মাঠ কাঁপানো আ.লীগ নেতার ভিক্ষাবৃত্তি অতঃপর করুণ মৃত্যু
৯০ এর দশকে মাঠ কাঁপানো আওয়ামী লীগ নেতা হাশেম আলীকে (৬৫) আর ভিক্ষা করতে হয় না। চাইতে হবে না কারো কাছে সাহায্য। বার বার প্রিয় দল আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরক্তও করবেন না তিনি। কারণ এই মানুষটি আর পৃথিবীতে নেই। জীবনের শেষ সময়ে এসে ভিক্ষাবৃত্তি করে সংসার চালানোর কারণে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন তিনি। তার মৃত্যুর খবর জানেন না আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী। অথচ হাশেম আলী ছিলেন পারবর্তীপুর উপজেলা হর্কাস লীগের সভাপতি এবং পরবর্তী সময়ে পৌরসভা নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করেন তিনি।
মৃত্যুর আগে হাশেম আলী তার ছেলে মেয়েদের বলে গেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকতে। বলে গেছেন শত কষ্টের মধ্যেও রাজনীতি করার কথা। গত ২৬ জানুয়ারি হাশেম আলীর মৃত্যু হলেও এখবরটি জানেনা পারবর্তীপুরের অনেকেই। মৃত্যুর খবরটি স্থান পায়নি কোনো মিডিয়াতেও।
গত মঙ্গলবার এই প্রতিবেদক হাশেম আলীর বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে এক সময় পেয়েও যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন ৩৮ দিন আগে মৃত্যু হয়েছে ওই মানুষটির। হাশেম আলী পার্বতীপুর পৌর এলাকার ধুপিপাড়া মহলার বাসিন্দা ছিলেন।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পারবর্তীপুর রেলওয়ে স্টেশনের ১নং প্লাটফরমে শুয়ে শুয়ে ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তিনি। দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে যাওয়ার সময় হাশেম আলী রেখে গেছেন এক ছন্নছাড়া পরিবার। স্ত্রীতো এক সন্তানকে নিয়ে অনেক আগেই তাকে ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন রাজধানীর ঢাকায়। তিনি স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়েছেন কিনা সেটাও জানেন না পরিবারের অন্য সদস্যরা।
এদিকে বাবার মৃত্যুর পর তার ছেলে মেয়েরা অসহায় মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। আগামী ৫ মার্চ বাবার মৃত্যুর ৪০ দিন পূর্ণ হবে। কীভাবে তারা বাবার জন্য দোয়া খায়ের করবেন তা নিয়ে চিন্তিত পরিবারের সবাই।
সুস্থ থাকাবস্থায় ভালোই চলছিল হাশেম আলীর সংসার। তখন অনেক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে ছিল তার উঠাবসা। এরপর আস্তে আস্তে যখন তিনি অসুস্থ হতে শুরু করলেন সবার সঙ্গে সম্পর্কও বিচ্ছিন্ন হতে শুরু হয় তার। এক পর্যায়ে সংসারে তার চরম অভাব অনটন দেখা দিতে শুরু করে। একদিকে অসুস্থতা অন্যদিকে অভাব। কোনো দিক সামলাতে পারেন নি তিনি। ঠিক এই সময়টাতে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি কেউই। এক পর্যায়ে সংসারের ভার টানতে এক সময় নেমে পড়েন ভিক্ষাবৃত্তিতে। তার ভিক্ষাবৃত্তির সংবাদ মাঠ কাঁপানো আ.লীগ নেতা এখন ভিক্ষুক অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হলেও তাকে সহযোগিতার ক্ষেত্রে হাত বাড়ায়নি কেউ। এভাবে ভিক্ষাবৃত্তির এক পর্যায়ে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেন হাশেম আলী। তখনও হাজির হয়নি আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মী।
গত মঙ্গলবার দুপুরে যখন এই প্রতিবেদক পার্বতীপুরে হাশেম আলীর খোঁজ নিতে যায় প্রথমে তাকে কেউ চিনতে পারছিলেন না। এরপর সিরাজুল ইসলাম নামে এক প্রতিবেশি হাশেম আলীকে খোঁজ করতে দেখে এ প্রতিবেদককে সরকারি অফিসের লোক মনে করে কাছে এসে জানালেন, হাশেম আলী পারবর্তীপুর পৌরসভায় বক মার্কা নিয়ে কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করেছিলেন। তখন থেকে সবাই তাকে বক হাশেম নামেই চেনে। তাকে খুঁজতে হলে বক হাশেম বলতে হবে তাহলে সবাই চিনবে।
পরবর্তীতে বক হাশেমের খোঁজ করতে গিয়ে ধুপিপাড়ায় ফুপা আমীর আলীর বাড়িতে গিয়ে দেখা মেলে জীবনের শেষ সময়গুলোতে পাশে থাকা তার সবচেয়ে ছোট মেয়ে ৮ম শ্রেণির ছাত্রী হাসি আকতার হেনার।
সেখানে হাসি এ প্রতিবেদককে তার বাবা মৃত্যুর আগের করুণ কাহিণীর কথাগুলো জানায়।
দলীয় বা সরকারিভাবে কোনো সহায়তা পেয়েছে কিনা জানতে চাইলে হাসি জানায়, তার বাবার জানাজা নামাজের সময় উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পার্বতীপুর পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল ওহাব সরকার বলেছিলেন বাবার নামে আড়াই লাখ টাকা সরকারি অনুদান দেয়া হয়েছে। সে টাকা কোথায় গেল। কেন হাশেম বিনা চিকিৎসায় মারা গেল। কিন্তু এ টাকার হদিস আমাদের পরিবারের কেউ জানেনা।
হাসি জানায়, টাকার অভাবে তার লেখাপড়া বন্ধের পথে। সে গত ১০ দিন ধরে স্কুলে যেতে পারেনি।
এক পর্যায়ে সে ক্ষোভের সঙ্গে জানায়, যে আওয়ামী লীগের জন্য তার বাবা নিবেদিত প্রাণ ছিল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার বাবা যে আদর্শে বিশ্বাসী থেকে মৃত্যুবরণ করেছে সেই আওয়ামী লীগের কথা সে আর শুনতে চায়না।
এরপর সেখান থেকে হাশেমের ছেলে সেলিমের রেলওয়ের বস্তি সাহেবপাড়ার বাসায় গিয়ে তো অবাক হয়ে যায় এ প্রতিবেদক। বাড়ি বলতে সুফিয়া কামালের লেখা আসমানি কবিতার মতো একটি ঝুপড়ি ঘর। যার মধ্যে বসবাস করেন হাশেমের বড় ছেলে সেলিম, তার স্ত্রী, এক বিধবা বোন এবং ৮ম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে হাসি আকতার হেনা। জায়গাটিও তাদের নিজস্ব নয়। রেলওয়ের জায়গা।
সেখানে কথা হয় হাশেম আলীর বিধবা মেয়ে মায়ার সঙ্গে। মায়া জানায়, আগামী ৫ মার্চ তার মৃত্যুর ৪০ দিন পূরণ হবে। এদিন বাবার কুলখানি করা দরকার। কিন্তু কি যে হবে জানেন না তিনি। অথচ বাবার নামে নাকি আড়াই লাখ টাকা দিয়েছে সরকার। ওই টাকাতো পাইনি আমরা।
বাড়িতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও বড় ছেলে সেলিমকে পাওয়া যায়নি। সেলিমের স্ত্রী মিনা জানায়, তার স্বামী কাগজ কুড়াতে গেছে। সারাদিন পুরাতন কাগজ ও প্লাস্টিক কুড়িয়ে বিকেলে বিক্রি করে যা পায় তা দিয়ে তাদের সংসার চলে।
হাশেমের ছেলে মেয়েরা এখন প্রায় বিচ্ছিন্নভাবে রয়েছেন। স্বামীকে অসুস্থ অবস্থায় ফেলে রেখে ছেলে চঞ্চলকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় চলে যান হাশেমের স্ত্রী সেলিনা আকতার। সাত ছেলে মেয়ের মধ্যে অপর ছেলে কাঞ্চন ভারতের জেলে বন্দি রয়েছেন। চোরাই পথে ভারতে গিয়ে ধরা পড়েছে সে। বোনদের মধ্যে দুই বোন তাদের শ্বশুর বাড়িতে রয়েছে। এক বোন বিধবা হয়ে সেলিমের বাড়িতে আর ছোট বোন হাসি পড়ালেখা করছে।
যেখানে হাশেম ভিক্ষা করতো সেই পার্বতীপুর রেলওয়ে স্টেশনের ১নং প্লাটফর্মে গিয়ে দেখা মিলে পার্বতীপুর মহিলা শ্রমীক লীগের নেত্রী রেখা পারভীনের।
রেখা পারভীন বলেন, ভাই আমি হাশেম ভাইয়ের শেষ দিনগুলো দেখেছি। কি কষ্টে যে তার দিন কেটেছে তা একমাত্র আল্লাহ জানে। বিপদের সময় কেউ তার পাশে দাঁড়ায়নি। আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন একটি হুইল চেয়ার কিনে দিয়েছিলেন। সেটা বসেই হাশেম ভাই ভিক্ষা করতেন।
রেখা পারভিন পরিবারটির পাশে দাঁড়ানোর জন্য সরকারসহ উচ্চ মহলের সু-দৃষ্টি কামনা করেন।
স্থানীয় কাউন্সিলর মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জু জানান, হাশেমের পরিবারটি বর্তমানে অসহায়ভাবে জীবন যাপন করছে। পরিবারটিকে সহায়তা দেয়ার জন্য দলমত নির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসা দরকার।
অনুদানের আড়াই লাখ টাকা সম্পর্কে জানতে চাইলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পার্বতীপুর পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল ওহাব সরকার স্পস্ট করে কিছু জানাতে পানেননি। তবে তিনি শুনেছেন বলে জানান।
১৯৯০ সালে এরশাদ বিরোধী গণআন্দোলনে রাজপথের সৈনিক ছিলেন হাশেম আলী। জেল জুলুমের শিকার হয়েছিলেন একাধিকবার। নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের নেতাকর্মীদের হাতে। সেই হাশেম আলী শেষ জীবনে চরম অভাবের কারণে মানবেতর জীবন যাপন করেছেন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তাকে পার্বতীপুর রেলওয়ে স্টেশনের ১নং প্লাটফরমে ভিক্ষা করে জীবন কাটাতে হয়েছে।
গত বছরের ২৬ আগস্ট দুপুরে পার্বতীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও ইয়ংস্টার ক্লাবের সভাপতি আমজাদ হোসেন হাশেম আলীকে উদ্ধার করে হলদীবাড়ী হাসপাতালে ভর্তি করান। কিন্তু সেখানেও তার থাকা হয়নি। পরিবারে জন্য তাকে ঘুরে আসতে হয় পার্বতীপুর রেলওয়ে স্টেশনের ১নং প্লাটফরমে।
মৃত্যুর আগে হাশেম আলী পার্বতীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আমজাদ হোসেনকে বলে গেছেন, দলের কেউ আমার খোঁজ নেয়নি। সেই কথাটি আজো কানে বাজছে বলে জানান আমজাদ হোসেন।
তিনি বলেন, সরকারের সুবিধাভোগী অনেক বিত্তশালী রয়েছেন। সরকারি দলের অনেক নেতাকর্মীই আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়েছেন। কিন্তু কেউ হাশেম আলীর খোঁজ রাখার প্রয়োজন মনে করেনি কেউ। এ অবস্থায় হাশেম আলী আমাদের রেখে চলে গেলেন। তিনি তার পরিবারে প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানের সুদৃষ্টি কামনা করেন।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
পৃথিবীর সব প্রাণী ধ্বংস হবে কবে, জানালেন বিজ্ঞানীরা
পৃথিবীতে কোনো প্রাণী বা প্রজাতিই স্থায়ী নয়। একদিন না একদিনবিস্তারিত পড়ুন
এটিএম থেকে টাকার পরিবর্তে কী বের হচ্ছে?
এটিএম বুথের মেশিন থেকে টাকাই তো বের হওয়ার কথা। কিন্তুবিস্তারিত পড়ুন
৩৩ বছরে ছুটি নিয়েছেন মাত্র একদিন
১৯৪০-এ ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে নার্সিংয়ে হাতেখড়ি। দু’টি বিশ্বযুদ্ধ, ২৪ বার প্রধানমন্ত্রীবিস্তারিত পড়ুন