মানুষের দিকেই চেয়ে থাকে বানরগুলো
বানরের এমনিতেই খাদ্য সংকট। তার ওপর রোজার মাস। তাই মানুষের উচ্ছিষ্ট খবারও পযার্প্ত নেই। ক্ষুধার্ত থেকেই বা কতটা স্বাভাবিক জীবন যাপন করা যায়। এই পরিস্থিতি আর কেউ না বুঝলেও ওদের কষ্ট ঠিকই বুঝলেন কালো পোশাকের মানুষেরা।
বাজার থেকে আস্ত একটি কাঁঠাল কেনা হলো। তারপর দেওয়া হলো তাদের সামনে। আর অমনি উপোস থাকা বানরগুলো মুহূর্তে সাবাড় করে ফেললো কাঠাঁলটি। তৃপ্তির ভাব নিয়ে পরে লক্ষ্মী প্রাণির মতো চলে গেলো গাছের ডালে।
এ দৃশ্য রথযাত্রার নগরী ধামরাই বাজারের। ৠাবের মতো কালো পোশাকের সাদা মনের মানুষগুলোর দিকেই এভাবে চেয়ে থাকতে হয় ধামরাইয়ের বানরগুলোর। কেউ সদয় হয়ে কিছু কিনে দিলে খাবার জুটে, নতুবা উপোস। প্রাকৃতিক খাবার সহজলভ্য না হওয়ায় তাই তাদের এই করুণ অবস্থা।
অধিকাংশ সময়ই পেটে পাথর বেঁধে রাখতে হয়। এভাবে আর কতক্ষণ। শেষমেষ কিছু না পেয়ে নিরীহ এই জীবেরাই হয়ে ওঠে হিংস্র। দল বেঁধেই হানা দেয় মানুষের বাসা বাড়িতে। এমনকি মুরগির খামারে হানা দিয়ে শতাধিক মুরগি মেরে ভয়াল আন্দোলন আর নিজেদের ক্ষোভের কথা জানান দিয়েছে ওরা।
তা সত্ত্বেও পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। খাদ্য সংকটে ওরা পাশে পায়নি মানবগোষ্ঠীকে। যে কারণে একসঙ্গে বসবাস করেও উভয়ের সম্পর্কের উচ্চতা এখন নিম্নগামী।
হিংস্রতা আর উৎপাতের মাধ্যমেই ওরা খাদ্য সংকটের বিষয়টি জানান দেয়। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে এবং বেঁচে থাকার জন্য নিরুপায় হয়ে চুরি করেই খেতে বানরগুলোকে। আসলেই ভালো নেই ধামরাইয়ের বানরগুলো। বানরের দুষ্টুমি আর মুখ ভেংচির সহ্য করলেও দল বেঁধে বাসা বাড়িতে হানা দেওয়াটাই ইদানিং যেন রুটিনে পরিণত হয়েছে।
ওদের কথা বুঝতো- ওদের নিয়ে ভাবতো এমন মানুষটি এখন আর নেই। বছর চারেক ধরে সেই অর্থে এতিমই এখানকার বানরগুলো। ধামরাই পৌর বাজার এলাকার বাসিন্দা সমাজসেবক হাজি ওবায়দুর রহমান নিজ অর্থায়নেই দীর্ঘদিন ধরে প্রতিদিন দু’বেলা করে কলা, রুটি, বিস্কুটসহ বিভিন্ন খাবার দিয়ে আসছিলেন বানরগুলোকে। নিজ সন্তানদের মতোই বানরদের জন্যে ছিলো তার ভালোবাসা। চার বছর আগে মানুষটি প্রয়াত হয়েছেন। আর তাই অনাদর, অবহেলা সঙ্গী হয়েছে বানরগুলোর জীবনে।
ওবায়দুর রহমানের মৃত্যুর পর বানরগুলো পড়ে তীব্র খাদ্য সংকটে। ধামরাই পৌরসভায় ঢুকতেই চোখে পড়ে বাসা-বাড়ির ছাদে, চালে, গাছের ডালে দল বেঁধে বসে থাকা বানর। যেন নিজেদের এই জনপদে স্বাগত জানাতেই কখনও দল বেঁধে কখনো বা সপরিবারে উপস্থিত হয় তারা। এই ভরসায় যে, কেউ যদি কিছুটা খাবার অন্তত দেয়।
ধামরাইয়ের মানুষ ও বানরদের অবাধ সহবস্থান পর্যটন গুরুত্বকে জানান দিলেও সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যায়নি। পাশের দেশ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মন্দির কেন্দ্রিক বানরের বসবাসকে কদর করা হলেও এখানে ঠিক তার উল্টোটা। মন্দিরে থাকা বানরগুলো পুর্ণার্থীদের দয়া-দক্ষিণা পেলেও সংখ্যার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। যে কারণে বানারগুলো এখন বাজার বা বাসাবাড়ি মুখো।
শিউলী সাহা নামে পাঠান টোলার এক গৃহিণী বলেন, ‘ছাদে যে আচার শুকোতে দেবো সেই পরিস্থিতি নেই এখানে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে সুযোগ পেলে রান্না ঘরে ঢুকে ফলমূল, কাঁচা সবজি-তরকারি বা ভাত, যেটা হাতের কাছে পায় সেটাই নিয়ে যায়। তাই সব সময় থাকতে হয় সাবধানে। আর ওরা করবেই বা কি? খাবার না পেলে তো হানা দেবেই। ওদেরও তো পেট আছে। ছেলে পুলে আছে, নাকি?’
তিনি বললেন, ‘আমিও মাঝে-মাঝে ওদের খাবার দিই। তবে সংখ্যাটা বেড়ে গেলে নিজেদের মধ্যে তখন সংঘাতটাও বেড়ে যায়। মাঝে বানরদের দু’টি গ্রুপের বিরোধ ও রক্তারক্তি কাণ্ডে স্থানীয়রা গ্রুপ দু’টিকে তুলনা করতেন দেশের বড় দু’টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে।
এক মহল্লায় ‘এ’ গ্রুপ থাকবে অন্য মহল্লায় ‘বি’ গ্রুপ। আসলে এই বিরোধের নেপথ্যেও কিন্তু খাদ্য সংকট। জানালেন প্রবীণ বাসিন্দা দীপক চন্দ্র।
শ্রী শ্রী যশোমাধবের রথযাত্রার ঐতিহ্য আর চার’শ বছরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ধামরাইয়ে বানরের বসবাস।
আগে মন্দির কেন্দ্রিক বানরের অবস্থান থাকলেও ক্রমাগত খাদ্য সংকটে বানরদের সংখ্যাটাও ধিরে ধিরে ক্ষয়ে এখন বিলুপ্তির পথে। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের জন্য গত ১৬ জুন ১০৩ কোটি ১২ লাখ ৯৬ হাজার ৫২০ টাকার বাজেট ঘোষণা করেছ ধামরাই পৌরসভা। বাজেটে পৌরসভার অধিবাসী বানরদের জন্যে বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র ১২ হাজার টাকা। মাস প্রতি বরাদ্দ মাত্র ১ হাজার টাকা। দিন হিসেবে বানর প্রতি মাত্র ৩ পয়সা।
ধামরাই পৌরসভার মেয়র আলহাজ গোলাম কবির জানান, প্রথম শ্রেণির পৌরসভায় বানরদের জন্যে অনানুষ্ঠানিক বরাদ্দের মাধ্যমে বানররাও যে এই তল্লাটের অধিবাসী। তারই স্বীকৃতি দিচ্ছে পৌরসভা। বরাদ্দটা যদিও প্রতিকী। তবুও পৌরসভার ভাবনায় রয়েছে, বানরদের আহারের বিষয়টি।
তিনি জানান, আগামী মাস থেকে বরাদ্দের টাকায় ফল-মূল বা রুটি বিস্কুট কিনে বিশেষ একটি স্থানে নিজে উপস্থিত থেকেই বানরদের মধ্যে খাবার বিতরণ করবেন তিনি।
স্থানীয় সাংবাদিক মোখলেছুর রহমান জানান, ধামরাই পৌর এলাকার বানরের সংখ্যা সহস্রাধিক। সে হিসেবে বানর প্রতি মাসিক বরাদ্দ মাত্র ১ টাকা। বরাদ্দটা বাড়ানোর দরকার। সেই সঙ্গে প্রয়োজন পৌর বাসিন্দাদের সহমর্মিতা আর বানরদের প্রতি সংবেদনশীলতা।
সবাই এগিয়ে এলে যেমন ধামরাইয়ের এই ঐতিহ্য রক্ষা পাবে। তেমনি খাবার দিয়ে শান্ত রেখে বানরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হতে হবে না বলেও জানান তিনি।
স্থানীয় সাংবাদিক নবীন চৌধুরী ও দীপক চন্দ্র পাল জানান, দল বেঁধে বানররা হানা দিয়েছে তাদের বাসা বাড়িতে। খাবারের জন্যে তাণ্ডবও চালিয়েছে তারা। বানরের তাণ্ডবের শিকার হয়নি ধামরাই পৌর এলাকায় এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া সত্যিই দুস্কর।
ধামরাই বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি শফিক আনোয়ার গুলশান জানান, খাবারের অভাবে অকাল মৃত্যুতেও ঢলে পড়ছে অনেক বানর।
ধামরাই থানায় গাছে-গাছে পাখির বাসা তৈরি করে প্রকৃতিপ্রমী হিসেবে আলোচনায় আসা ধামরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ রিজাউল হক জানান, এই জনপদের প্রাচীন ঐতিহ্যকে ধারণ করে এখানকার বানর। ঐতিহ্যকে লালন করতে প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে এখানকার বাসিন্দাদের। তাদের মমতা আর আন্তরিকতাই পারে বানরগুলোর আরও জীবন দিতে।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
পৃথিবীর সব প্রাণী ধ্বংস হবে কবে, জানালেন বিজ্ঞানীরা
পৃথিবীতে কোনো প্রাণী বা প্রজাতিই স্থায়ী নয়। একদিন না একদিনবিস্তারিত পড়ুন
এটিএম থেকে টাকার পরিবর্তে কী বের হচ্ছে?
এটিএম বুথের মেশিন থেকে টাকাই তো বের হওয়ার কথা। কিন্তুবিস্তারিত পড়ুন
৩৩ বছরে ছুটি নিয়েছেন মাত্র একদিন
১৯৪০-এ ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে নার্সিংয়ে হাতেখড়ি। দু’টি বিশ্বযুদ্ধ, ২৪ বার প্রধানমন্ত্রীবিস্তারিত পড়ুন