মাসিক আয় চার কোটি টাকা?
প্রান্তিক জুমিয়া থেকে সাধারণ চাকুরে, কারোরই রেহাই নেই। চাঁদা দিতেই হয়, বলা চলে ‘বাধ্যতামূলক’। চাঁদা ছাড়া গাড়ির চাকাও ঘোরে না। চাঁদাবাজদের ব্যাপারে প্রশাসনিক কোনো উদ্যোগও চোখে পড়ে না। পাহাড়ি জনপদ খাগড়াছড়ি দিন দিন হয়ে উঠেছে চাঁদাবাজদের ‘স্বর্গ’।
আশ্চর্যজনক সত্য হলো—বেতনের টাকার কিছু অংশ চাঁদাবাজদের হাতে তুলে দেওয়াটা পাহাড়ি চাকরিজীবীদের নিয়তি। স্থানীয় সূত্র নিশ্চিত করেছে, প্রথম শ্রেণির পাহাড়ি চাকরিজীবীরা প্রতিবছর মূল বেতনের তিন শতাংশ; দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিজীবীরা মূল বেতনের দুই শতাংশ হারে চাঁদা গুনছেন। চাকরিজীবী নন, এমন পরিবারের ক্ষেত্রে বছরে ন্যূনতম ৩০০, ৪০০ অথবা ৫০০ টাকা হারে টাকা দিতে হয়। বিশেষ করে, বৈসাবি উৎসব ঘনিয়ে এলে সাধারণ পাহাড়িদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা হয়। স্বেচ্ছায় চাঁদা না দিলে দেওয়া হয় সতর্কবার্তা। অনেক ক্ষেত্রে নেমে আসে শাস্তির খড়গ।
সময়মতো চাঁদা না পেয়ে গত এক বছরে খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম সড়কের সাপমারাসহ কয়েকটি সেতু নির্মাণকাজে বাধা দেয় দুর্বৃত্তরা। পানছড়ি-তবলছড়ি সড়ক উন্নয়নকাজে ঠিকাদারের লোক ও শ্রমিককে অপহরণও করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন পাহাড়ি চাকরিজীবী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। রাঙামাটির বাঘাইছড়ি ও জেলার প্রত্যন্ত এলাকার অনেক পাহাড়ি অতিষ্ঠ হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন খাগড়াছড়ি জেলা সদরে। এর মধ্যে ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার রয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, চাঁদাবাজিতে এগিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। ইউপিডিএফের কালেক্টরের (চাঁদা সংগ্রহকারী) দায়িত্ব থেকে সদ্য অব্যাহতি নেওয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, তিনি ইউপিডিএফের রাজনীতির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সম্পৃক্ত ছিলেন। কিন্তু ওই পথ আর ভালো না লাগায় ছেড়ে এসেছেন। স্বাভাবিক জীবনে থাকতে চাইছেন। বর্তমানে খাগড়াছড়ি জেলা সদরে ভাড়া বাসায় থাকেন। তিনি বলেন, ‘ইউপিডিএফ কর্মী ও সদস্যদের পুনর্বাসনে ভালো কিছু কর্মসূচি রয়েছে। কিন্তু, তাতে আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। মাসিক হারে পারিবারিক ভাতা, চিকিৎসাভাতা ছাড়াও বিশেষ ক্ষেত্রে শিক্ষা ও উৎসব ভাতা দেওয়া হয়ে থাকে। অবশ্য জুম্ম জাতির কল্যাণে উত্তোলিত গণচাঁদায় অনিয়ম ধরা পড়লে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। ’
মাটিরাঙ্গা উপজেলার দুর্গম অভ্যা এলাকার জনৈক বাসিন্দা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, ‘আমার নিজের জায়গা-জমিতে যেতেও পাশ লাগে। গাছ লাগাতে এবং গাছ কাটতে যেমন চাঁদা দিতে হয়; তেমনি বার্ষিক চাঁদা না দিলে গাছ কেটে ফেলা হয়। ’
রামগড়ের নাকাপার বাসিন্দা আব্দুর রহিম বলেন, ‘পুরাতন নাকাপাসহ এখনো বহু এলাকা নিয়ন্ত্রিত। সেখানে সাধারণ মানুষের যাতায়াত সংরক্ষিত। পাস বা টোকেন নিয়ে ওই সব এলাকায় ঢুকতে হয়। এ ছাড়া চাঁদা না দেওয়ায় রামগড়, মানিকছড়িতে প্রায়ই বাগানে আগুন দেওয়া ও গাছ কেটে ফেলার খবর পাওয়া যায়। ’
চাঁদা না দিলে গাড়িতে আগুন, গুলি বছরে একেকটি ট্রাককে চাঁদা দিতে হয় ১৮ হাজার টাকা। এর বাইরে মালপত্র পরিবহনের ক্ষেত্রে মূল্য অনুযায়ী প্রতিটি ট্রাককে ‘রয়ালটি’র নামে ২ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়।
চাঁদা না দেওয়ায় খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা-বাঘাইছড়ি, খাগড়াছড়ি-পানছড়ি ও খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি সড়কে ১০টির মতো ট্রাক পোড়ানো হয়। গত ২৩ জানুয়ারি খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি সড়কের নানিয়ারচরের বেতছড়ি এলাকায় একটি মালবোঝাই ট্রাকে আগুন দেওয়া হয়। সর্বশেষ ২ এপ্রিল রাতে খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা সড়কের ৭ মাইলে একটি কম্পানির গাড়িতে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। সড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে গাড়ি থামিয়ে চালকসহ দুজনকে গুলি করা হয়।
ওই কম্পানির ব্যবসা ও বিপণন উন্নয়ন ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মাঈন উদ্দিন অভিযোগ করেন, ‘গত বছরের এপ্রিলে আমাদের কম্পানির পণ্য পরিবহনে সরাসরি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল ইউপিডিএফ। সংগঠনটি ২০ লাখ টাকা চাঁদা ও জরিমানাসহ মোট ৪০ লাখ টাকা দাবি করে। ’
খাগড়াছড়ি চালক সমবায় সমিতির সভাপতি মনোতোষ দে অভিযোগ করেন, চাঁদা ছাড়া গাড়ির চাকা ঘোরে না। তিনি বলেন, ‘বার্ষিক টোকেনে প্রতি ট্রাক থেকে ইউপিডিএফ, জনসংহতি সমিতির দুই অংশ ছয় হাজার টাকা হারে নিচ্ছে। ’ তিনি জানান, প্রধান সড়কের আলুটিলার এলজিইডি বাগান, দীঘিনালা সড়কের ৭, ৯ ও ১০ মাইল এলাকায় প্রকাশ্যে চাঁদা তোলা হয়। পানছড়ি সড়কের দেওয়ানপাড়া, নালকাটা ও লতিবানে তিনটি আঞ্চলিক সংগঠনের পক্ষে আলাদাভাবে চাঁদা তোলা হয়। এ ছাড়া বাবুছড়ার কৃপাপুর, মেরুং সড়কের চোংড়াছড়িতে চাঁদা উঠছে প্রতিদিন। এ ব্যাপারে খাগড়াছড়ি ট্রাক-মিনি ট্রাক মালিক পক্ষের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘চাঁদা ছাড়া গাড়ি রাস্তায় নামতেই পারে না। প্রতিকার চেয়ে এত আন্দোলন-সংগ্রামের পরও প্রশাসন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ’
বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের কেন্দ্রীয় সভাপতি নলেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেন, ‘মূলত চাঁদা না দেওয়ার কারণে তারা জুম চাষ বন্ধ করতে জোর করছে। ’
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, গত ১০ ফেব্রুয়ারি জেলা সদরের জামতলী এলাকায় ইউপিডিএফ নেতা প্রদীপন খীসার বাড়িতে অভিযানে প্রায় ৮০ লাখ টাকা উদ্ধার হয়। সেখানে পাওয়া কাগজপত্র ঘেঁটে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। বর্তমানে মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়েছে। ইউপিডিএফের মুখপাত্র নিরণ চাকমা বলেন, ‘গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করা ও ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ তোলা হচ্ছে। ’
জনসংহতি সমিতির (এম এন লারমা) নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, ‘দল পরিচালনায় চাঁদা তোলা হয়, এটা অসত্য নয়। তবে চাপ প্রয়োগ করে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে আর গুলি চালিয়ে চাঁদা তোলা জনসংহতি সমিতির আদর্শবিরোধী। ’
সিআইডি পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘তদন্তকাজ এগিয়ে চলছে। খুব কম সময়ের মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ করে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। তবে গোপনীয় বিষয় হওয়ায় এ সম্পর্কে খোলাসা করে কিছু বলা যাচ্ছে না। ’
খাগড়াছড়ি সদর থানার ওসি তারেক মো. আব্দুল হান্নান বলেন, ‘ইউপিডিএফ নেতা প্রদীপন খীসার বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া নথিপত্রে দেখা গেছে, ইউপিডিএফের মাসিক আয় প্রায় চার কোটি টাকা। ’সূত্র-কালের কন্ঠ
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
পৃথিবীর সব প্রাণী ধ্বংস হবে কবে, জানালেন বিজ্ঞানীরা
পৃথিবীতে কোনো প্রাণী বা প্রজাতিই স্থায়ী নয়। একদিন না একদিনবিস্তারিত পড়ুন
এটিএম থেকে টাকার পরিবর্তে কী বের হচ্ছে?
এটিএম বুথের মেশিন থেকে টাকাই তো বের হওয়ার কথা। কিন্তুবিস্তারিত পড়ুন
৩৩ বছরে ছুটি নিয়েছেন মাত্র একদিন
১৯৪০-এ ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে নার্সিংয়ে হাতেখড়ি। দু’টি বিশ্বযুদ্ধ, ২৪ বার প্রধানমন্ত্রীবিস্তারিত পড়ুন