে রাজী নন ছোট ছেলে। এভাবেই কোন রকম দিন চালান ধ্যোলি বেওয়া।
কুষ্ঠ রোগের কারনে সংসার করা হলো না সুনামগঞ্জ হেমায়েত পুরের ৫৮ বছর বয়েসের গয়েজ মিয়ার। পরিবারে তার রয়েছে তিনভাই তিনবোন আর মা। ২০ বছর বয়সে তার হয় কুষ্ঠ রোগ। অসুখের প্রাথমিক পর্যায়ে একবছর লতাপাতা তাবিজ কবজ দিয়ে চিকিৎসা করেন। কিন্তু এতে যখন রোগ ভালো হচ্ছিল না তখন তার বাবা জমি বিক্রী করে সিলেট হাসপাতালে নিয়ে যান। কুষ্ঠ রোগের কারনে একসময় প্রতিবেশিরা তাকে ঘৃনার চোখে দেখতো। এ রোগের কারনে তার বিয়ে করার ইচ্ছে থাকা সত্ব্ওে বিয়ে করা হয়নি। অসুস্থতার কারনে তিনি কোন কাজও করতে পারেন না। তাই মাজারে মাজারে ঘুরে সেখানেই বিনা পয়সায় খাওয়া দাওয়া সাড়েন। এভাবেই নিঘৃহীত জীবন যাপন করছেন গয়েজ মিয়া।
কুষ্ঠ রোগের কারনে সংসার ভেংঙ্গে যায় গাইবান্ধার শাঘাটার ৩৫ বছর বয়সী শাহিনা খাতুনের। সে কৃষিকাজ করত। তাদের ঘরে আলো করে জন্ম নেয় এক কন্যা সন্তান। ভালোই চলছিলো তাদের সংসার জীবন। কিন্তু খুব বেশি দিন স্থায়ী হলো না তা। জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। ধরা দেয় কুষ্ঠ রোগ। তখন থেকেই তার উপর শুরু হয় অত্যাচার। কুষ্ঠ রোগের কারনে এক পর্যায়ে শাহিনাকে সন্তানসহ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় এবং আরেকটি বিয়ে করে স্বামী। পরে কোলের ছোট সন্তানটিকে নিয়ে বাবার বাড়িতে উঠে শাহিনা। শাহিনার স্বামী শাহিনার এমনকি ছোট সন্তানটি খোজ খবর নেন না।
এরপর লেপ্রসী মিশন থেকে শাহিনা খাতুনকে ছয়মাসের টেইলারিং প্রশিক্ষন দেয়া হয় এবং তাকে একটি সেলাই মেশিনও দেয়া হয়। প্রশিক্ষন শেষে সে দর্জির কাজ শুরু করে। পরে দোকানে গজ কাপড় উঠিয়ে ব্যবসা শুরু করে। সন্তানকে দেখা শুনার পাশাপাশি বৃদ্ধ মা বাবাকেও দেখাশুনা করতেন শাহীনা। তার মা বাবা খুশি হয়ে শাহিনাকে চার শতাংশ জমি লিখে দেন। দিন দিন শাহীনার অবস্থার উন্নতি হতে থাকে। এ অবস্থা দেখে তার আগের স্বামী তাকে ফেরত নিতে চায় কিন্তু শাহীনা সেখানে ফিরে যায়নি। তার মেয়ে এখন ক্লাস নাইনে পড়ে। বারো বছর একা থাকার পর শাহীনা আবার বিয়ে করেছে। শাহীনার মেয়ে তার বৃদ্ধ মা বাবার কাছেই থাকে। লেপ্রসী মিশন শাহীনার মেয়েক শিক্ষা বৃত্তি দেন। এভাবেই শেষ হলো ধ্যোলি বেওয়া গয়েজ মিয়া এবং শাহীনার গল্প। এরকম হাজারো গল্প রয়েছে কুষ্ঠ রোগীদের। কুষ্ঠ রোগ সর্ম্পকে সঠিক তথ্য না জানার কারনে পরিবারের আপনজনের কাছ থেকে তারা পেয়েছে অনেক বঞ্চনা।।
সাধারনত ,মানুষের অজ্ঞতা, ভুল বোঝাবুঝি, উদাসীনতা, ইত্যাদি কারনে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা ও তাদের পরিবার পরিজন একরকম বঞ্চনা নিয়ে কোন রকম জীবন যাপন করছে। প্রতিনিয়ত তাদের দু:খ কষ্ট কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। কুষ্ঠ নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের সংশ্লিষ্টরা তাই মনে করছেন, তাদের শারিররিক প্রতিবন্ধকতা থেকে ও জরুরী সামাজিক দৃষ্টিভংঙ্গির পরিবর্তন। এজন্য তারা কুষ্ঠ স¤র্পকে আরো বেশি প্রচার প্রচারনার দাবী জানান। আর সরকারের পাশাপাশি প্রত্যেকটি মানুষকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন।
কুষ্ঠ রোগের বিস্তার: কুষ্ঠ রোগ সাধারনত বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়। চিকিৎসাধীন নয় এমন সংক্রামক কুষ্ঠ রোগীর হাচি ও কাশির মাধ্যমে নি:সৃত কুষ্ঠ জীবানু বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এবং শ্বাস গ্রহনের মাধ্যমে তা সুস্থ্য ও স্বাভাবিক মানুষের মাঝে প্রবেশ করে। শতকরা ৯৯ জন মানুষের সহজাত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারনেই কুষ্ঠ রোগ হয় না। সাধারনত কুষ্ঠ জীবানু শরীরে প্রবেশের ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যে এ রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। কোন কোন ক্ষেত্রে ১৫ থেকে ২০ বছর পরও এ রোগের লক্ষন প্রকাশ পেতে পারে।
দি লেপ্রসি মিশন বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর বলেন, কুষ্ঠ কোন অভিশাপ নয়। বিনামূল্যে এ রোগের চিকিৎসা পাওয়া যায়। শুধু দরকার সচেতনতা। আর লক্ষণ দেখা মাত্র চিকিতসকের সেবা নেয়া। তবে মানসিক দৃষ্টিভংঙ্গি পরিবতনে কুষ্ঠ রোগীরা পেতে পারে সুস্থ্য পরির্পূন জীবন। তবে অনেকে টাকা খরচ হবে বলে কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসা নিতে আগ্রহী হন না।
দি লেপ্রসী মিশন ইন্টারন্যাশনাল এর ড. এল্যাণ ব্যারুই কুষ্ঠ রোগ নিয়ে বলেন, কুষ্ঠ রোগ কোন বিকলাঙ্গতা সৃস্টি করে না। কুষ্ঠ রোগ নির্নয় যত দেরী হয় তখনই শুরু হয় ঘা, বিভন্ন রকম জটিলতা। ফলে কুষ্ঠ রোগীরা বিকলাঙ্গ হয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রতি বছর যে সব কুষ্ঠ রোগী সনাক্ত হয় তাদের মধ্যে ৬ থেকে ৭ ভাগ রোগী বিকলাঙ্গতায় ভোগে। তবে কুষ্ঠ রোগটি একটি স্বাভাবিক রোগ হিসেবে মেনে নিলেই কুষ্ঠ নির্মুল সহজ হবে বলে জানান তিনি।
দি লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশ প্রজেক্ট কোর্ডিনেটর জিপটা বৈরাগী বলেন, একজন কুষ্ঠরোগীর সুন্দর-স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে। চামড়ায় অবশ দাগ বা দানা দানা গুটির মতো দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। কুষ্ঠ আক্রান্ত ব্যক্তিদের মানবাধিকার রক্ষার স্বার্থে বিভিন্ন গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের এ বিষয়ে ইতিবাচকভাবে বিভিন্ন সংবাদ ও কুষ্ঠ বিষয়ে সাফল্যমূলক তথ্য ও খবরাখবর পরিবেশন করা আবশ্যক।
দেশের সমস্ত উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বক্ষব্যাধি ক্লিনিক এবং দি লেপ্রসি মিশন বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পসহ কুষ্ঠরোগের জন্য কাজ করে এমন সব সংস্থায় এ রোগের চিকিৎসা বিনামূল্যে পাওয়া যায়। এছাড়া সরকারিভাবে ঢাকার মহাখালীতে, সিলেটের শেখঘাটে, নীলফামারীর নটখানা, রাজশাহীর লক্ষ্মীপুরে হাসপাতাল রয়েছে। এছাড়াও নীলফামারী, দিনাজপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, চট্টগ্রাম, যশোর, মৌলভীবাজার ও ঢাকার মিরপুরে কুষ্ঠ রোগের বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এই রোগের জন্য সচেতনতা ও চিকিৎসায় কাজ করছে। চিকিৎসাই পারে কুষ্ঠ সারাতে এ তথ্য প্রচার করা গুরুত্বপূর্ণ।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
মানবদেহে আদার অনেক উপকার
আমাদের দিনে কয়েকবার রঙিন খাবার খাওয়া উচিত, কিন্তু আপনি কিবিস্তারিত পড়ুন
রেড মিট খাওয়ার আগে কিছু পরামর্শ জেনে নিন
কোরবানি ঈদে বেশ কয়েকদিন টানা খাওয়া হয় গরু বা খাসিরবিস্তারিত পড়ুন
জাপান ও ইউরোপে বিরল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ
জাপানে, একটি বিরল “মাংস খাওয়া ব্যাকটেরিয়া” এর কারণে এক রোগবিস্তারিত পড়ুন