মায়ের কাছে যেতে ৪৫ বছর অপেক্ষা মেয়ের
পাকিস্তানের নাগরিক ৬০ বছর বয়সী জায়বা। নিজের জন্মস্থান থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে থাকেন। তবু মায়ের সঙ্গে তার দেখা হয়নি ৪৫ বছর। কারণ ১৯৭১ সালের যুদ্ধে তার গ্রামটি দখল করে নেয় ভারত। শেষ পর্যন্ত তিন হাজার কিলোমিটার পথ ঘুরে দেখা হলো মায়ের সঙ্গে। তত দিনে মায়ের বয়স ৯৬ বছর। চোখেও দেখতে পান না পক্ষাঘাতগ্রস্ত মা খাতিব।
গত বছরের ২৯ আগস্ট নিজের গ্রাম চালুনকাতে পৌঁছান জায়বা। তার আগমন নিয়ে গ্রামের লোকজনের উৎসব শেষ হয়নি এখনো। তাকে আবার ফিরে যেতে হবে পাকিস্তান, এ কথা জানেন জায়বা। কিন্তু মাকে ফেলে যেতে মন চায় না তার।
পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত গিলজিট-বালতিস্তান এবং ভারত নিয়ন্ত্রিত লেহ দুটি জায়গাই একসময় জম্মু ও কাশ্মিরের বিতর্কিত অংশ ছিল। জায়বার চালুনকা গ্রামটি ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ছিল। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত অংশ নিলে দেশটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে পাকিস্তান। চালুনকাসহ আশপাশের এলাকা দখল করে নেয় ভারত।
জায়বা ওই সময় চালুনকা থেকে ৩০ কিলোমিটার পশ্চিমে থকমাস নামের একটি গ্রামে স্বামীর সঙ্গে চলে যান। তিনি তখনো বুঝতে পারেননি তার পরিবারের কাছে ফিরে যেতে অপেক্ষা করতে হবে ৪৫ বছর। ৩০ কিলোমিটারের এই দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে তাকে তিন হাজার কিলোমিটার পথ।
পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন জায়বা বছরের পর বছর অপেক্ষা করেন মায়ের সঙ্গে দেখা করার। এ সময়ে বড় হয় তার সন্তানরা। তারা ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন মিলে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে জোগাড় করেন কাগজপত্র এবং চার লাখ রুপি।
জায়বার ভাইপো ইলিয়াস হুসেইন, যার বসবাস পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত গিলজিট-বালতিস্তান অঞ্চলের স্কারডো শহরে, তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালের নভেম্বরে আমরা ভারতের ভিসার জন্য আবেদন করি। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যাত হয়। এরপর আবার বার দুয়েক ভিসার জন্য আবেদন করি। প্রতিবারই কোনো না কোনো কাগজপত্র ঘাটতি পড়ত।’ অবশেষে ২০১৬ সালের জুন মাসে সব কাগজপত্রের ব্যবস্থা করেন চালুনকাতে থাকা জায়বার ভাই হোসাইন আলি। ইতিমধ্যে জায়বা খবর পান তার মা খুবই অসুস্থ।
ইলিয়াস প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র সংগ্রহ করে ইসলামাবাদের ভারতীয় হাইকমিশনে ভিসার জন্য আবার আবেদন করেন। গত বছরের আগস্টের শুরুর দিকে ভারতীয় হাইকমিশন থেকে ফোন করে জানানো হয়, জায়বার ভিসা হয়েছে।
১৯৭১ সালে থকমাস চলে আসার পর জায়বা কাছের শহর স্কারডো ছাড়া আর কোথাও একা একা যাননি। গিলজিট-বালতিস্তানের বাইরে গেলে তার একজন সফরসঙ্গী প্রয়োজন হতো। বড় শহরে চলাচল সম্পর্কে তার একেবারেই ধারণা ছিল না বলে জানান ইলিয়াস হুসেইন।
তাই চাচি জায়বাকে দিল্লির বাস পর্যন্ত তুলে দিতে তার সফরসঙ্গী হন ইলিয়াস। তারা প্রথমে ইসলামাবাদ, পরে লাহোর যান। সেখানে ওয়াগা-আটারি সীমান্ত পার হয়ে ভারতে পৌঁছান।
২০১৬ সালের ১৮ আগস্ট থকমাস থেকে ভারত যাওয়ার উদ্দেশে রওয়ানা দেন জায়বা। এরপর কয়েক দিনের জন্য স্কারডো শহরে যাত্রাবিরতি করেন। সেখানে তার আত্মীয়-স্বজন ও গ্রামবাসী বিভিন্ন উপহার ও চিঠিপত্র দেয় ওপারে স্বজনদের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য। জায়বার এই ভ্রমণ নিয়ে সবার মধ্যে তখন উত্তেজনা কাজ করছিল। ইসলামাবাদে যাওয়ার আগের দিন জায়বা নিজেও কিছু উপহারসামগ্রী কেনেন।
জায়বা বলেন, ‘আমি আমার মায়ের জন্য একটি শাল ও একটি পোশাক কিনি। ভাইদের জন্য বালতিস্তানের টুপি এবং তাদের স্ত্রীদের জন্যও কেনাকাটা করি।’
গিলজিট-বালতিস্তানে তখন পর্যটকদের মৌসুম। ইসলামাবাদে আসা-যাওয়ার সব ফ্লাইটই তখন রিজার্ভ। ফলে বাধ্য হয়ে একটি ট্যাক্সি ভাড়া করে রওনা দেন জায়বা ও ইলিয়াস হুসেইন। ২৩ আগস্ট ভোর চারটায় স্কারডো শহরের উদ্দেশে রওয়ানা দেন তারা।
২০ ঘণ্টা গাড়ি ভ্রমণের পর জায়বা ও ইলিয়াস হুসেইন ইসলামাবাদের পৌঁছান। এক আত্মীয়ের কাছ থেকে ভারতীয় ভিসাসহ পাসপোর্ট সংগ্রহ করেন, যিনি আগেই ভারতীয় হাইকমিশন থেকে জায়বার পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছিলেন। তারা ইসলামাবাদে দুই দিন যাত্রাবিরতি দিয়ে লাহোরে পৌঁছান। সেখানে জায়বার জন্য আগে থেকেই লাহোর-দিল্লির বাস সার্ভিসের টিকেট কেটে রেখেছিলেন ইলিয়াস।
পাকিস্তান ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট বোর্ড করপোরেশনের একটি বাসে ২৬ আগস্ট ভোর চারটায় দিল্লির উদ্দেশে রওনা দেন জায়বা একা। লাহোরে গুলবার্গ (লাইব্রেরি মার্কেট সংলগ্ন) টার্মিনাল এলাকায় তখন নিরাপত্তাব্যবস্থা খুব কড়াকড়ি। পুলিশের একটি গাড়ি লাহোর থেকে ২২ কিলোমিটার পূর্বে ওয়াগাহ সীমান্ত চেকপয়েন্ট পর্যন্ত বাসটির নিরাপত্তার জন্য সঙ্গে যায়।
এরপর ভারত সীমান্তে পৌঁছালে ভারতীয় ইমিগ্রেশনের তল্লাশি শেষে একই দিন সন্ধ্যায় জায়বা দিল্লি পৌঁছান। সেখানে বোনকে বরণ করতে স্ত্রী-সন্তানসহ অপেক্ষায় ছিলেন ভাই হুসেইন আলি।
হুসেইন আলি ইলিয়াসকে জানান, দিল্লি বাস টার্মিনালে নামার পর প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়েন জায়বা। এ সময় তাকে খুশি এবং দুঃখিত মনে হচ্ছিল।
জায়বা, তার ভাই এবং পরিবারের সদস্যরা পরদিন সকালে বিমানে করে লেহতে পৌঁছান। সেখানে তারা দুই দিন থেকে ২৯ আগস্ট চালুনকার পথে গাড়িতে করে রওয়ানা দেন। অবশেষে নিজের জন্মভূমিতে পা রাখেন জায়বা, যেখানে তার শৈশব-কৈশোরের পুরোটা সময় কেটেছে।
যখন কোনো অঞ্চলে বা রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যুদ্ধ লাগে তখন প্রাণহানি ঘটে, শিশুদের তাদের মা-বাবা থেকে পৃথক করা হয়, মানুষজন বিভিন্ন দেশে চলে যায়। এই ধরনের পরিস্থিতিকে কোলাটেরাল ড্যামেজ বলা হয়। মায়ের কাছ থেকে জায়বার পৃথক হওয়ার ঘটনাটিও এরই একটি অংশ।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে জায়বা বলেন, ‘আমি যাওয়ার সাত বছর পর জানতে পারি আমার মা এবং ভাই-বোন চালুনকাতে আছে। তারা বেঁচে আছে, এটা জানতে পেরেই অনেক খুশি হয়েছিলাম। ভারত সরকার আমার পরিবারকে ভালো রেখেছে।’
জায়বা ৩০ দিনের ভিসা নিয়ে ভারত যান। পরে তার ভিসার মেয়াদ কয়েকবার বাড়ানো হয়।
জায়বা বলেন, ‘চালুনকা যাওয়ার ভ্রমণটি খুব ক্লান্তিকর ছিল। কিন্তু যাত্রাপথে আমি সারাক্ষণ আমার মায়ের কথাই ভেবেছি। এতে আমার কষ্ট অনেকটাই লাঘব হয়।’
জায়বার মা এখন একা চলাফেরা করতে পারেন না। জায়বার কোনো বোন নেই। তাই যত দিন পারেন, মায়ের সেবা করতে চান জায়বা। অনেক বছর আগে তার বাবা মারা গেছেন। তার দুঃখ বাবাকে শেষ দেখা দেখতে পারেননি। একই দুঃখ তার মায়ের জন্যও পেতে চান না।
ব্যাপক সংবর্ধনা দিয়ে জায়বাকে গ্রহণ করে চালুনকার গ্রামবাসী। তাকে টাকার মালা দিয়ে বরণ করে নেয় তারা। পুরো গ্রামবাসী তার আগমনের অনুষ্ঠান উদযাপন করে। গ্রামের প্রত্যকেই তাকে দাওয়াত দিয়েছেন।
নিজের জন্মভিটায় আসতে পেরে খুবই আনন্দিত জায়বা। শৈশবে যেসব জায়গায় খেলাধুলা করতেন, সব জায়গা তিনি ঘুরে ঘুরে দেখেছেন। যাদের সঙ্গে বড় হয়েছেন, তাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। তার মনে হচ্ছিল, তিনি আবার তার শৈশব ফিরে পেয়েছেন। কিন্তু তিনি জানেন, একদিন তাকে এখানকার সবকিছু ফেলে থকমাসে তার সন্তান এবং নাতনি-নাতনিদের কাছে ফিরে যেতে হবে।
জায়বা বলেন, ‘আমি একজন পাকিস্তানের নাগরিক, আর আমার মা একজন হিন্দুস্তানি। আমার মাকে দেখাশোনা করা ছাড়া অন্য কোনো কারণে আমি এখানে থাকতে চাই না।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে জায়বা বলেন, ‘মাকে রেখে চলে যেতে ইচ্ছে করছে না আমার।’ সূত্র:ডন নিউজ
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
পৃথিবীর সব প্রাণী ধ্বংস হবে কবে, জানালেন বিজ্ঞানীরা
পৃথিবীতে কোনো প্রাণী বা প্রজাতিই স্থায়ী নয়। একদিন না একদিনবিস্তারিত পড়ুন
এটিএম থেকে টাকার পরিবর্তে কী বের হচ্ছে?
এটিএম বুথের মেশিন থেকে টাকাই তো বের হওয়ার কথা। কিন্তুবিস্তারিত পড়ুন
৩৩ বছরে ছুটি নিয়েছেন মাত্র একদিন
১৯৪০-এ ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে নার্সিংয়ে হাতেখড়ি। দু’টি বিশ্বযুদ্ধ, ২৪ বার প্রধানমন্ত্রীবিস্তারিত পড়ুন