হেরে যাবে না মামুন (ভিডিওসহ)
কথায় বলে, জীবনে চলতে গেলে সামঞ্জস্যতা প্রয়োজন হয়। সামঞ্জস্যতা না থাকলে প্রতি পদে পদে ঠোকর খেতে হয়। কিন্তু একবার ভেবে দেখুনতো কথাটা কতটুকু পুরোপুরি সত্যি। একমাত্র জীবনই জানে জীবনের নানান বাঁকের খবর। যেমন জানেন মোহাম্মদ মামুন নামের সেই রিকসাচালক। যদিও মামুনকে রিকসাচালক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়াটা অত সহজ নয়। প্রত্যাহিক গড়পড়তা জীবনের বিচিত্র ঘটনার প্রেক্ষাপটে অনেক ঘটনাই আমাদের প্রতিদিন নাই চাইলেও এড়িয়ে যেতে হয়, এড়িয়ে যাচ্ছিও আমরা। যেমনটা আমিও প্রতিদিন অফিসে আসার পথে নানান ঘটনা এড়িয়ে যাই। তবু মামুন যেন চুম্বক হয়ে আজ আমার চোখ হয়ে অন্তরের মধ্যে প্রবেশ করে গেছে আজ। আর তাই আজ তাকে নিয়ে কিছু কথা বলা।
জন্মসূত্রে মামুন ঢাকার হলেও শেকড় তার সেই ফরিদপুরে বাধা। সমাজের নিম্নশ্রেণির মধ্যে যা হয়, মামুনের ক্ষেত্রেও তার চেয়ে একটু বেশিই হয়েছে। পারিপার্শ্বিকতা এবং অর্থনৈতিক কারণে লেখাপড়া করা হয়ে ওঠেনি তার। লেখাপড়া না হলেও ক্ষতি ছিল না, কিন্তু মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই টাইফয়েডে একটি পা হারান তিনি। ক্রমশ শুকিয়ে যেতে যেতে একটা সময় ডাক্তারের পরামর্শে পাটি কেটেই ফেলতে হয় তাকে। ওই এক পা নিয়েই শৈশব থেকে নানান কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে সংসারের মূল উপার্জনক্ষম মানুষ হিসেবে নিজেকে দাড় করায় মামুন। এক পর্যায়ে বাবা মারা যাওয়ার পর যেন বাস্তবতা আরও আকড়ে ধরে তাকে।
সময়ের চাকায় ভর দিয়ে মামুনের বয়স বাড়তে থাকে। স্বপ্ন আর সাধকে সাথী করে ঢাকার স্বামীবাগ এলাকায় একটি ছোটো পান-বিড়ির দোকানও দেয় মামুন। খারাপ চলছিল না তার, এলাকার মানুষের সাহায্য সহযোগিতা আর দোকান থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে মোটামুটি নির্বিঘ্নেই চলছিল জীবন। কিন্তু সুখতো বেশিদিন মানুষের ঘরে বাস করে না। এই করতে করতে একদিন মায়ের দূরারোগ্য ব্যধি ক্যান্সার ধরা পরে। আমাদের সমাজে অনেক সন্তান আছেন যারা বাবা-মা বৃদ্ধ হয়ে গেলে বৃদ্ধাশ্রম বা এড়িয়ে যান। কিন্তু মামুন তা করেনি, নিজের দোকান বিক্রি করে দিলেন মায়ের চিকিৎসার জন্য। এমনকি নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের কথাও ভাবলেন না। কারণ মামুনের কাছে তার মা শুধুই জন্মদাত্রী নয়, মা তার কাছে পরম পূজনীয়।
দোকান বিক্রি করলেও মায়ের ব্যধিতো আর সেরে ওঠে না। তখন থেকেই এক পা নিয়ে মামুন এই তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ ঢাকা শহরে রিকসা চালাতে শুরু করেন। আমার সঙ্গে যখন তার দেখা হয়, তখন তার রিকসা চালনায় বয়স মাত্র দু বছর। রাস্তায় রিকসা চালানোর সময় স্বাভাবিক রিকসাচালকদের তুলনায় কোনো কমতি পাওয়া যাবে না মামুনের চালনার মাঝে। সক্ষম পা’টিকে দিয়ে প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ করে রিকসার প্যাডেল ক্রমাগত ঘুরিয়েই যাচ্ছে সে। বিষয়টা এমন যে, ভাগ্যের চাকাকে ঘুরতেই হবে মামুনের জন্য। প্যাডেলের প্রতিটি চাপ মামুনকে তার ভাগ্য পরিবর্তনের আরও একধাপ সামনে নিয়ে যায়। সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে সন্ধ্যে… এরপর গভীর রাতে বুকের উপর দুই সন্তানকে নিয়ে মামুন কি ভাবে তা আমার পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব নয়, তবে এতটুকু বুঝতে পারি হেরে যাবার কোনো ইচ্ছেই মামুনের নেই।
স্বামীবাগের মুন্সিরটেক নামক এক জায়গায় ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে মামুন। ছেলেটা স্থানীয় একটি স্কুলে কেজিতে পড়ে এবং মেয়ে এখনও মায়ের কোলে। কথা হচ্ছিল ওর সঙ্গে জীবনের চাওয়া পাওয়া নিয়ে। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, জীবনে সুখের উপস্থিতি সম্পর্কে এত স্বচ্ছ ধারণা হয় কি করে এই ভাগ্যপীড়িতের। ‘ভিক্ষা করতে চাই না, ভিক্ষা করলে নিজেরে ছোটো করা হয়, তাই রিকসা নিয়া বাইর হইছি। আপনারা ন্যয্য ভাড়া দিলেই তবে আমি বউ-বাচ্চা নিয়া বাঁচতে পারুম।’ কথাগুলো মামুন অন্তরের কোথা থেকে বলেছে তা কেবল আমার চোখ জানে আর জানে মহাকাল।
মামুনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে চোখ যায় তার প্যাডেলের দিকে। দেখি, প্যাডেলের সঙ্গে তার একটি স্যান্ডেল বাধা। কারণ জিজ্ঞেস করতেই হাসি মুখে জানালো, ‘প্যাডেলে স্যান্ডেল বাধা থাকলে জোর পাই পায়ে, একপায়ে বেশিক্ষনতো আর চালাতে পারি না। একটা সময় পায়ে শক্তি থাকে না, তখন স্যান্ডেল খুলে যায়।’ আমার আর কোনো উত্তরের প্রয়োজন হয়নি ওই উত্তরের পর। দৈনিক প্রায় ১২ ঘন্টা এক পা দড়ি দিয়ে প্যাডেলের সাথে বেধে রিক্সা চালায় সে।
বর্তমানে ঢাকায় রিকসার জমা ১২০ টাকা। কিন্তু মামুন যেহেতু এক পায়ে রিক্সা চালায় তাই তার গ্যারেজ মালিক দয়া করে তার কাছে থেকে বিশ টাকা কম নেয়। আর এতেই খুশি আমাদের মামুন। ১০০ টাকা রিকসার দেয়ার পর দৈনিক তার প্রয়োজন হয় ৪৫০-৫০০ টাকা। তার মধ্যে ২০০ টাকা ব্যয় হয় সংসার খরচে, আর ২৬০ টাকা ব্যয় হয় ক্যান্সার আক্রান্ত মায়ের ঔষধ কিনতে (মামুনের ভাষায় চারটি ট্যাবলেট ২৬০ টাকা)। এই হলো মামুনের চাহিদা। এবার ভেবে দেখুনতো, আমাদের প্রতিদিন জীবন চলতে কত কি লাগে?
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
চা কন্যা খায়রুন ইতিহাস গড়লেন
চা শ্রমিকদের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে সব মহলেই পরিচিত হবিগঞ্জেরবিস্তারিত পড়ুন
চার্জ গঠন বাতিল চেয়ে রিট করবেন ড. ইউনূস
শ্রমিক-কর্মচারীদের লভ্যাংশ আত্মসাতের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড.বিস্তারিত পড়ুন
ড. ইউনূসের মন্তব্য দেশের মানুষের জন্য অপমানজনক : আইনমন্ত্রী
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, কর ফাঁকি দেওয়ার মামলাকে পৃথিবীর বিভিন্নবিস্তারিত পড়ুন