পরিবহনের নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণে অসহায় সরকার?
২৯ অক্টোবর, সকাল সাড়ে ৯টা। কল্যাণপুর বাস স্টেশনে বাসের অপেক্ষায় আমিনুল ইসলাম। পেশায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। প্রতিদিন কল্যাণপুর থেকে মতিঝিল অফিস করতে হয় তাকে। অফিসে যাতায়াতের একমাত্র বাহন ৮ নম্বর বাস।
৩০ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকেও বাসের দেখা নেই। অপেক্ষার এক পর্যায়ে বাস এলো। কিন্তু লোকাল বাসকে করা হয়েছে ‘ডাইরেক্ট’। এমনিতেই বাসের ভাড়া বেশি। তার উপর ‘ডাইরেক্ট’। ভাড়া ৮ থেকে ১০ গুণ পর্যন্ত বেশি আদায় হচ্ছে। এভাবে তিনি প্রতিনিয়ত অফিসে আসা-যাওয়া করছেন।
দেরিতে বাস আসার কারণ সম্পর্কে তিনি জানান, সরকার ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু পর থেকে রাজধানীর সড়কগুলো থেকে উধাও হয়ে গেছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গণপরিবহন। ফলে গণপরিবহন সংকট এতটাই প্রকট হয়ে পড়েছে যে, অফিস ফেরত মানুষকে যারপরনাই ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। আর যাত্রীদের জিম্মি করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
তার এ বক্তব্যের সঙ্গে এক মত হয়ে অপর এক এনজিওকর্মী মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘গণপরিবহনের নৈরাজ্য কোনোভাবেই দূর করা যাচ্ছে না। কোনো আইনই প্রয়োগ করতে পারছে না সরকার। মনে হচ্ছে সরকার বেপরোয়া পরিবহন মালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। অনেকটাই অসহায় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘কল্যাণপুর থেকে মতিঝিল ভাড়া ১৫ টাকা। দুরুত্ব ১০ কিলোমিটার। সরকারি প্রতিকিলোমিটার বাস ১০ পয়সা ভাড়া পুণনির্ধারণ করেছে। এ হিসেবে ১ টাকা ভাড়া হতে পারে। কিন্তু সেখানে নেয়া হচ্ছে ২০ টাকা। বেশি নেয়া হচ্ছে ৪ টাকা।’
এ শুধু কল্যাণপুর আর মতিঝিল রুটেরই চিত্র নয়। এটা রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে পাশ্ববর্তী মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, নারায়নগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ জেলা শহরেও একই চিত্র বিরাজ করছে। কোনো আইন করে সরকার গণপরিবহনের নৈরাজ্য দূর করতে পারছে না।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের স্বীকার করেছেন, শতকরা ৬০ ভাগ বাস মালিকরা সরকারি নিয়মের ভাড়া নিচ্ছে। আর ৪০ শতাংশ গণপরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে। এটা জানার পরেও তিনি কোনো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। তবে তিনি বিভিন্ন সড়ক পরিদর্শনে বলে বেড়াচ্ছেন, কোনো অবস্থাই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা যাবে না। তবে বিষয়টা ওই পর্যন্তই সীমিত থাকছে। কোনো পরিবর্তনই দেখাতে পারছেন না তিনি।
প্রাথমিকভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে চলাচলরত বাসের নতুন ভাড়া প্রতি কিলোমিটার ১ টাকা ৭০ পয়সা ঘোষণা করে সরকার। যা পূর্বে ছিল ১ টাকা ৬০ পয়সা। বর্তমানে বেড়েছে কিলোমিটার প্রতি ১০ পয়সা। কিন্তু নগরীতে গণপরিবহনের অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
সরকারি নির্দেশ না মেনে গত ঈদের কয়েকদিন আগ থেকে এখন পর্যন্ত অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে তারা। বাসের ভেতরে ভাড়া বৃদ্ধির বিজ্ঞপ্তি টানানো হলেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করায় প্রায়ই যাত্রীদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ছে বাসের হেলপার, সুপারভাইজার ও চালক।
বাসের হেলপার ও চালকদের এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ঢাকা শহরেই নয় রাজধানীর আশপাশের জেলা নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নরসিংদি ও গাজীপুরে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
মিনি বাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ টাকা বাসের ভাড়া ৭টাকা। সেখানে ৭ টাকার ভাড়া ১০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন রুটে। এছাড়া লেগুনা, রাজধানী পরিবহন, বাহাদুর শাহ পরিবহন, স্বকল্প পরিবহনসহ ছোট পরিবহনগুলো ইচ্ছে মতো ভাড়া বাড়িয়ে নিচ্ছে।
জানা গেছে, সদরঘাট থেকে যাত্রাবাড়ী ও গুলিস্তানের ভাড়া ছিল ১০টাকা তা এখন নেয়া হচ্ছে ১৫-২০ টাকা। পাশাপাশি সিটিং সার্ভিসের নামের অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেছে যাত্রীরা।
বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, মতিঝিল থেকে মিরপুর পর্যন্ত ভাড়া বাড়ছে ৬ টাকা। এ ক্ষেত্রে মতিঝিল থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ১০টাকা ভাড়া ১২ টাকা ও ফার্মগেট থেকে মিরপুরের ভাড়া ১৩টাকার ভাড়া ১৭ টাকা হতে পারে। আর গুলিস্তান থেকে মিরপুরের ভাড়া বাড়ছে ৫টাকা। এর মধ্যে গুলিস্থান থেকে ফার্মগেট ৮ টাকার ভাড়া ১০টাকা ফার্মগেট থেকে মিরপুর ১২টকার ভাড়া ১৫ টাকা হচ্ছে। আর সদরঘাট থেকে মিরপুরের ভাড়া বাড়ছে ৬ টাকা।
মো: আয়নাল হক নামে এক যাত্রাবাড়ীর যাত্রী বলেন, বাহাদুরশাহ পরিবহনে সদরঘাট থেকে যাত্রাপ্রতি সাধারণ ভাড়া ১০টাকা। সেখানে তার কাছ থেকে ৩০ টাকা নেয়া হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। গুলিস্থান থেকে ফার্মগেটের ভাড়া ১০ টাকা সেখানে রাখা হচ্ছে ১৫টাকা।
অতিরিক্ত ভাড়া রোধে মালিক চালকের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য বিআরটিএ’র প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রীর নির্দেশ থাকলেও। কিন্তু কে শোনে কার কথা।
তবে মন্ত্রী বলেছেন, ‘গণপরিবহনের অতিরিক্ত ভাড়া বৃদ্ধির জন্য একমাত্র দায়ী মালিকরা। মালিকরাই অতিরিক্ত ভাড়া নির্ধারণ করে থাকেন। তাই এখন থেকে মালিকের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনী ও শান্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘বিআরটিসি বাসে অতিরিক্ত ১০ টাকা ভাড়া আদায়ের অভিযোগে বিআরটিসির চেয়ারমান মিজানুর রহমানের কাছে জানতে চেয়েছি কেন অতিরিক্ত ভাড়া নেয়া হচ্ছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা যদি আইন না মানে, তাহলে কীভাবে বেসরকারি বাস মালিকরা আইন মানবে? আগে আমাদের আইন মানতে হবে। পরে অপরকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে।’
সড়ক পরিবহনমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশলী বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, ‘এভাবে বক্তব্য দিয়ে কোনো লাভ হবে না। আইন করেও কোনো কিছুই করা যাচ্ছে। এজন্য প্রয়োজন বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমান যে গণপরিবহন ব্যবস্থা পদ্ধতি তার মূলে বিশৃঙ্খলা। তাই গোড়ায় যদি এলোমেলো থাকে তাহলে আগায় বিশৃঙ্খল হবেই।’
ঢাকা মহানগর বাস মালিক সমিতির সভাপতি খন্দকার এনায়েতউল্লাহ্ বলেন, ‘ আমার জানামতে অতিরিক্ত ভাড়া নয়, সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। তবে কোনো ট্রান্সপোর্ট অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করলে বিআরটিএর উচিৎ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। এক্ষেত্রে আমাদের কোনো বক্তব্য থাকবে না।’
বিআরটিএর সচিব শওকত আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমাদের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অব্যাহত আছে। অভিযানের বিষয়ে পরিবহন মালিক- শ্রমিকদের কোনো চাপ নেই। তবে জেল দেয়া হলো সর্বোচ্চ শাস্তি।’ তাই আগে ভুয়া সাইসেন্সের কাগজ জব্দ ও ডাম্পিংয়ের বিষয়গুলো প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে বলে তিনি জানান।
তিনি জানান, গত ১৭ অক্টোবর থেকে ২১ অক্টোবর পর্যন্ত অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিরুদ্ধে বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত ১ জনকে জেল, ৪৩টি যানবাহন ডাম্পিং ও ৩ লাখ ৭২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে বলে জানান তিনি। কিন্তু গত ১৮ অক্টোবরের পরেও আর কাউকে জেল বা জরিমানা করা হয়নি।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এমএএন ছিদ্দিক বলেন, ‘সড়ক পরিবহন সেক্টরে সুষ্ঠুভাবে পরিবহন সেক্টরে গড়ে তুলতে ‘সড়ক পরিবহন আইন’ প্রণয়ন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে একটি আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। আইনটির খসড়া অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে বলে সড়ক পরিবহন সচিব জানান। বাংলামেইল
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
শীতে যেসব খাবার খেলে শিশুরা সুস্থ থাকবে
শীতে ঠিক কোন-কোন নিয়ম মেনে চললে সন্তান দ্রুত সেরে উঠবে?বিস্তারিত পড়ুন
বিশেষ সম্মাননা পাচ্ছেন বেবী নাজনীন-জয়া
কালচারাল জার্নালিস্টস ফোরাম অব বাংলাদেশ (সিজেএফবি) বিশেষ সম্মাননা পুরস্কার পাচ্ছেনবিস্তারিত পড়ুন
বাগেরহাটে চাষ হচ্ছে ‘নেদারল্যান্ডের লিলিয়াম’
দেশের মাটিতে নতুন সংযোজন লিলিয়াম ফুল। এটি শীতপ্রধান দেশের হলেওবিস্তারিত পড়ুন