কবরের ভয়াবহ আজাব
পরকালের জীবন শুরু হওয়ার প্রথম ধাপ হচ্ছে কবর। এই কবরের মধ্য দিয়ে পরকালের জীবন শুরু করবে। তবে যিনি শান্তিতে থাকবেন, কেয়ামতের দিনও তার হিসাব-নিকাশ নিরাপদ হবে।
কবরের পরীক্ষা
প্রতিটি আদম সন্তানকে, হোক তিনি বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী, সবাইকেই কবরে ৩টি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে।
১. ‘মার-রব্বুকা’ – তোমার রব্ব কে?
২. ‘ওয়ামা দ্বীনুকা’ – তোমার দ্বীন (ধর্ম বা জীবন ব্যবস্থা) কি?
৩. এই ব্যক্তি কে (রাসুল সাঃ এর ব্যাপারে প্রশ্ন করা হবে)?
শুধুমাত্র আল্লাহর প্রতি সঠিক ঈমান রেখে এবং কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী নেক আমল করে, নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত যথাযথভাবে পালন করে, দুনিয়াতে আল্লাহকে ভয় করে যারা আল্লাহর অনুগত থাকবেন, শুধুমাত্র তারাই এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারবেন। এই পরীক্ষায় আল্লাহর ইচ্ছায় মানুষ কথা বলতে পারবে। ভাষা কোনো সমস্যা হবে না। এই পরীক্ষায় যিনি পাস করবেন কেয়ামত পর্যন্ত তিনি শান্তিতে থাকবেন।
আর কাফের, মুশরেক, মুনাফেক বা নামকাওয়াস্তে মুসলমান, বেনামাযী, কবর-মাযারপূজারী, হালাল-হারাম সম্পর্কে বেপরোয়া, ফাসেক, পাপাচারী, পাপিষ্ঠ – এরা দুনিয়ার জীবনে যতই নিজেকে মুসলমান দাবী করুক না কেনো, তারা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কস্মিন কালেও দিতে পারবেনা। তারা হায় আফসোস! আমি জানিনা, আমি জানিনা বলে আহাজারি করবে এবং কঠিন শাস্তি ভোগ করতে থাকবে।
কবরের ভয়াবহ আযাব
দুনিয়ার জীবনে পাপাচারে লিপ্ত ব্যক্তিরা, যারা তওবা করবে না তারা আল্লাহর রহমত অর্জনে ব্যর্থ হবে। তাদের জাহান্নামের শাস্তি কবরের জীবনেই শুরু হবে। এই শাস্তি চলবে কেয়ামত পর্যন্ত। এরপর রয়েছে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি। এই শাস্তি তো আরও কঠোর এবং দীর্ঘস্থায়ী।
রাসুল (সাঃ) আমাদেরকে বারবার কবরের আযাব থেকে বাঁচতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার উপদেশ দিয়েছেন। তিনি নিজেও নামাযের ভেতরে ও বাইরে কবরের আযাব থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতেন।
কবরের আযাবের ভয়াবহতা চিন্তা করে সাইয়্যিদিনা উসমান ইবনে আফফান (রাঃ) কান্নায় ভেঙ্গে পড়তেন। এমনকি তাঁর কাপড় ভিজে যেত চোখের পানিতে।
কবরের শাস্তির উদাহরণ
১. মিথ্যাবাদী ও মিথ্যা প্রচারকারী
মিথ্যাবাদীকে দাঁড়ানো অবস্থায় এক পাশের চোয়াল এমনভাবে আকড়া দিয়ে বিদ্ধ করা হবে যে সেটা তার চোয়াল বিদীর্ণ করে মাথার পেছনভাগ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। তারপর অপর চোয়ালটিকেও একইভাবে বিদীর্ণ করা হবে। এইভাবে তাদেরকে কেয়ামত পর্যন্ত শাস্তি দেওয়া হবে।
২. কুরআন শিখে আমল না করা এবং বেনামাজিদের শাস্তি
কুরআনকে অবহেলাকারী ও বেনামাজিকে মাটিতে ফেলে তার মাথার কাছে একজন আজাবের ফেরেশতা দাঁড়িয়ে পাথর দিয়ে আঘাত করে তার মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবে। নিক্ষিপ্ত পাথর দূরে গড়িয়ে যাওয়ার ফলে তা তুলে নিয়ে শায়িত ব্যক্তির কাছে ফিরে আসার আগেই ভেঙ্গে যাওয়া মাথা আগের মতো আবার জোড়া লেগে যাবে। ফেরেশতা ফের তার মাথার উপরে পাথর নিক্ষেপ করবে। এইভাবে তাদেরকে কেয়ামত পর্যন্ত শাস্তি দেওয়া হবে।
৩. জেনাকারী নারী-পুরুষের শাস্তি
চুলার মতো বড় একটা গর্ত থাকবে, দেখতে বিশাল কড়াইয়ের মতো। গর্তের উপরিভাগ হচ্ছে সরু ও নিচের অংশ চওড়া এবং এর নিচ থেকে আগুন জ্বলতে থাকবে। এর ভেতরে জেনাকারী নারী ও পুরুষদেরকে উলঙ্গ করে আগুনে পুড়িয়ে শাস্তি দেওয়া হবে। আগুন গর্তের একেবারে মুখের কাছে চলে আসলে জেনাকারীরা আগুনের তাপ সহ্য করতে না পেরে উপরে চলে আসবে যেন তারা গর্ত থেকে পালিয়ে যেতে পারে। ফেরেশতারা তাদেরকে আবার আগুনের গর্তে ফেরত পাঠাবেন। আগুনের তাপ একটু কমে আসলে তারা আবার গর্তে নিচে ফিরে যাবে। এইভাবে তাদেরকে কেয়ামত পর্যন্ত শাস্তি দেওয়া হবে।
ঘরে স্বামী/স্ত্রী রেখে অন্য কারো সাথে জেনা করার শাস্তি
নবী (সাঃ) মিরাজের রাত্রিতে একদল লোকের কাছে উপস্থিত হয়ে দেখতে পেলেন তাদের সামনে একটি পাত্রে গোশত রান্না করে রাখা হয়েছে। অদূরেই অন্য একটি পাত্রে রয়েছে পঁচা দুর্গন্ধযুক্ত কাঁচা গোশত। লোকদেরকে রান্না করে রাখা গোশত থেকে বিরত রেখে পঁচা এবং দুর্গন্ধযুক্ত কাঁচা গোশত খেতে বাধ্য করা হচ্ছে। তারা চিৎকার করছে এবং একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও তা খাচ্ছে।
নবী (সাঃ) জিবরাইল ফেরেশতাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এরা কোন শ্রেণির লোক?’ জবাবে জিবরাইল বললেন, ‘এরা আপনার উম্মতের ওই সমস্ত পুরুষ লোক যারা নিজেদের ঘরে পবিত্র এবং হালাল স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও অপবিত্র এবং খারাপ মহিলাদের সঙ্গে রাত কাটাতো। (সূত্র : আল-খুতাবুল মিম্বারিয়া, ডা সালেহ আল-ফাওজান।)
৪. সুদখোরের শাস্তি
জাহান্নামে একটি রক্ত প্রবাহিত নদী আছে যার মাঝখানে সুদখোর দাঁড়ানো থাকবে। নদীর তীরে একজন ফেরেশতা থাকবে যার সামনে অনেক পাথর থাকবে। সুদখোর রক্তের নদী থেকে বের হয়ে আসার জন্য তীরে আসার চেষ্টা করলে তীরে দাঁড়ানো আজাবের ফেরেশতা সে ব্যক্তির মুখ বরাবর পাথর নিক্ষেপ করবে। এতে সুদখোর আবার নদীর মাঝখানে চলে যাবে। এমনভাবে যতবার সুদখোর তীরে উঠে আসতে চেষ্টা করবে ততবার ওই ফেরেশতা তার মুখ বরাবর পাথর নিক্ষেপ করে আগের জায়গায় ফিরে যেতে বাধ্য করবে। এইভাবে তাদেরকে কেয়ামত পর্যন্ত শাস্তি দেওয়া হবে।
এ ছাড়া উহুদ পাহাড়ের সমান ওজনের হাতুড়ি দিয়ে মাথায় আঘাত করা, বিষাক্ত সাপের দংশন, বিচ্ছুর কামড় ইত্যাদি শাস্তি থাকবে কবরে।
কবরে আযাব হওয়ার কারণ
কবরের আযাব হওয়ার কারণ হচ্ছে দুনিয়ার জীবনে কবীরাহ গুনাহ বা বড় বড় পাপ কাজে লিপ্ত থাকা। কবীরাহ গুনাহতে লিপ্ত থাকা এবং তওবা না করে, সংশোধন না করেই মৃত্যুবরণ করা। হাদীসে বিশেষ ২টি কারণ উল্লেখ করা আছে। যেই দুইটি পাপকে মানুষ ছোট মনে করে কিন্তু অনেকেই এই ২টি পাপ কাজের কারণে আযাব দেওয়া হবে।
১. চোগলখুরী করা (এক জনের গীবত আরেকজনের কাছে বলে মানুষের মাঝে ঝগড়া-বিবাদ ও হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করা)।
২. পেশাবের অপবিত্রতা থেকে সাবধান না থাকা।
রাসূল (সাঃ) মদীনা বা মক্কার কোনো একটি বাগানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেখানে তিনি দু’জন এমন মানুষের আওয়াজ শুনতে পেলেন, যাদেরকে কবরে শাস্তি দেয়া হচ্ছিল। রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘তাদেরকে আযাব দেয়া হচ্ছে। অথচ বড় কোনো অপরাধের কারণে আযাব দেয়া হচ্ছে না।’
তারপর তিনি (সাঃ) বললেন, ‘তাদের একজন পেশাব করার সময় আড়াল করত না। আর দ্বিতীয় ব্যক্তি একজনের কথা অন্যজনের কাছে লাগাত।’ (সহিহ বুখারী, কিতাবুল ওযু অধ্যায়।)
কাতাদা (রঃ) বলেন, ‘আমাদেরকে বলা হয়েছে কবরের আযাবের এক তৃতীয়াংশ হবে গীবতের কারণে, এক তৃতীয়াংশ পেশাব থেকে সাবধান না থাকার কারণে এবং এক তৃতীয়াংশ চুগলখোরীর কারণে। যেহেতু গীবতকারী এবং চুগলখোর মিথ্যা কথাও বলে থাকে তাই সে মিথ্যাবাদীর শাস্তিও ভোগ করবে।
কবরের আযাব থেকে বাঁচার উপায়
১. কবরের আযাব থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া ও দোয়া করা
কবরের আযাব থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর কাছে নিয়মিত দোয়া করতে হবে। বিশেষ করা দোয়া মাসুরাতে বেশি বেশি দুয়া করতে হব।
দুয়া মাসুরা অর্থ হচ্ছে হাদীসে বর্ণিত দোয়া যেগুলো রাসুল (সাঃ) করতেন।
অনেকেই মনে করেন দোয়া মাসুরা শুধু একটাই (আল্লাহুম্মা ইন্নি জালামতু নাফসান যুলমান কাসিরাও…)। এটা ভুল। নামাযে সালাম ফিরানোর আগে পড়তে হয় এমন অনেক সুন্দর সুন্দর দোয়া আছে সহীহ হাদীসে। কারণ, ফরয নামাযে আত্তাহিয়্যাতু ও দুরুদ পড়ার পরে সালাম ফেরানোর আগে দুয়া বেশি কবুল করা হয়। দুয়া মাসুরা এক বা একের অধিক, যত ইচ্ছা পড়া যায়। এইগুলো মুখস্থ করে আমল করা উচিত।
৪টি জিনিস থেকে আশ্রয় চাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ দোয়া মাসুরা আছে। কবরের আজাব, জাহান্নামের আজাব, দুনিয়ার ফেতনা ও মৃত্যুর সময়ের ফেতনা ও দাজ্জালের ফেতনা থেকে নিরাপদ থাকার জন্য দুয়া মাসুরা।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এইগুলো থেকে বাঁচার জন্য ফরয, নফল বা সুন্নত, যে কোনো সালাতে তাশাহুদ ও দুরুদের পরে সালাম ফিরানোর আগে এই দুয়া পড়তে বলেছেন।
اَللَّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ، وَمِنْ عَذَابِ جَهَنَّمَ، وَمِنْ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَالْمَمَاتِ، وَمِنْ شَرِّ فِتْنَةِ الْمَسِيْحِ الدَّجَّالِ.
উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা ইন্নী আ’উযুবিকা মিন আ’যাবিল ক্বাবরি ওয়া মিন আ’যাবি জাহান্নাম, ওয়ামিন ফিতনাতিল মাহ’ইয়া, ওয়াল্ মামাতি, ওয়ামিং সাররি ফিতনাতিল্ মাসীহি’দ্-দাজ্জাল।
অর্থ : হে আল্লাহ! তুমি আমাকে কবরের আযাব থেকে রক্ষা করো, আমাকে জাহান্নামের আযাব এবং দুনিয়ার ফিৎনা ও মৃত্যুর ফেতনা এবং দাজ্জালের ফিৎনা থেকে রক্ষা করো। (বুখারী ২১০২, মুসলিম ১/৪১২, হিসনুল মুসলিম)
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) দোয়া মাসুরা হিসেবে এই দোয়া পড়তে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন।
২. কবীরা গুনাহ, যেইগুলো বড় বড় পাপকাজ, সেইগুলো যে কারণে কুরআন ও সহীহ হাদীসে কঠিন শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে, সেইগুলো বর্জন করা ও আল্লাহর বেঁধে দেওয়া ফরয ও ওয়াজিব হুকুম পালনে যত্নবান হওয়া।
৩. সুরা মুলক
প্রতিদিন সুরা মুলক তেলাওয়াত করলে আশা করা যায় আল্লাহর রহমতে কবরের আজাব ও কেয়ামতের দিন শাস্তি থেকে নিরাপদ থাকা যাবে।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতিদিন রাতের বেলা তাবারাকাল্লাযী বিয়াদিহিল মুলক (সুরা মুলক) তেলাওয়াত করবে আল্লাহ তাকে কবরের আজাব থেকে রক্ষা করবেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর জমানায় এই সুরাটিকে আমরা “আল-মা’আনিয়াহ” বা সুরক্ষাকারী বলতাম। যে রাতের বেলা এই সুরাটি পড়বে সে খুব ভালো একটা কাজ করলো।’ (সুনানে আন-নাসায়ী ৬/১৭৯, শায়খ আলবানীর মতে হাদীসটি হাসান সহীহ, সহীহ আত-তারগীব ওয়াল তারহীব ১৪৭৫।)
এই সুরা প্রত্যেকদিন রাতের বেলা তেলাওয়াত করলে কিয়ামতের দিন শাফায়াত করে জান্নাতে নিয়ে যাবে ইন শা’ আল্লাহ।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘কুরআনে এমন একটা সুরা আছে যার মধ্যে ৩০টা আয়াত রয়েছে যেটা একজন ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করবে এবং তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে। আর সেটা হলো তাবারাকাল্লাযী বিয়াদিহিল মুলকু (সুরা মুলক)।’ (সুনানে আত-তিরমিযী ২৮৯১, সুনানে আবু দাউদ ১৪০০, মুসনাদের আহমাদ, ইবনে মাজাহ ৩৭৮৬। ইমাম তিরমিযী বলেছেন হাদীসটি হাসান, ইবনে তাইমিয়্যা বলেছেন সহীহ মাজমু ২২/২২৭, শায়খ আলবানীর মতে হাদীসটি সহীহ, সহীহ তিরমিযী ৩/৬, সহীহ ইবনে মাজাহ ৩০৫৩।)
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
ঈদের ছুটির পর বুধবার থেকে নতুন অফিস সময়সূচি
পবিত্র ঈদুল আজহার পর সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিতবিস্তারিত পড়ুন
সৌদিতে হজে বিভিন্ন দেশের ৫৫০ হাজির মৃত্যু
সৌদি আরবে এ বছর হজ পালনে গিয়ে কমপক্ষে ৫৫০ জনবিস্তারিত পড়ুন
ঈদে ১ কোটি ৪ লাখ ৮ হাজার ৯১৮ টি গবাদিপশু কোরবানি
এ বছর পবিত্র ঈদুল আজহায় সারাদেশে মোট ১ কোটি ৪বিস্তারিত পড়ুন