সিরিয়া পালিয়ে অস্ট্রেলিয়া কাঁপানো ছেলেটির গল্প
সে কখনো স্কুলের সেরা ছাত্র ছিল না। কখনোই না। সব সময় ক্লাসের শেষের দিকের বেঞ্চগুলোতে বসত। পড়াশোনা তার মোটেও ভালো লাগত না। পরীক্ষায় সব সময়ই খারাপ ফল করত। স্কুলে যেতেই মন চাইত না। ক্লাসে বসে হাঁসফাঁস করত- কখনো ক্লাস শেষ হবে। কখন ফুটবল নিয়ে মাঠে দৌড়াবে।
হ্যাঁ। দৌড়ানোর সুযোগ সে পেয়েছিল। তবে ফুটবল নিয়ে সবুজ মাঠে খুব বেশি দিন নয়। বরং যুদ্ধবিধ্বস্ত রক্তাক্ত লাল শহরের মাঝ দিয়ে জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে পালাতে পরিবারের সঙ্গে অনেক দীর্ঘ পথ দৌড়াতে হয়েছিল তাকে।
সাদ আলকাসাবের গল্প এটি। সিরিয়ার ছেলে। পড়াশোনায় মনোযোগী ছিল না মোটেও। হেসেখেলে জীবনটা ভালোই যাচ্ছিল। তবে ২০১১ সালের আগ পর্যন্ত। সে বছর যখন সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলো তখন সাদের বয়স মাত্র ১৪ বছর। এরপর দুই বছর স্কুলে যেতে হয়নি তাকে, যুদ্ধের কারণে।
বোমার আঘাত থেকে বাঁচতে শহর থেকে শহর পরিবারের সঙ্গে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে সাদকে। তার বড় ভাই ছিল স্কাউটের নেতা। মানবাধিকার সংগঠনকে সহায়তার দায়ে তাকে একবার গ্রেপ্তার করে আসাদ সরকারের বাহিনী। এরপর সাদের পরিবার সিদ্ধান্ত নেয়- সিরিয়া ছাড়তে হবে। অনেক বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে প্রাণ নিয়ে কোনোরকমে লেবাননে পৌঁছায় সাদ, তার বাবা-মা, দুই ভাই ও বোন। এর পর মিশরে। সেখানে এক বছর থেকে পাড়ি জমায় অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে।
২০১৪ সালের মাঝামাঝি সাদ মেলবোর্নে পৌঁছায় সিরিয়ায় যুদ্ধের ভয়ঙ্কর স্মৃতি নিয়ে। সেখানে চোখের সামনে সে মৃত্যু দেখেছে। দেখেছে বোমায় হাত-পা উড়ে যাওয়া মানুষ, রক্তাক্ত জীবন। সে সিরিয়ায় পড়াশোনা করতে চাইত না। অথচ তার যে বন্ধুরা স্কুলের সেরা ছাত্র ছিল তারা অধিকাংশই আর পড়ালেখার সুযোগ পায়নি। কেউ যুদ্ধে মারা পড়েছে। কেউবা জীবন নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে শহর থেকে শহরে। খেতে পাচ্ছে না, শীত থেকে বাঁচতে বস্ত্র নেই, নেই চিকিৎসা। কারো কারো মা-বোন ধর্ষিত হচ্ছে আইএস, সরকার কিংবা বিদ্রোহীদের কাছে।
সিরিয়ার সেসব বীভৎস স্মৃতি সাদকে আমূল বদলে দিল। তার ভেতর এই বোধ জাগ্রত হলো যে- জীবনকঠিন, অত্যন্ত কঠিন। এখানে অনেক সুযোগ সামনে থাকলে তাকে হেসেখেলে হাতছাড়া করা সহজ। কিন্তু কঠিন বাস্তবতা সামনে এসে দাঁড়ালে তাকে মোকাবিলা করা সত্যিই খুব কঠিন। তাই সাদ মনস্থির করল- তাকে পড়াশোনা করতে হবে।
তবে সাদের সামনে এখন সবচেয়ে বড় যে বাধা দেখা দিল তা হলো- ভাষাগত সমস্যা। সে যখন মেলবোর্ন পৌঁছাল, ইংরেজি মোটেও জানত না। তাই একসময়ের স্কুল ফাঁকি দেওয়া ছেলেটি এখন স্কুলে ভর্তি হতে চাইলেও প্রত্যাখ্যাত হলো।
তবে হতাশ হয়নি সাদ। হতাশ হলে যে তার চলবে না। ‘দ্বিতীয় জীবন’টাকে কাজে লাগাতেই হবে তাকে। সাদ ইংরেজিতে দক্ষতা বাড়ানোর জন্য টেলিভিশনে অস্ট্রেলিয়ার সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্ব দেখা শুরু করল। তার ভাষায়, ‘সাংসদরা সংসদে সবচেয়ে সুন্দর ও বোধযোগ্য ইংরেজি ব্যবহার করে। তারা খুব ধীরে ধীরে কথা বলে এবং সেখান থেকে ইংরেজি শেখা সত্যিই সহজ।’
সাদ তার ধৈর্য ও পরিশ্রমের ফলও পেল। কয়েক মাস পর সে আবার স্কুলে ভর্তির জন্য পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলো এবং এবার অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম সেরা স্কুল ক্যাথলিক রিজিওনাল কলেজ সাইডেনহামে পড়াশোনার সুযোগ পেল। সেখানে পড়াশোনা শেষে সাদ অস্ট্রেলিয়ান টারশিয়ারি অ্যাডমিশন র্যাংকে (এটিএআর) ৯৬.৬৫ শতাংশ মার্কস পেয়ে দেশটিতে হইচই ফেলে দিয়েছে। দুই বছর আগেও যে ছেলে ইংরেজি মোটেও জানত না, সে-ই কি না এখন পুরো অস্ট্রেলিয়ায় রেকর্ড মার্কস নিয়ে পাস করল। কাঁপিয়ে দিল গোটা অস্ট্রেলিয়াকে। সাদের এই অভাবনীয় সাফল্যের গল্প শুধু অস্ট্রেলিয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কল্যাণে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী।
সাদের এমন অভূতপূর্ণ সাফল্যের পর মেলবোর্ন মোনাশ ইউনিভার্সিটি থেকে বায়োমেডিসিনে পড়ার প্রস্তাব পেয়েছেন। সাদ চিকিৎসক হতে চাইছেন।
সাদ নিজের পরিবর্তন সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলে, ‘যুদ্ধের আগে সত্যি কথা বলতে কি, আমি ছিলাম ফাঁকিবাজ। আমার ইচ্ছা হতো যেন কখনোই স্কুলে যেতে না হয়। আমার ইচ্ছা পূরণ হয়েছিল, তবে তা ছিল ভয়ঙ্কর। আমি অনুতপ্ত বোধ করতে লাগলাম। আর প্রতিজ্ঞা নিলাম আমাকে ভালো কিছু করতেই হবে।’
সাদ আরো বলে, ‘আমি খুবই হতাশ যে, সিরিয়ায় উদ্বাস্তুদের দুর্দশার প্রকৃত চিত্র বিশ্বের কাছে আসছে না। সেখানকার পরিস্থিতি সত্যিই ভয়াবহ। আমি সত্যিই খুব দুঃখিত যে, সিরিয়ার আমার বন্ধুরা যারা আমার চেয়েও অনেক ভালো ছাত্র ছিল, তারা আজ হারিয়ে গেছে। অনেকে মারা গেছে। অনেক বেঁচে থাকলেও পড়াশোনা করতে পারছে না। তারা যদি শিক্ষার সুযোগ পেত!’
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
পৃথিবীর সব প্রাণী ধ্বংস হবে কবে, জানালেন বিজ্ঞানীরা
পৃথিবীতে কোনো প্রাণী বা প্রজাতিই স্থায়ী নয়। একদিন না একদিনবিস্তারিত পড়ুন
এটিএম থেকে টাকার পরিবর্তে কী বের হচ্ছে?
এটিএম বুথের মেশিন থেকে টাকাই তো বের হওয়ার কথা। কিন্তুবিস্তারিত পড়ুন
৩৩ বছরে ছুটি নিয়েছেন মাত্র একদিন
১৯৪০-এ ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে নার্সিংয়ে হাতেখড়ি। দু’টি বিশ্বযুদ্ধ, ২৪ বার প্রধানমন্ত্রীবিস্তারিত পড়ুন