সন্তানের কাছে হেরে যাওয়া এক পিতার নীরব কান্না’ সত্য ঘটনা
স্বাধীন বাংলা, আহা মানুষের কি আনন্দ, সুখ। একে একে সকল মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অস্ত্র জমা দেয়ার পালা শেষ করলো। আজ বাংলার সকাল-বাতাস সবই কেমন যেন আলাদা লাগছে। মনে হচ্ছে এ সবই যেন আমার, ভয় নেই কিছুতেই। পাক-হানাদার বাহিনীরা আসবে না। দেখতে হবে না রক্তের ছাপ।শুনতে হবে না মায়েদের কান্না আর বোনদের হতে হবে না অত্যাচারীর শিকার।
সব মিলিয়ে কেমন যেন এক অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে নিজের মাঝে। এক স্বস্থির নিঃশ্বাস নিয়ে ছুটে চললাম বাড়ীর দিকে। সূর্যটা এই বুঝি অস্ত যাবে, মেঘনার ঘাটে বসে স্বাধীন বাংলার প্রথম সূর্য অস্ত যাওয়া দেখছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম উদ্দিন (ছদ্ম নাম)
কাল থেকে কি হবে স্বাধীন বাংলার, কেমন হবে এর রুপ। কি হবে আমার কাজ। এই সব নিয়ে ভাবতে ভাবতে রাত কাটিয়ে পর দিন ভোরে উঠে চা বিক্রি করবে মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম উদ্দিন। চা বিক্রির মধ্যে দিয়ে তিনি পৌঁছবেন সাধারণ মানুষের দ্বারে এবং নিজ চোখে দেখবেন তার হাতে স্বাধীন হওয়া এই বাংলার মানুষ কিভাবে দিন কাটাবে।
দেখতে দেখতে স্বাধীনতার ৪৫ বছর পার হয়ে গেছে। দেখেছেন নিজ হাতে গড়া এই বাংলার সকল মানুষের কষ্ট কিন্তু আফসোস তিনি তাদের কারোর সাহায্যেই আসতে পারেননি। মোসলেম উদ্দিনের আফসোস এখন শুধু দেশ বা দেশের মানুষে আবদ্ধ নেই। পাশাপাশি তিনি একজন অবহেলিত পিতাও। তার তিন সন্তান দুই জন ছেলে আর একটি মেয়ে, মেয়েটা সবার ছোট। মাশাল্লাহ দেখতেও বেশ সুন্দরী। আর ছেলে দুটো এখন মস্ত বড় চাকরিজীবী, তাদের বিয়ে হয়েছে, বউ এসেছে, নাতী এসেছে। মোসলেম উদ্দিন এখন শুধুই বুড়ো।সেই স্বাধীন বাংলার পরদিন থেকেই এই মোসলেম উদ্দিন হতবাগা পিতা চা এর কাড়া হাতে, পরিশ্রম করেছেন দিন রাত। বিয়ে করেছেন, সংসার করে গেছেন এই চা বিক্রি করেই। আর এই চা বিক্রি করেই মানুষ করেছেন দুই ছেলেকে, শিক্ষিত করে গড়ে তুলেছেন।
মানুষের মত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। আজ তারা প্রতিষ্ঠিত, বিয়ে করেছে বড়লোকের মেয়েকে। কিন্তু এই পিতার ভেতরটা তখন কেমন হবে যখন সে দেখবে তার সন্তান তাকেই দেখেনা, একটি খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন বোধতুকু মনে করে না।ঘটনাটি আমাকে বলছিলেন এক চা দোকানের খালা। তাহলে বলি কিভাবে শুরু হলও মোসলেম উদ্দিনের গল্প। মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেটের ঠিক উল্টো পাশে ঝালাই করে দোকানে আমি গিয়েছিলাম কিছু কাজে, দেরি হবে বলে খালার সেই টঙ্গের দোকানে বসেছিলাম চা খাবো বলে।
তখন খেয়াল করছিলাম এক বুড়ো লোক, খালি গায়ে একটা গামছা গায়ে, মুখে পান নিয়ে সে কখনো হিন্দিতে, কখনো বা উর্দুতে অনরগল ভাষণ দিয়ে যাচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম সে হয়তো বিহারী হবে কিন্তু না আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলও তিনি বাঙালি আর তিনিই সেই মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম উদ্দিন।
দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস নিয়ে টং দোকানের খালা বলতে লাগলো এই হলও কপাল, একটি মেয়ে আছে বিয়ের লায়েক কিন্তু বিয়ে করতাসে না। মেয়াটা পড়াশুনা করে, ভালো চাকরিও হয় কিন্তু না মেয়ে আরও বেশি পড়াশুনা করে আরও ভালো চাকরি করবে বলে আশা। এখন পড়াশুনায় মনোযোগ দিতে চায়।
মেয়েটা নাকি অনেক লক্ষী, সেই নাকি মোসলেম মিয়াঁর (বাবার) সব খেয়াল রাখে। ভাইরা কোন খেয়াল রাখে না।ভাইদের ভাষ্য মতে তাদের বাবা পাগল, আর তাতেই নাকি ছেলেদের অপমান হয়। অথচ ভুলেই গেলো এই হতভাগা পিতাই ঝর, বৃষ্টির পরোয়া না করে, রাস্তায় রাস্তায় চা বিক্রি করে সন্তানদের পড়াশুনা করিয়েছেন, তিন তিলে তিলে টাকা জমিয়ে, গ্রামের জমিজমা বিক্রি করে সন্তানদের খাতিরে ঢাকায় কোনরকম একটা নিজেদের বাড়ি করেছে। যার ভাড়া দিয়েই চলছে মোসলেম মিয়াঁর চিকিৎসা আর সংসার।
ছেলেরা বউ-নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। কেমন জানি কথাগুলা শুনে আর লোকটার চেহারা দেখে চোখে পানি চলে আসলো, খারাপ লাগলো এটা শুনে যে নিজের বাড়িতে তিনি ছাদে ঘুমান, ছেলেরা ঠিক মতো খাবার দিতে চায় না। রীতিমত সন্তানদের খারাপ ব্যবহার সহ্য করতে হচ্ছে তাকে। কিন্তু শান্তিতে আছেন মেয়েটা থাকায়, মেয়েটা না থাকলে হয়তো দুই ছেলের গলা ধাক্কায় রাস্তার ফুটপাথ জুটত তার কপালে।
টং দোকানের খালা বলছিলেন কি আর বলবো, লোকটা খুবি ভদ্র, স্বস্থির, কাও কে কিছু বলবে না সারা দিনে সকাল থেকে রাত এই এভাবেই নিজের মতো করে কথা বলবে। ছেলেরা বকাবকি করে, খারাপ ব্যাবহার করবে, তারপরেও কিছু বলবে না। মাথা নিচু করে ছাদের এক কোনায় ঘুমায় পরবে।এভাবেই কথার ঝুলি শেষ হয়ে আসলো, লোকটাকে আমি কয়েকবার চা খাবে কিনা জিজ্ঞাসা করলাম, উত্তরে প্রতিবার সে মানা করলো, আর অনরগল হিন্দি-উর্দুতে নিজের মতো কথা বলেই যাচ্ছে।
এমন স্বাধীন দেশই হয়তো মোসলেম মিয়া আমাদের উপহার দিয়েছেন যেখানে তিনি নিজেই নিজ সন্তানের কাছে অবহেলিত। আমরা হয়তো জানি না খুঁজলে হয়তো দেখবো দেশের আনাচে কানাচে লুকিয়ে আছে মোসলেম উদ্দিনের মত হাজারো মুক্তিযোদ্ধা। যারা এই দেশ স্বাধীনতো করেছেন কিন্তু তার বিনিময়ে লাঞ্ছনাই পেয়ে যাচ্ছেন। আজ সমাজের মুখে বেশি চর্চা হচ্ছে নামে মুক্তিযোদ্ধাদের কিন্তু কাজে তারা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না।
আর এভাবেই প্রতিনিয়ত এক একটি করে দিন পার হচ্ছে, আর ধামাচাপা হচ্ছে অনেক সত্য। এভাবেই প্রতিনিয়ত সূর্যমামা উদয় হচ্ছে আর অস্ত যাচ্ছে। প্রতিটি দিনিই হয়তো মোসলেম উদ্দিনের কথার সাক্ষী হয়ে থাকছে এবং থাকবে।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
পৃথিবীর সব প্রাণী ধ্বংস হবে কবে, জানালেন বিজ্ঞানীরা
পৃথিবীতে কোনো প্রাণী বা প্রজাতিই স্থায়ী নয়। একদিন না একদিনবিস্তারিত পড়ুন
এটিএম থেকে টাকার পরিবর্তে কী বের হচ্ছে?
এটিএম বুথের মেশিন থেকে টাকাই তো বের হওয়ার কথা। কিন্তুবিস্তারিত পড়ুন
৩৩ বছরে ছুটি নিয়েছেন মাত্র একদিন
১৯৪০-এ ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে নার্সিংয়ে হাতেখড়ি। দু’টি বিশ্বযুদ্ধ, ২৪ বার প্রধানমন্ত্রীবিস্তারিত পড়ুন