প্রাণ নেয়, প্রাণ বাঁচায় এসব বিষাক্ত প্রাণী
পৃথিবীতে বিষাক্ত প্রাণীদের অভাব নেই। এদের বিষ মানেই দুঃস্বপ্নের মৃত্যু। ওডিসিউস এবং টেলিভিশনের ওয়াইল্ডলাইফ বিশেষজ্ঞ স্টিভ ইরউইন দুজনের মধ্যে কোন ঘটনাটি সাধারণ? এরা দুজনই স্টিংরের লেজের আঘাতে মৃত্যুবরণ করেছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত প্রাণী কোনটি? এটা অস্ট্রেলিয়ান বক্স জেলিফিশ। কোবরার বিষ দেহে প্রবেশ করলে কেমন লাগে? যার গেছে সেই জানে। এসব বিষ জীবন নিয়ে নিলেও এগুলো জীবন বাঁচাতেও কাজে লাগে।
বিষ নিয়ে কিছু বিস্ময়কর তথ্য তুলে ধরেছেন ক্রিস্টি উইলকক্স। তিনি জানিয়েছেন, কিভাবে পৃথিবীর এসব প্রাণঘাতী বিষাক্ত প্রাণী বায়োকেমিস্ট্রিকে সমৃদ্ধ করেছে। কিং কোবরার বিষ কিভাবে পূর্বপুরুষদের মস্তিষ্ককে আরো বড় করেছে। অনেক বিষ ডায়াবেটিস এবং আলঝেইমার্স রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
এ পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত ৫টি প্রাণী কোনগুলো? প্রশ্নটি বেশ ভালো লাগে ক্রিস্টির। বললেন, সাধারণত সাপদের এ তালিকায় আনা হয়। কারণ তাদের কামড়ে প্রতিবছর গোটা বিশ্বে ৯০ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। এ ছাড়া বিকলাঙ্গ করে দেয় অসংখ্য মানুষকে। আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা, ইন্ডিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকায় সাপের কামড়ে বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এসব দেশে বিষাক্ত সাপের আনাগোনা বেশি। এসব বিষে যে কেবল মানুষ মারা যায় তাই নয়, এসব বিষ দিয়েই বিশ্বের সেরা অ্যান্টিভেমন তৈরি করা হয়।
এ তালিকার শীর্ষে রয়েছে কিং কোবরা। অন্য সাপদের তুলনায় যে এদের বিষ খুব বেশি মূল্যবান তা নয়। তবে বিশাল আকারের সাপটি প্রচুর বিষ উৎপন্ন করতে পারে।
অস্ট্রেলিয়ান বক্স জেলিফিশের কথা বলতেই হবে। এদের বিষয় মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যে মানুষকে মেরে ফেলতে পারে। আবার কনাস জিওগ্রাফাস নামের শামুকের বিষে ফাটালিটি রেট ৭০-৮০ শতাংশ হয়ে থাকে। তবে সুখবরটি হলো, এটি সচরাচর চোখে পড়ে না।
আরো আছে লনোমিয়া ক্যাটারপিলার। খুব ছোট এবং লোমশ একটি শুঁয়োপোকা এটি। কিন্তু এর বিষে মারাত্মক হেমারেজ ঘটে যেতে পারে।
তবে এক নম্বরে রাখা যায় মশাকে, জানান ক্রিস্টি। এটি বলার বিশেষ কারণও রয়েছে। যখন বিষাক্ত প্রাণীর কথা বলা হয়, তখন মানুষের জন্য বিষাক্ত হিসাব করে বলা হয়। অন্য কিছু হিসাব করা হয় না। সে ক্ষেত্রে মানুষের জন্যে এ পৃথিবীর সবচেয়ে মারাত্মক প্রাণী হতে পারে মশা।
ভাইপার পরিবারের সাপ নিষ্ঠুরভাবে মারে। নেক্রোসিস ঘটে। নেক্রোসিস হলো টিস্যুর মৃত্যু। আসলে টিস্যুর মৃত্যু কতটা ভয়ানক তার সম্পর্কে ধারণা নেই আমাদের। সাধারণত মনে হয়, ভেতরে মাংস ও টিস্যু গলে পড়ছে। আসলে নেক্রোসিস দুই স্তরের প্রক্রিয়া। প্রথমে বিষ তার এনজাইম নিয়ে টিস্যুতে আক্রমণ করে। এর কাজ টিস্যুগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা এ আক্রমণ সামাল দিতে পারে না।
আবার সাপের বিষের ইতিবাচক দিকও রয়েছে। বড় বড় আবিষ্কারের পেছনে কাজ করেছে এসব বিষ। প্রাচীন আমল থেকেই সাপ এমন এক ঘাতক যা সব সময় মানুষের আতঙ্কের কারণ ছিল। সাপ মানুষের মস্তিষ্কে প্রবেশ করেছে সেই প্রাচীনকাল থেকেই। দূর থেকেও এক ঝলক দেখেই বলে দেওয়া যায় ওটা একটা সাপ। মানুষকে কয়েক মাইক্রোসেকেন্ডের জন্য সাপের ছবি দেখালেই মনের মধ্যে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
সাপের বিষ নানা নতুন নতুন কাজে লাগতে শুরু করেছে। অ্যাপিথেরাপির কাজে লাগে। এ ছাড়া সংক্রমণে সৃষ্ট লাইম ডিজিসের চিকিৎসাতেও সাপের বিষ ব্যবহৃত হয়।
এ ক্ষেত্রে এলি লোবেলের কথা না বললেই নয়। এই নারী লাইম ডিজিসের চিকিৎসায় মৌমাছির বিষ নিয়ে ফলপ্রসূ গবেষণা করেছেন। এদের বিষে রয়েছে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল। আঁকাবাঁকা আকৃতির ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে লাইম ডিজিস ঘটে। এদের মেরে ফেলা খুব কঠিন বিষয়। কিন্তু মৌমাছির বিষে এই ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলা সম্ভব। তার নিজেই লাইম ডিজিসে আক্রান্ত ছিলেন। অনেক চিকিৎসার পর হাল ছেড়ে দেন এবং ক্যালিফোর্নিয়ায় গিয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করতে থাকেন। একদিন হাঁটছিলেন রাস্তায়। হঠাৎ একটি মৌমাছি এসে তাকে কামড়ে দেয়। এর সপ্তাহখানেক বাদে তিনি খেয়াল করলেন যে তার অনেক ভালো লাগছে। ভাবলেন ওই মৌমাছির বিষ লাইম ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলেছে। এ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন তিনি।
যারা নিজ গৃহে বিষাক্ত প্রাণী রাখতে চান তার এদের থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখতে চান। সংস্কৃতিভেদে অনেক মানুষ আছে যারা কোবরা বা ভাইপারকে গৃহপালিত প্রাণী বলে মনে করে। এদের কামড় খাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। বাঁচতে অ্যান্টিভেনম প্রয়োজন। কিন্তু এটি বেশ দামি। তাই তারা বিষ থেকে বাঁচতে সামান্য পরিমাণ বিষ নিজেদের দেহে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করে। ধীরে ধীরে ডোজ বাড়িয়ে নেয়। এতে রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা বিষয়ের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। পদ্ধতিটা বেশ বিদঘুটে। কিন্তু তারা এ কাজটি বেশ নিরাপদ ও কার্যকর উপায়ে সম্পন্ন করতে পারেন। বিজ্ঞানীরা তাদের দেহের অ্যান্টিবডি নিয়ে পরীক্ষা করছেন। এই অ্যান্টিবডিগুলো অ্যান্টিভেনম হিসাবে কাজ করে।
কিছু প্রাণীর রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা অনেক বিষকে সামাল দিতে পারে। যেমন- হানি ব্যাজাররা সাপের বিষ সহ্য করতে পারে। হাজারো মৌমাছির কামড়েও তাদের কিছু হয় না। মনগুজ এবং অপোসাম একই ধরনের প্রাণী। তবে এদের কোনটাই শতভাগ বিষপ্রতিরোধী প্রাণী নয়। তবে অন্যদের চেয়ে উচ্চমাত্রার বিষ সহ্য করতে পারে।
দক্ষিণ-পশ্চিম আমেরিকায় গিলা মনস্টাররা রীতিমতো কিংবদন্তি হয়ে রয়েছে। তাদের বিষের বহুগুণ রয়েছে। মূলত বিষাক্ত প্রাণীদের বিষ ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে মহামূল্যবান জিনিস। স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন সমস্যা দূরীকরণের সমাধান রয়েছে বিষের উপাদানে। গিলা মনস্টারদের বিষ অনেক গুরুত্বপূর্ণ মলিকিউল দিয়েছে। তাদের আছে ইনসুলিনের মতোই মলিকিউল। এর মাধ্যমে দেহের ইনসুলিনের মাত্রা ঠিকঠাক রাখা যায়। এদের বিষ টাইপ ২ ডায়াবেটিসের চিকিৎসাব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
এখন বিভিন্ন বিষের মলিকিউল দিয়ে হৃদরোগ থেকে আলঝেইমার্স কিংবা এইচআইভি’র চিকিৎসার চিন্তা করছেন বিজ্ঞানীরা। তাই বিষাক্ত প্রাণীগুলো মানুষের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। কার বিষে কি রয়েছে তা এখনো জানে না মানুষ। হয়তো এসব প্রাণঘাতী বিষেই রয়েছে প্রাণ বাঁচানোর উপাদান। সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফি
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
পৃথিবীর সব প্রাণী ধ্বংস হবে কবে, জানালেন বিজ্ঞানীরা
পৃথিবীতে কোনো প্রাণী বা প্রজাতিই স্থায়ী নয়। একদিন না একদিনবিস্তারিত পড়ুন
এটিএম থেকে টাকার পরিবর্তে কী বের হচ্ছে?
এটিএম বুথের মেশিন থেকে টাকাই তো বের হওয়ার কথা। কিন্তুবিস্তারিত পড়ুন
৩৩ বছরে ছুটি নিয়েছেন মাত্র একদিন
১৯৪০-এ ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে নার্সিংয়ে হাতেখড়ি। দু’টি বিশ্বযুদ্ধ, ২৪ বার প্রধানমন্ত্রীবিস্তারিত পড়ুন