প্রধানমন্ত্রীর কপালে সেলাইয়ের দাগের পেছনে ‘দায়ী’ কে এই মন্ত্রী?
বহুল আলোচিত নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আইভী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেও দলের প্রভাবশালী নেতা শামীম ওসমান ও তার অনুসারীরা এটা মেনে নিতে পারেননি বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে।
গত মঙ্গলবার রাতে গণভবনে আইভী, শামীম ও তার অনুসারী তিন নেতাকে ডেকে কথা বলেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে। বৈঠক চলে আড়াই ঘণ্টারও বেশি। রাত ৮টায় শুরু হয়ে চলে সাড়ে ১০টা নাগাদ।
এ সময় তিনি ভেদাভেদ ভুলে আইভীকে জয়ী করতে শামীম ওসমানকে নির্দেশ দেন। বলেন, অন্যথা হলে তিন মেনে নেবেন না। দলের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমানকে এ সময় কঠোরভাবে সতর্কও করেন সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবারের ছেলে শামীমের প্রতি শেখ হাসিনার এই আচরণে বৈঠকে উপস্থিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের বিস্মিত করে। ওই বৈঠকে আইভী ছাড়াও নারায়ণগঞ্জের বেশ কয়েকটি কমিটির নেতা উপস্থিত ছিলেন, যাদের সবাই ছিলেন শামীম ওসমানের অনুগত।
বিএনপির ভোট বর্জনের মধ্যে গত নির্বাচনে শামীমকে এক লাখের বেশি ভোটে হারিয়ে মেয়র হয়েছিলেন আইভী। তখন আওয়ামী লীগ কাউকে আনুষ্ঠানিক সমর্থন না দিলেও কেন্দ্রীয় বেশ কয়েকজন নেতা শামীমের পক্ষে প্রচার চালিয়েছিলেন।
দলে বিরুদ্ধ স্রোতের মধ্যেই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়ে নামা আইভী ভোটে জয়ী হন; যদিও শামীমের দাবি, বিএনপির ভোট আইভীকে জয়ী হতে সহায়তা করে। তাদের দুজনের এই দ্বন্দ্ব পারিবারিক উত্তরাধিকার। ওসমানদের বিরোধী শিবির থেকে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান হয়েছিলেন আইভীর বাবা আলী আহমেদ চুনকা।
ভোটের পর ত্বকী হত্যাকাণ্ড এবং ৭ খুন নিয়ে আইভী ও শামীমের দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। প্রকাশ্যে সভায় একে অন্যের বিষোদগারের পাশাপাশি টেলিভিশন বিতর্কে তাদের মারমুখী ভূমিকায়ও দেখা যায়। গণভবনে বৈঠকে শেখ হাসিনার সামনেও তারা ঝগড়ায় জড়িয়েছিলেন বলে বৈঠকে উপস্থিত নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা বলেন, “আপনারা ধারণাই করতে পারছেন না যে, কালকের মিটিংয়ে কী হয়েছে। “২০১৪ সালের অগাস্ট মাসে টেলিভিশন টক শো-তে যা হয়েছিল, (মঙ্গলবার) মিটিংয়ে তাও ছাড়িয়ে গেছে। নেত্রী (শেখ হাসিনা) অনেক ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন।”
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একাধিক নেতা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আয়োজিত এ সমঝোতা বৈঠকের প্রথম পর্যায়ে দু’পক্ষের নেতাদের মধ্যে দফায় দফায় উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। মাঝেমধ্যে উভয়পক্ষ তাদের রাজনৈতিক অবস্থান ও শেখ হাসিনার প্রতি অগাধ আনুগত্যের কথা তুলে ধরেন। একপর্যায়ে মান-অভিমান ভাঙার পর্ব শুরু হয়। সেটিও চলে দীর্ঘক্ষণ। কান্না ও অভিমান পর্ব শেষে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। দীর্ঘদিনের বৈরিতা ভুলে শামীম ওসমান ও সেলিনা হায়াৎ আইভী পরস্পরের দিকে এগিয়ে যান।
বৈঠকে উপস্থিত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নেতা বলেন, শামীম ওসমান ৪০ মিনিট ধরে বক্তব্য দেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, আমার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কটূক্তি করা ছাড়াও আইভী আমার মায়ের কবর নিয়েও বাজে মন্তব্য করেছেন। সেগুলো আমি মুখবুজে সহ্য করে নিয়েছি। কিন্তু তিনি যখন আপনাকে উদ্দেশ করে বিরূপ মন্তব্য করেন তখন আমি স্থির থাকতে পারি না। কারণ আমি আসলে হাসিনা লীগ করি।
শামীম ওসমানের বক্তব্য শেষ হলে প্রধানমন্ত্রী তাকে বলেন, তুমি মোট ৪১ মিনিট কথা বলেছ। তোমার দীর্ঘ বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনেছি। তুমি জেনে রাখ, আমি নীলকণ্ঠ। নীলকণ্ঠর মতোই বিষ পান করেও তা হজম করতে পারি। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী তার কপালের ওপর থেকে চুল সরিয়ে ক্ষতচিহ্ন দেখিয়ে বলেন, আমার কপালের এ জায়গাটায় এখনও সেলাইয়ের দাগ আছে। কিন্তু তোমরা জান না এ সেলাইয়ের দাগ যার কারণে পড়েছিল তাকেও আমি বর্তমান মন্ত্রিসভায় রেখেছি। কারণ আমি ব্যক্তিগত লাভের জন্য রাজনীতি করি না। আমি দেশের মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছি। যেটা করেছিলেন আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রধানমন্ত্রী এমন আবেগঘন বক্তব্যের সময় গণভবনের বড় বৈঠকখানাজুড়ে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। উপস্থিত নেতাকর্মীদের কয়েকজনকে কাঁদতে দেখা যায়।
সূত্র জানায়, শুরুর দিকে শামীম ও আইভী পরস্পরের কাছ থেকে অনেকটাই দূরে বসেছিলেন। প্রথমেই বক্তব্য শুরু করেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মেয়র পদে মনোনয়নপ্রত্যাশী আনোয়ার হোসেন। তিনি দলের জন্য তার ত্যাগের ফিরিস্তি তুলে ধরেন। তিনি আইভীর বিরুদ্ধে জামায়াত-বিএনপি কানেকশনসহ দলীয় শৃংখলাভঙ্গের গুরুতর অভিযোগ করেন।
তিনি বলেন, দলীয় একটি কর্মসূচিতেও তাকে উপস্থিত করা যায়নি। শুধু জামায়াতবিরোধী স্লোগানের কারণে আইভী প্রধান অতিথি হিসেবে দলীয় সভায় উপস্থিত হতে রাজি হননি। তার বক্তব্যের মধ্যেই আইভী অভিযোগের তীব্র বিরোধিতা করে উঠে দাঁড়ান।
তিনি প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, এসব অভিযোগ মিথ্যা। এর সপক্ষে একটি প্রমাণও কেউ দিতে পারবে না। এ সময় নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা প্রমাণ হিসেবে কয়েকটি পত্রিকার কাটিং ও ভিডিও সিডি উপস্থাপন করেন।
নেতারা বলেন, আইভী সব সময় স্টান্টবাজি করেন। তথাকথিত সুশীলের বেশ ধরে তিনি নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের মধ্যে দুটি ধারা তৈরি করেছেন। এছাড়া বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগবিরোধী পত্রপত্রিকায় তিনি প্রকাশ্যে আপনার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। আইভী আসলে আওয়ামী লীগ নয় সুশীল নেত্রী। তাকে বাদ দিয়ে তৃণমূলের সুপারিশের ভিত্তিতে দলীয় মনোনয়ন দেয়ার দাবি জানানো হয়।
এ সময় আইভী বলে ওঠেন, সব মিথ্যা। সব মিথ্যা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমাকে নির্বাচনে পরাজিত করতেই এসব কথা বলা হচ্ছে। নির্বাচনে আমি হারলেই যদি এরা খুশি হন তবে তাই হোক। আমি নির্বাচন করব না। বক্তব্য দিতে দিতে আইভী সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। তিনি বলেন, আমি চলে যাচ্ছি। আমি নির্বাচন করব না। দল আনোয়ার কাকাকে বা অন্য কাউকে মনোনয়ন দিক। তবে দরজার কাছাকাছি যাওয়ার আগেই আইভীর হাত ধরে টেনে আনেন সাবেক মন্ত্রী দীপু মনি। তিনি আইভীকে শান্ত থাকার অনুরোধ জানান।
এ সময় শামীম ওসমান বলেন, আইভী সব সময় এমন অসহিষ্ণু আচরণ করেন। তিনি আসলে স্বাধীনতাবিরোধীদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন। তা না হলে বর্তমান সরকারকে যারা বেকায়দায় ফেলতে চায় তাদের পত্রিকার গোলটেবিলে যান কেন তিনি? সেসব গোলটেবিলে কী আলোচনা হয় তা আমরা জানি।
এ সময় নেতারা বলেন, কই আইভী তো একবারের জন্যও নেত্রীর কাছে তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাননি। তাই আইভীকে মনোনয়ন দিলে তৃণমূল নেতাকর্মীরা মেনে নেবে না। এ পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কেউ যদি ক্ষমা না চায় তবে বলে কয়ে কি কাউকে ক্ষমা চাওয়ানো যায়? তাছাড়া খেলায় জিততে গেলে অনেক সময় খেলোয়াড় হায়ার (ভাড়া) করতে হয়। আপনারা ধরে নেন নির্বাচনে জেতার জন্য সুশীলের কাছ থেকে আমরা আইভীকে হায়ার করলাম।
বৈঠকে আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, আপা শামীমকে ধন্যবাদ দিতেই হবে। কারণ আমি তাকে নিয়ে বসেছি। আমি দলের স্বার্থে তাকে দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার অনুরোধ করেছি। তিনি রেখেছেন। শামীম আমাকে বলেছেন, নেত্রী তাকে যা কোরবানি দিতে বলবেন তিনি তাই দেবেন। আপনার সিদ্ধান্তের বাইরে তিনি যাবেন না। তাই তাকেও সম্মানিত করা দরকার। শামীম দলের একনিষ্ঠ কর্মী। দলের জন্য তার অনেক ত্যাগ রয়েছে।
বৈঠকের শেষদিকে শামীম ওসমান প্রধানমন্ত্রীর কাছে যান। প্রধানমন্ত্রীকে তিনি বলেন, আপা আমার ভুল হয়ে থাকলে আমাকে একটা থাপ্পড় দেন। প্রধানমন্ত্রী স্নেহময়ী কণ্ঠে বলেন, তোকে কেন থাপ্পড় দিতে যাব? তখন শামীম ওসমান নিজেই প্রধানমন্ত্রীর হাত টেনে নিয়ে নিজের গালের ওপর রাখেন। কপট রসিকতায় বলেন, উহ খুব লেগেছে। শামীম ওসমানের এই হালকা রসিকতায় বৈঠকের আবহ হালকা হয়ে আসে।
একপর্যায়ে সেলিনা হায়াৎ আইভীর মাথায় হাত রেখে শামীম ওসমান তাকে বলেন, ছোট বোন তুমি চিন্তা কর না। নিশ্চিন্তে বাড়ি যাও। আমি তোমার নির্বাচন করে দিচ্ছি। আমি আওয়ামী লীগ নয়, শেখ হাসিনা লীগ করি। নেত্রী আমাকে তোমার পক্ষে কাজ করতে বলেছেন। আমি তোমার পক্ষেই কাজ করব। কারণ নৌকা জয়ী হলে শেখ হাসিনার বিজয় হবে।
শামীম ওসমান বলেন, আমরা সবাই নৌকার কর্মী। নৌকার যাত্রীদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
ধর্ষণের অভিযোগের তদন্ত চলায় এমবাপ্পেকে বিজ্ঞাপন থেকে সরাল রিয়াল
আর্থিক দ্বন্দ্বের মধ্যে পিএসজি ছেড়ে রিয়াল মাদ্রিদে আসার পর একেরবিস্তারিত পড়ুন
মিয়ানমারে বন্যায় মৃতের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে ২২৬
ঘূর্ণিঝড় ইয়াগির প্রভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমারে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণেবিস্তারিত পড়ুন
ইসরাইলি হামলায় আরও ৩৮ ফিলিস্তিনি নিহত
গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলি বাহিনীর তান্ডবে প্রাণ গেছে আরও ৩৮বিস্তারিত পড়ুন