মুক্তিযোদ্ধা জাবেদ আলীর হাতে ভিক্ষার থলি
মুক্তির স্বাদ পেতে অস্ত্র হাতে গিয়েছিলেন যুদ্ধে। শেকলে বাঁধা জীবন থেকে বাঙালিকে করেছিলেন মুক্ত। ছিনিয়ে এনেছিলেন স্বাধীনতা। অর্জিত হয়েছে লাল-সবুজের পতাকা। তবে মূল্যায়ন হয়নি একজন জাবেদ আলীর। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হায়েনাদের সঙ্গে সম্মুখ লড়াইয়ের সাহসী যোদ্ধা হলেও তালিকায় নাম ওঠেনি তাঁর। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের উন্নয়নে সরকারের গৃহিত পদক্ষেপের সবগুলো থেকেই আজ বঞ্চিত তিনি।
সুনামগঞ্জ শহরে বীর মুক্তিযোদ্ধা জাবেদ আলীর পরিচয় এখন ভিক্ষুক। জীবন বাজি রেখে বাঙালিকে স্বাধীন জাতি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেও নিজের পরিচয়টাই হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পেতে যে কয়টা টাকা আর সামান্য চাল পাওয়া যায় তা দিয়ে জীবন চলছে কোনোরকমে। মুক্তিকামীদের একজন হয়ে যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন তা কেবল স্বপ্নই থেকে গেছে।
তাঁর মতে, স্বাধীনতা বিরোধীদের অনেকে এখন মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়ে সমাজে পরিচিত হলেও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের খবর রাখেনি কেউ। তাঁর মতো আরো কয়েকজন আছে। যাঁদের ভাগ্যে অন্তত মুক্তিযোদ্ধার খেতাবটা জুটেছে। তবে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলেও জীবনযুদ্ধে আজো তাঁরা অবতীর্ণ। ভাগ্যের পরিহাসে তাঁদের কেউ এখন রিকশার চালক, কেউ দিনমজুর আর কেউবা ক্ষেতমজুর। তবে তাঁদের থেকেও অসহায়ত্ব বরণ করে চলছে জাবেদ আলীর জীবন।
জাবেদ আলীর বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার বরকত নগরে। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ৫নং সেক্টরের ভোলাগঞ্জ সাব সেক্টরে ছিলেন। তাঁর ওপর ছিল সেক্টর কমান্ডারের রানারের দায়িত্ব। তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান এবং যুদ্ধকালে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সঙ্গীদের কাছে তথ্য আদান-প্রদান করতেন। তখন ভোলাগঞ্জ সাব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মীর শওকত আলী। এই সেক্টরের হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন জাবেদ আলী। একই সেক্টরে তাঁর সঙ্গীয় মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এমদাদুল ইসলাম, জয়নাল আবেদীন নওশাদ, প্রমোদ রঞ্জন ও রতীশ রঞ্জন কর। তাঁরা ঠিকই তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত হয়েছেন। ভাগ্য কেবল জাবেদ আলীকে নিয়ে খেলেছে। ‘মুক্তিযোদ্ধা’র বদলে সমাজে তিনি এখন ‘ভিক্ষুক’ হিসেবে পরিচিত।
মুক্তিযোদ্ধা জাবেদ আলী বলেন, ‘আমি কতোজনের কাছে ঘুরবো? আমার সঙ্গের মুক্তিযোদ্ধারা আজকে সবার কাছে পরিচিত। আর আমি মানুষের কাছে হাত পেতে ঘুরি। আমাকে আমার সঙ্গের মুক্তিযোদ্ধারা সবাই চেনে। কিন্তু তাঁরা এ বিষয়টিতে তেমন কিছু করার নেই বলে হয়তো কিছু করেন না। সরকার আমাকে হয়তো মরার আগে পর্যন্ত ভিখারি বানিয়ে রাখবে। মরলে পরে হয়তো সকলে বলবে একটা ভিখারি মরছে। আমার মতো যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করে আজকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে তাঁদের কপালের ফাটল কোনদিন মুছবে না। রাস্তায় রাস্তায় মানুষের কাছ থেকে ভিক্ষা চেয়ে বাকি জীবনটা কাটবে।’
অনেকটা আবেগময় হয়ে কথাগুলো বলছিলেন জাবেদ আলী। আর অজান্তেই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রুজল। রুগ্ন শুষ্ক চেহারার মানুষটার জীবনে মুক্তিযুদ্ধের পরেও একসময় ছিল গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি পুলিশে যোগ দিয়েছিলেন। দেশের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে পাকিস্তানি সেনাদের পিছু হটাতে যে মনোবল তাঁর ভেতরে কাজ করেছিল সেটা দিয়ে আবারো তিনি স্বাধীন দেশের দেশরক্ষী হিসেবে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জীবনে স্বাধীনতার স্বাদ এনে দিলেও জাবেদ আলীর জীবনে এসেছে অভিশাপ হয়ে। তৎকালীন সময়ের সোনালি শিক্ষা জীবন ছেড়ে দেশটাকে মুক্ত করতে গিয়ে জীবনের সব শখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিলেও স্বাধীনতার পর তার অসহায়ত্বে ফিরে তাকায়নি কেউ। মঞ্চ কাঁপানো রাজনৈতিক নেতা আর বড় বড় সমাজসেবকের ভিড়ে এগিয়ে আসেনি কোনো হৃদয়বান।
মুক্তিযোদ্ধা জাবেদ আলী বৃদ্ধ বয়সে বেঁচে থাকার তাগিদে তাঁকে হাত পাততে হয় মানুষের কাছে। তাঁর দাবি, যদি মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা আজকের সমাজে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত হয়, সম্মানিত হয়, তাহলে ৭১-এর মুক্তিসংগ্রামের লড়াকু যোদ্ধা হিসেবে তাঁকেও তালিকাভুক্ত করতে হবে। কোনো ‘বিশেষ সুবিধা’র জন্য নয় যেন মৃত্যুর আগে অন্তত সরকারিভাবে তাঁর নামের আগে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ নামটা লেখা হয় এটাই শেষ জীবনে তাঁর দাবি।
মুক্তিযোদ্ধা জাবেদ আলী বলেন, ‘কতো বড় বড় সাহেবরা আমাকে কথা দিয়েছিলেন, তাঁদের কেউ কথা রাখেননি। কথা রাখার মতো সময়ই হয়তো তাঁদের হয়নি। তাঁরা হয়তো খুব ব্যস্ত মানুষ, কাজের চাপে আমার মতো একটা মানুষের কথা মনে থাকবে কেমনে? বছরের পর বছর ধইরা মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেই বেড়াচ্ছি। আমি মুক্তিযোদ্ধাদের হয়ে সরকারের কাছে সুবিধার আশা করি না। যদি মরার আগে সরকার আমারে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় সেটাই আমার জন্যে অনেক কিছু। আজকে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ না করেও সরকারের ভাতা পায় তাঁদের দেখলে বড় কষ্ট হয়, আসল মুক্তিযোদ্ধারা না খাইয়া মরে আর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বেঈমানরা সম্মান পায়। আমরা যুদ্ধে সুবিধা পাওয়ার আশায় যাইনি, অন্তত ছেলে-মেয়েরা জানবে যে আমি একজন বাঙালি, একজন স্বাধীনতার পক্ষের লোক ছিলাম। পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। এর চেয়ে বেশি আমি চাইনি। কিন্তু আমি তাও পাইনি। এই দেশে সুবিধাবাদীরা মুক্তিযোদ্ধার খেতাব নিয়াও কাড়াকাড়ি করে।’
জাবেদ আলীর ব্যাপারে ৫নং সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় জাবেদ আলী আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তিনি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু তাঁর নাম তালিকায় ওঠেনি। মুক্তিযোদ্ধার নাম ভাঙিয়ে এখন অনেকেই সুবিধা ভোগ করছেন কিন্তু জাবেদ আলী মুক্তিযোদ্ধা হয়েও কোন মূল্যায়ন পাচ্ছেন না। জাবেদ আলী এখন জীবন বাঁচাতে মানুষের কাছে হাত পাতেন যা অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার। আমরা চাই জাবেদ আলীকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় স্থান দেয়া হোক। জাবেদ আলী তৎকালীন সময়ের শিক্ষিত এক যুবক ছিলেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীতে এএসআই পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের মানুষের নিরাপত্তায়ও জাবেদ আলী অসামান্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য সরবরাহের কাজ করতেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ স্বাধীন করতে ঝাঁপিয়ে পরা এ মানুষটি এখন তীব্র অসহায়ত্ব বরণ করে চলেছেন। তাঁর পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজন।’
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
চা কন্যা খায়রুন ইতিহাস গড়লেন
চা শ্রমিকদের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে সব মহলেই পরিচিত হবিগঞ্জেরবিস্তারিত পড়ুন
চার্জ গঠন বাতিল চেয়ে রিট করবেন ড. ইউনূস
শ্রমিক-কর্মচারীদের লভ্যাংশ আত্মসাতের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড.বিস্তারিত পড়ুন
ড. ইউনূসের মন্তব্য দেশের মানুষের জন্য অপমানজনক : আইনমন্ত্রী
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, কর ফাঁকি দেওয়ার মামলাকে পৃথিবীর বিভিন্নবিস্তারিত পড়ুন