ভুল করে, ভুল জলে খালেদা!
ইদানিং খালেদা জিয়ার চেহারার অবস্থা খেয়াল করেছেন? এ যেন অচেনা এক খালেদা! এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সেদিনের গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে নামা সেই তেজোদ্বীপ্ত খালেদা স্বভাবতই আর নেই! বয়স সত্তুরে গড়ালেও বিএনপির পুতুল নামের চেয়ারপার্সন এখনো তার চিরায়ত ফ্যাশন সচেতনতায় চিকন করে ভ্রু আঁকেন। কিন্তু তাকে দেখে এখন খুব স্বাভাবিক মনে হবে যেন তিনি আর পারছেন না! এ এক ক্লান্ত বিধবস্ত, অথবা অসুস্থতায় ভারাক্রান্ত অন্য এক খালেদা জিয়া!
তার চোখ দুটো যেন রাজ্যের ঘুম অথবা ক্লান্তিতে বন্ধ হয়ে যেতে চাইছে! কিন্তু বিএনপিতে তার বিকল্প কেউ নেই বলে জোর করে চালিয়ে যাচ্ছেন দায়িত্ব! এই খালেদার অসুস্থতা শারীরিক এবং মানসিক। মানসিক অসুস্থতার কারণ হতাশা। অনভ্যস্ত খালেদা জিয়া অনেক দিন ধরে ক্ষমতার বাইরে। ক্ষমতা একজন রাজনীতিকের জন্য শারীরিক-মানসিক সুস্থতার জন্যে কত বড় দাওয়াই তা বিচারপতি সাত্তারের কথা যাদের মনে আছে তারা তা মনে করতে পারেন।
জিয়ার মৃত্যুর সময় অসুস্থ বিচারপতি সাত্তার হাসপাতালে শয্যাশায়ী। ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারেন না! কিন্তু যেই তাকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ করিয়ে দেয়া হয় ক্ষমতার জীয়নকাঠির স্পর্শে সেই সাত্তারই হঠাৎ বদলে যান! সেই বিচারপতি সাত্তারই সারাদেশ ঘুরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রচারণায় অংশ নেন!
তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার এখন বিরোধীদলের সম্মান, প্রটোকলও নেই। আন্দোলনের নেতৃত্বেও তিনি চরমভাবে ব্যর্থ। তার মন-শরীর-স্বাস্থ্য ভালো থাকারতো কথা নয়। রাজনীতিতে আসার শুরুর দিনগুলোতে খালেদার একটা গুণের কথা নিয়ে বেশ আলোচনা হতো। তাহলো তিনি কথা বলেন কম। শোনেন বেশি। তাই তিনি ভুল করেন কম। অথবা পড়াশুনা অভিজ্ঞতার বিষয়ে তিনি অবহিত বলেই কথা কম বলতেন। শুরুর দিকে জনসভার মঞ্চেও লেখা বক্তৃতায় চোখ রেখে বক্তৃতা দিতেন। শফিক রেহমান আমাকে একবার বলেছেন, ‘আমি খালেদার বক্তৃতা লিখি। আমার লেখা বক্তৃতা পাবলিক খায় বেশি’।
কিন্তু সেই খালেদা এখন আর নেই। দলের পোড়খাওয়া নেতা-উপদেষ্টাদের বদলে তার উপদেষ্টা এখন ছেলে তারেক রহমান! অতএব খালেদা জিয়ার যা হবার তা হচ্ছে! একদা কম কথার জন্য যিনি কম ভুল করতেন এখন তিনি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় না থাকার রাগে-ক্ষোভে-হতাশায় এবং বয়সজনিত ক্লান্তি-অবসাদে বক্তৃতার মাঝখানে বা যে কোনো প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়েই রেগে যাচ্ছেন! বাংলায় একটা কথা আছে, রেগে গেলেনতো হেরে গেলেন! খালেদা এভাবে বারবার রেগে গিয়ে হেরে যাচ্ছেন!
গণজাগরণ মঞ্চে ওঠার চেষ্টা বিএনপি কম করেনি। বিএনপি সমর্থক অনেক লোকজনও গণজাগরণ মঞ্চের মহাসমুদ্রে যোগ দিয়েছিলেন। গণজাগরণ মঞ্চের সেই উত্তাল সতেরো দিনে দেশে-বিদেশে যে উথালপাথাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকলে কারো কি গণজাগরণ মঞ্চের বিপক্ষে যাওয়া সম্ভব ছিল? শুধু খালেদা জিয়া ছাড়া!
কারণ একাত্তরে এবং এখনো নানাভাবে তার কথায়-আচরণে প্রকাশ হয়ে যায় যে, খালেদা জিয়া আসলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কেউ না। তাই সাকা চৌধুরীর পরিবার দেখা করে তার সঙ্গে আর শহীদের সন্তানরা দেখা করেন শেখ হাসিনার সঙ্গে। তাই গণজাগরণ মঞ্চের সেই সময়েও সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে রেগেমেগে খালেদা জিয়া নিলেন তার আসল চেহারা! বক্তৃতা দিয়ে বললেন, কিসের গণজাগরণ! ওখানে একদল নাস্তিকের সমাবেশ হয়েছে! ওখানে সবাই গাজা খায়!
ব্যস বিএনপির লোকজন গণজাগরণ মঞ্চের ওখান থেকে সরে গেলো! শুরু হলো ব্লগার হত্যা। ক্ষমতায় যাবার সহজ পথ মনে করে খালেদা দাঁড়ালেন হেফাজতের মোল্লাদের পিছনে! কিন্তু খালেদার হেফাজত মোহভঙ্গেও সময় লাগেনি! কারণ হেফাজতের হুজুর বলে বসলেন মহিলাদের তথা খালেদাদের দেখলেও তার মুখ দিয়ে তেঁতুলের মতো লালা ঝরে!
খালেদার আরেক আলোচিত ধমক ছিল গোপালগঞ্জের নাম নিয়ে! তার বাসার বাইরে পুলিশের বালির ট্রাক, মহিলা পুলিশ দেখে রেগেমেগে তাদের কাছে জানতে চান, বাড়ি কই গোপালি? ক্ষমতায় গেলে গোপালগঞ্জ জেলার নামই বদলে ফেলবেন! আরেক রাগি বক্তৃতা ছিল তাকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের দিন! সেনা সদস্যদের সেদিন তিনি হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, ক্ষমতায় গেলে তাদের একজনকেও আস্ত রাখবেন না!
এক সময়ের আপোষহীন নেত্রীকে সেদিন বাড়ি হারানোর শোকে যেভাবে হাউমাউ কাঁদতে দেখা গেছে তা এর আগে কেউ দেখেনি! সেই কান্নার ছবিটি তার জন্যে নেগেটিভ হয়। কারণ ওই বাড়িটি আওয়ামী লীগের কেউ দখল করেনি। সেখানে গড়ে উঠেছে অনেক সেনা কর্মকর্তার কোয়ার্টার। এমন যতবার খালেদা জিয়া রেগে গেছেন ততবার হেরে গেছেন তিনি!
এবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর তার জন্যে একটা শোক কর্মসূচিও পালন করেনি বিএনপি! একটা মিলাদও দেয়নি অথবা স্থায়ী কমিটির বৈঠকে একবার হাত উঠিয়ে তার জন্যে মোনাজাতও করা হয়নি! যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে মুখে যতই কথা বলুক বিএনপি, বিষয়টি যে তাদের জন্যেও স্বস্তিকর নয়, তা সাকার ফাঁসির পর বিএনপির অবস্থানে আরও স্পষ্ট হয়েছে। সেই বিএনপি হঠাৎ মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ ডাকলো একটা হলের মধ্যে! সেই সভায় হালের বিএনপির মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী খালেদা জিয়াকে বললেন, ড. কামাল হোসেন, আ স ম আব্দুর রব, কাদের সিদ্দিকীদের ডেকে তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে এবং তাদের নিয়ে জোট তৈরি করতে।
আর ক্লান্ত বিধবস্ত খালেদা জিয়া তার ছেলের ইতিহাস চর্চার অনুষ্ঠানে বলে গেলেন তার স্বামী যে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, স্বাধীনতার পরও চাকরি করেছেন যে বঙ্গবন্ধু সরকারের অধীনে, বাঙ্গালির মুক্তিযুদ্ধের নেতা বঙ্গবন্ধুই নাকি বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দেশি-বিদেশি কোন দলিলে আছে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা চাননি? না দেশি-বিদেশি সব দলিল-দস্তাবেজে স্বাধীনতার একচ্ছত্র নেতা হিসাবে শুধু আছে বঙ্গবন্ধুরই নাম। এগুলোর কোথাও কোনাকাঞ্চি দিয়েও জিয়া বা অন্য কারো নাম লেখা আছে কী?
এরপর ক্ষমতার বাইরে থাকতে থাকতে রাগান্বিত, ক্লান্ত-বিধ্বস্ত খালেদা জিয়া টান দিয়ে বসেন মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গাটায়! যেখানে ক্ষমতায় থাকতে বক্তৃতা-বিবৃতিতে তিনিও ত্রিশ লাখ শহীদের কথা উল্লেখ করতেন, আর এখন বলে বসলেন, ‘বলা হয় লক্ষ লক্ষ লোক শহীদ হয়েছে, কিন্তু এ নিয়েও বিতর্ক আছে!’ পাকিস্তান আর জামায়াত ছাড়া আর কেউ কি কখনো এ লাইনে কথা বলে? সাম্প্রতিক বিএনপির মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী সাহেব, এরপরও কি এই খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা নেতাদের ঐক্য আশা করেন? না পাকিস্তানপন্থীদের? খালেদার হঠাৎ এই বক্তৃতায় বিএনপির প্রতিদিনের বাগ্মী নেতারা কি পরিমাণ বিব্রত তা গত দু’দিনে বেশ বোঝা গেছে।
সবাই পৌরসভা নির্বাচনের নানা বিষয় নিয়ে ব্যস্ত, কিন্তু খালেদা জিয়া ব্যস্ত মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে! ২০০৮ সালের নির্বাচনে এই ইস্যুতেই বিপুল হেরেছে বিএনপি। আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকারসহ নির্বাচন করেছে আর বিএনপি নির্বাচন করেছে যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে! দেশের সিংভাগ ভোটার, বিশেষ করে তরুণ ভোটাররা তখন আওয়ামী লীগের পক্ষ নিয়েছে। আর এখনও আওয়ামী লীগের ওপর নাখোশ অনেকে শুধু যুদ্ধাপরাধী বিচার ইস্যুতেই বিএনপির ক্ষমতায় ফেরা চান না।
ক্ষমতায় থাকতে যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেনি, শহীদ জননী জাহানারা ইমামদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দিয়েছে আর সেই যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে নিয়ে সব সময় বলে গেছে, আমরাও বিচার চাই তবে এই বিচার হতে হবে স্বচ্ছ, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন! আওয়ামী লীগের নানা ব্যর্থতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের কত লোক যে শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে বিএনপির পক্ষে দাঁড়াতে পারে না, মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের অবজ্ঞা-কটাক্ষ করে খালেদা জিয়ার এই বক্তব্য তাদের বিএনপির বিরুদ্ধে আরও স্পর্শকাতর করবে।
খালেদার এই বক্তব্য তাকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নেত্রী না পাকিস্তানপন্থী নেত্রী হিসেবে আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করবে। এতে আরও পোয়াবারো হয়ে গেলো আওয়ামী লীগের। কারণ কোনো প্রকাশ্য পাকিস্তানপন্থী নেত্রী দেশের ক্ষমতায় বসবেন অথবা ফিরবেন এটা শুধু বাংলাদেশের মানুষ না, ভারতও চাইবে না। এই ভারতীয় আশীর্বাদের আশায় গত বেশ কিছুদিন ধরে বিজেপির অমিত শাহ’র ফোন কেলেংকারি থেকে শুরু করে হেন চেষ্টা নেই যা বিএনপি করেনি! বিএনপির আশাহত কবিগণ এখন মনের দু:খে কোরাস গাইতেই পারেন, ‘খালেদা ভুল করে নেমেছে ভুল জলে!’ ‘চ্যানেল আই’
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
ফের ২ দিন রিমান্ডে আনিসুল হক
রাজধানীর বাড্ডা থানার স্বেচ্ছাসেবকদল নেতা আল-আমিন হত্যা মামলায় সাবেক আইনমন্ত্রীবিস্তারিত পড়ুন
আমির খসরু: নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণকে দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দিতে হবে
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, “গণতন্ত্রেরবিস্তারিত পড়ুন
জামিন পেলেন সাবেক বিচারপতি মানিক
অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশের সময় সিলেটের কানাইঘাটের ডোনা সীমান্ত এলাকা থেকেবিস্তারিত পড়ুন