সেই স্মৃতি মনে হলে ভালো থাকতে পারি না
জেলার মাধবপুর উপজেলার বেলঘর গ্রামের বাসিন্দা আতাব মিয়ার মেয়ে মাজেদা বেগম। স্বাধীনতাযুদ্ধের তিন মাস আগে একই উপজেলার আদাঐর ইউনিয়নের সুলতানপুর গ্রামের বাসিন্দা আলাই মিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয় ২০ বছরের মাজেদার।
এরই মধ্যে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। হাতের মেহেদি রং মোছেনি তখনো মাজেদার। পাকদের হাত থেকে বাঁচার জন্য মাজেদা চলে এলেন বাবার বাড়ি বেলঘরে। ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় রাজাকারসহ পাকিস্তানি সেনারা মাজেদার বাবার বাড়িতে হামলা চালায়। পুরুষদের ধরে নিয়ে বাঙ্কার খননকাজে নিয়োজিত করে। আর মাজেদাকে ধরে জগদীশপুর হাইস্কুলের ক্যাম্পে নিয়ে সম্ভ্রমহানি করে। সাত দিন পাকসেনাদের অমানবিক অত্যাচারে একসময় মাজেদা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
ক্যাম্প এলাকার রাজাকারপ্রধান কায়সারকে তখন পাকসেনারা বলেন, মাজেদা নামের মেয়েটি মারা গেছে। কিন্তু জ্ঞান ফিরলেও মাজেদা মৃত হওয়ার ভান করে পড়ে থাকেন। পরে মৃত ভেবে রাতে তাকে জগদীশপুর প্রাথমিক স্কুলের বারান্দায় ফেলে রাখা হয়। রাতের আঁধার কেটে সকাল হলে জ্ঞান ফিরলে মাজেদা দেখতে পান তার পরনে রক্তমাখা কাপড়। জীবিত দেখলে পাকসেনারা আবারও তাকে এসে নিয়ে যাবে। তাই তিনি খাল দিয়ে লুকিয়ে বাবার বাড়ি যান।
স্বজনদের সেবায় তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। এরপর বাবার বাড়িতেই বসবাস করতে থাকেন। এভাবে তার (এর মধ্যে কিছু কাহিনির কথা তিনি প্রকাশ করতে রাজি হননি, আর এগুলো পত্রিকায় প্রকাশ না করতেও অনুরোধ করেন) ছয় বছর কেটে যায় । পরে তিনি স্বামীর কাছে ফিরে আসেন। তার গর্ভে জন্ম নেওয়া শামসুন্নাহার বেগম, নূরুন্নাহার বেগম ও আসমা আক্তারকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে কামরুল হোসেন জীবিকার তাগিদে সিএনজি অটোচালকের কাজ নেন।
এদিকে মাজেদার স্বামী আলাই পরে আরো দুটি বিয়ে করেন। তবে কিছুদিন পর আলাই মারা যান। তারপর থেকে মাজেদা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির জন্য অনেকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। পরবর্তী সময়ে আদাঐর ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের কমান্ডার ফরিদ আহমদসহ মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় বীরাঙ্গনা মাজেদা মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার আবেদন করেন।
অবশেষে স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৪ বছর পর গত ১২ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে সারা দেশের ৪১ বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। এর মধ্যে হবিগঞ্জ থেকে মাজেদা বেগমও মুক্তিযোদ্ধার খেতাব লাভ করেন।
সমাজসেবক হামিদুল হক বুলবুলকে সঙ্গে নিয়ে মাধবপুর উপজেলার সুলতানপুর গ্রাম পরিদর্শনকালে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়া মাজেদার সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্য বের হয়ে আসে।
মাজেদা বলেন, ‘সরকার দীর্ঘদিন পর হলেও আমাকে শুধু মর্যাদা প্রদান করেনি, উপজেলা শহরে থাকার জন্য আট শতক জমি দান করেছে। তার সঙ্গে আমাকে ও আমার কন্যা শামসুন্নাহারকে ১০ লাখ টাকার চেক দিয়েছে। আমি বর্তমান সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তার সঙ্গে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যারা আমাকে বিভিন্ন সহযোগিতা করছেন।’
তবে তিনি জানান, সরকারিভাবে জমি দান করলেও এ জমিটুকু দখল করে নিতে একটি চক্র নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য আমি প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেছি। এখন আপনি কেমন আছেন- প্রশ্ন করা হলে মাজেদা বলেন, ‘ভালোই আছি, তবে সেই স্মৃতি মনে হলে ভালো থাকতে পারি না। মৃত্যুর আগে চিহ্নিত রাজাকারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখে যেতে চাই।’
মাজেদা বেগমের সাক্ষাৎকার নিতে তার বাবার বাড়ি বেলঘরে গেলে মাধবপুর উপজেলা কমান্ডের সহকারী কমান্ডার মো. এনাম খান বলেন, বর্তমানে মাজেদা বেগম সুলতানপুরে তার স্বামীর বাড়িতে বসবাস করছেন। তিনি বলেন, মাজেদা বেগম পাকদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যাই হোক সরকার তাকে মূল্যায়ন করেছেন। তিনি আরো বলেন, যুদ্ধ চলাকালে আমি এলাকায় ছিলাম না। পরে এসে পাকসেনাদের নির্যাতনের কাহিনি শুনেছি। তিনিও এলাকার চিহ্নিত রাজাকারদের বিচার কার্যকর করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধে দেশের স্বার্থে বীরাঙ্গনারা অনেক বড় ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাদের অবদান কখনোই ভোলার নয়। এ কারণে সরকার বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ৪১ বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার মতো সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন। পর্যায়ক্রমে আরো বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
চা কন্যা খায়রুন ইতিহাস গড়লেন
চা শ্রমিকদের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে সব মহলেই পরিচিত হবিগঞ্জেরবিস্তারিত পড়ুন
চার্জ গঠন বাতিল চেয়ে রিট করবেন ড. ইউনূস
শ্রমিক-কর্মচারীদের লভ্যাংশ আত্মসাতের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড.বিস্তারিত পড়ুন
ড. ইউনূসের মন্তব্য দেশের মানুষের জন্য অপমানজনক : আইনমন্ত্রী
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, কর ফাঁকি দেওয়ার মামলাকে পৃথিবীর বিভিন্নবিস্তারিত পড়ুন