লক্ষাধিক নারী রান্না করেন গভীর রাতে
আড়াই বছর ধরে এ এলাকায় দিনের বেলা চুলা জ্বলে না। কিন্তু মাস শেষ হলে ব্যাংকে গিয়ে বিল দিতে হয়। এদিকে গ্যাসের দাম নাকি আবারও বাড়ছে!’ এভাবেই ক্ষোভ জানালেন উত্তরার দক্ষিণখান বাজার সংলগ্ন বাসিন্দা মজিবুর রহমান। আশকোনা মেডিকেল রোডের বাসিন্দা মো. তমিজউদ্দিন সরকার বললেন, ‘রাজধানীর অন্য এলাকার নারীরা রাতের বেলায় ঘুমায়। আর আমাদের এলাকার নারীরা তখন রাত জেগে রান্না করে।’ নগরবাড়ি এলাকার নিজামউদ্দিন মিয়ার স্ত্রী রাহেলা খাতুনও রাত জেগে রান্না করেন। কতদিন হলো এ অবস্থা- জানতে চাইলে রাহেলা বলেন, ‘তিন থেকে সাড়ে তিন বছর ধরে দিনের বেলায় আমাদের এলাকায় কোনো গ্যাস থাকে না। শীতের সময় রাতের বেলায়ও একই অবস্থা হয়। সন্তানদের জন্য রাত জেগে রান্নাবান্না করি। এটা এখন আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে।’ শুধু দক্ষিণখান এলাকার মজিবুর, তমিজউদ্দিন আর রাহেলাই নয়- রাজধানীর উত্তরখান ও দক্ষিণখানসহ আশপাশের কয়েকটি এলাকার প্রায় সাড়ে তিন লাখের বেশি মানুষের বাড়িতে দিনের বেলায় গ্যাস না থাকায় চুলা জ্বলে না। ভোর ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে এসব এলাকা থেকে গ্যাস চলে যায়। ফেরে রাত ১২টা কিংবা ১টার দিকে। দিনের পর দিন এ অবস্থা চললেও তিতাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সমস্যা সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেই।
সরেজমিন দক্ষিণখানের আশকোনা, কাউলা, কসাইবাড়ি, আজমপুরের কিছু অংশ (রেললাইনের পূর্ব পাশ), নগরবাড়ি, মউশাইর, বরুয়া, হলান, নদ্দাপাড়া, দাউয়াই, সোনারখোলা, চালাবন, মোল্লাবাড়ি, মধুবাগসহ বেশকিছু এলাকা ঘুরে বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল রাজধানীবাসী একাংশের এমন দুর্ভোগ সম্পর্কে। এসব এলাকায় সচ্ছল পরিবারগুলো এলপি গ্যাস ব্যবহার করছে। কিন্তু নিরুপায় নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোকে ব্যবহার করতে হচ্ছে লাকড়ির চুলা।
দক্ষিণ সর্দারপাড়ায় গিয়ে কথা হয় দলিল লেখক রোকনউদ্দিন ভূঁইয়ার সঙ্গে। গ্যাস সংকট সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘গ্যাস না থাকায় আজ (বৃহস্পতিবার) সকালেও নাস্তা করা হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘ঘরে কিন্তু দুটি চুলা। বিল দেই মাসে ৬৫০ টাকা।’ রোকনউদ্দিন ভূঁইয়ার স্ত্রী মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘সকালেই চাকরিতে যেতে হয়। এভাবে যদি গ্যাস না থাকে, তাহলে মানুষ বাঁচবে কী করে?’ সর্দারপাড়ার ২৯৮ নম্বর তিনতলা বাড়ির মালিক মফিজউদ্দিন। তার বাড়িতে রয়েছে ছয়টি ভাড়াটিয়া পরিবার। ভাড়াটিয়া কুলসুম বেগম ও মাহিনুর আক্তার বললেন, ‘ঠিক করেছি আগামী মাসে অন্য এলাকায় চলে যাব।’ সর্দারপাড়ার সজল, বেলায়েত হোসেন ও সামাদ মণ্ডলসহ অনেকেই গ্যাস না থাকার অভিযোগ তুলে ধরে বলেন, ‘বাড়িওয়ালাকে গ্যাস বিল দিতে হয়, আবার কেরোসিনও কিনে রাখতে হয়। এত খরচ চালিয়ে পেটের খাবার জোটাই কেমন করে?’
ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. তারাজদ্দিন বলেন, ‘গ্যাসের কারণে মানুষের কী যে দুর্ভোগ হচ্ছে, সেটা নিজের চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না। রাতের বেলায় অন্য এলাকার ঘরবাড়িতে অন্ধকার নামে আর আমাদের এলাকায় তখন আলো জ্বলে।’
উত্তরখান ইউনিয়নেও একই চিত্র: সরেজমিনে উত্তরখান ইউনিয়নের হাটিপাড়া, বড়বাগ, মাস্টারপাড়া, মণ্ডা, মইনারটেক, মাওশাইদ, চামুরখান, কাচকুড়া, আমাইয়া, বাওতার, বেতুলি, বাতুলিয়া ও কোরাদিয়া এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে তীব্র গ্যাস সংকটের কথা জানা গেছে। উত্তরখান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামাল হোসেনের সঙ্গে সেলফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি গ্যাস সংকটের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই এ অবস্থা। সমস্যা হচ্ছে মাত্র আট ইঞ্চি লেয়ার পাইপ দিয়ে দক্ষিণখান ও উত্তরখান এলাকায় গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এদিকে শিল্পকারখানা ও গার্মেন্ট শিল্প গড়ে ওঠায় নানা ধরনের চাহিদাও বেড়েছে। গ্যাস ট্রান্সমিশন এখানে সাবস্টেশন করার চিন্তা করছে। যদিও জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রণালয়ে ফাইল চালাচালি হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
পরিকল্পিতভাবে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়: এসব এলাকার সাধারণ মানুষ গ্যাস সংকটে ভুগলেও কাওলা সিভিল এভিয়েশন স্টাফ কোয়ার্টার ও এলাকার সিএনজি পাম্পগুলোতে এবং বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে ঠিকই দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। দিনের বেলায় আবাসিক এলাকার গ্যাস সরবরাহ লাইন বন্ধ রেখে সিএনজি স্টেশন ও শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ সিভিল এভিয়েশন স্টাফ কোয়ার্টারের লাইনগুলো সচল রাখার পেছনে সংশ্লিষ্ট একশ্রেণির কর্মচারীর বিশেষ উদ্দেশ্য কাজ করছে। তিতাসের একটি চক্র আর্থিক সুবিধা নিতে দিনের বেলায় বিতরণ লাইনের রেগুলেটর বন্ধ রেখে সিএনজি স্টেশন এবং শিল্পকারখানায় বাড়তি গ্যাস সরবরাহ করছে।
এলাকাবাসীর প্রতিক্রিয়া: দক্ষিণখান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এএফএম তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘সকাল হলেই মানুষের গ্যাসের সমস্যার কথা শুনতে হয় আমাদের। মানুষজন খুব ক্ষুব্ধ হয়ে আছে। কিন্তু তিতাসের কর্মকর্তারা সমাধানের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।’
দক্ষিণখান ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য শাহ আলম সমকালকে বলেন, ‘দীর্ঘ চার বছর ধরে তিতাস অফিসে ঘুরতে ঘুরতে আমরা এখন কাহিল।’ এ প্রতিবেদকের সঙ্গে পরিচিত হয়ে দক্ষিণখানের কাওলা এলাকার ষাটোর্ধ্ব রফিক মিয়া ছন্দের তালে তালে গেয়ে ওঠেন, ‘চুলা আছে, গ্যাস নাই, বিল দিতে হয় মাসে মাসে, আমরা নিধিরাম সর্দার।’ আশকোনার গাওয়াই এলাকার আমিনুল হক ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘কেরোসিন আর কাঠের চুলায় রান্না করতে হয়। তারপরও গ্যাস বিল দেই। এখন গ্যাসের দাম বাড়ালে গ্যাস লাইন প্রত্যাহার করা ছাড়া উপায় থাকবে না।’
গ্যাস সমস্যার বিষয়ে তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মীর মশিউর রহমান বলেন, ‘এখন বিদ্যুৎ সেক্টরে বেশি গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে বলেই আমরা আবাসিক এলাকায় গ্যাস সরবরাহ করতে পারছি কম। এ ছাড়া আমাদের চাহিদার তুলনায় গ্যাসের ঘাটতিও আছে। বিদ্যুতে বেশি গ্যাস যাওয়ায় সমস্যা হচ্ছে। গ্যাস পাওয়ার জন্য পেট্রোবাংলাকে চিঠি লিখেছি, যেন আমাদের গ্যাস বেশি সরবরাহ করা হয়। আশা করছি আগামীতে গ্যাস সংকট কমে আসবে। অবৈধ বুস্টার দিয়ে গ্যাস টেনে নেওয়ায় সাধারণ মানুষের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,’ ওইসব অবৈধ বুস্টার মেশিন যারা চালাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ভিজিলেন্স টিম কাজ করছে, ব্যবস্থাও নিচ্ছে।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
রাজধানীতে আনসার ব্যাটালিয়ন মোতায়েন
ঢাকা মহানগরীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১৬ প্লাটুন আনসার ব্যাটালিয়ন সদস্য মোতায়েনবিস্তারিত পড়ুন
ঢাবি বন্ধের সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগে ধন্যবাদ জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হল ছেড়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদেরবিস্তারিত পড়ুন
রাজধানীতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষে সাংবাদিকসহ আহত ২৩
রাজধানীতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষে ছাত্রলীগ, শিক্ষার্থী, মহিলা আওয়ামী লীগবিস্তারিত পড়ুন