এক নামে উন্নয়ন, অন্য নামে ভাগবাটোয়ারা
অমিতোষ পাল,, রাস্তা একটাই। কিন্তু নাম দেওয়া হয়েছে ভিন্ন। পৃথক দুটি নাম দিয়ে একই রাস্তার উন্নয়নের জন্য ঠিকাদারকে দেওয়া হয়েছে পৃথক দুই কার্যাদেশ। উদ্দেশ্য ছিল, একজন ঠিকাদারকে দিয়ে কাজ করাবে, আর অন্য ঠিকাদারের বিলের পুরো টাকা তুলে নিয়ে ঠিকাদার ও কর্মকর্তারা ভাগবাটোয়ারা করে নেবেন। এভাবে ৭ কোটি টাকা ভাগাভাগির সব কিছু চূড়ান্ত করেছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) একটি চক্র। হুট করে একজনকে বদলি করে দেওয়ার পরপরই বিষয়টি ধরা পড়ে যায়। নতুন দায়িত্ব নেওয়া কর্মকর্তা গিয়েই দেখতে পান তেলেসমাতি কাণ্ড। তখনই তছনছ হয়ে যায় চক্রটির নীলনকশা। এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসি মেয়র সাঈদ খোকন সমকালকে বলেন, প্রথমে একটি অভিযোগ আসে। তারপরই তিনি সেটা তদন্তের নির্দেশ দেন। পরে তদন্তে দেখা যায় ঘটনা সত্য, একই রাস্তার বিপরীতে দুটি কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ব্যয়ও ধরা হয়েছে অনেক বেশি। তবে দ্বিগুণ ব্যয় নির্ধারণের জন্য যেটা বলা হচ্ছে, সেটা হয়তো ঠিক না। কিছু ব্যয় যে বেশি ধরা হয়েছে এটা সত্য। এ জন্য দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।
লুটপাটের কৌশল :জানা গেছে, ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিভিন্ন এলাকার রাস্তা ও ফুটপাত আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেয় ডিএসসিসি। এ সময় অঞ্চল ৫ থেকে ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডের (ধূপখোলা এলাকা) তিনটি সড়কের উন্নয়নকাজের সবকিছু চূড়ান্ত করা হয়। এর মধ্যে ছিল ডিস্টিলারি রোডের ১০৭ নম্বর হোল্ডিং থেকে ২১/ঙ পর্যন্ত এবং ১২৬ নম্বর হোল্ডিং থেকে ১১৯/১৩ পর্যন্ত সড়কের রাস্তা, পাইপ ড্রেন ও ফুটপাত নির্মাণ। এ কাজ পায় নাওয়াল কনস্ট্রাকশন-এসসিইএল (জেভি) নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ব্যয় ধরা হয় ৩ কোটি ৯৮ লাখ ৯০ হাজার টাকা। এ সময় একই সঙ্গে ওই একই রাস্তার জন্য তৈরি করা হয় আরেকটি প্রকল্প। সেখানে যুক্ত করা হয় রাস্তার বিপরীত দিকের হোল্ডিং নম্বর। সেটিতে ডিস্টিলারি রোডের ১৫৭ নম্বর হোল্ডিং থেকে ৭৬ নম্বর পর্যন্ত এবং ২১ থেকে ১০২ নম্বর ধূপখোলা রোড পর্যন্ত নাম দেওয়া হয়। তবে কাজের প্রকৃতি এক ও অভিন্ন রাখা হয়। এ জন্য ব্যয় ধরা হয় ৪ কোটি ৯৮ লাখ ৭ হাজার টাকা। এই কাজের দায়িত্ব পায় মেসার্স ওপাল ইন্টারন্যাশনাল নামের আরেকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। একই রাস্তা হলেও হোল্ডিং নম্বর পরিবর্তন করে দুটি পৃথক কার্যাদেশ দেওয়া হয়। অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন ও ডিএসসিসির প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে অতীতেও এ রকম অভিযোগ এসেছে। কিন্তু কখনও হাতেনাতে ধরা পড়েনি। তবে একই রাস্তার ভিন্ন নাম দিয়ে প্রকৌশলীরা একজন ঠিকাদারকে দিয়ে উন্নয়ন কাজ করান। আরেকটি কাজের টাকা আত্মসাৎ করেন। এবার হাতেনাতে ধরা পড়ল দুই কিলোমিটার রাস্তার উন্নয়ন কাজের ক্ষেত্রে।
যেভাবে ধরা পড়ল :দুটি কাজের কার্যাদেশ দেওয়ার পরপরই আকস্মিকভাবে মেয়র সাঈদ খোকন ডিএসসিসির অর্ধশতাধিক প্রকৌশলী-কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আন্তঃবদলি করেন। এ সময় ৫ নম্বর অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী মুন্সি আবুল হোসেনকে বদলি করে ১ নম্বর অঞ্চলে পাঠানো হয়। ২ নম্বর অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী বোরহান আহমেদকে বদলি করা হয় ৫ নম্বর অঞ্চলে। বোরহান আহমেদ দায়িত্ব নিয়েই দেখতে পান লুটপাটের এই ষড়যন্ত্র। মুন্সি আবুল হাশেম আগেই কার্যাদেশ দিয়ে যাওয়ায় ঠিকাদাররা কাজ শুরু করার জন্য বোরহান আহমেদকে চাপাচাপি করতে থাকেন। ঠিকাদারদের তিনি কাজ করতে না দিয়ে বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানান। এক পর্যায়ে বিষয়টি মেয়র সাঈদ খোকনের কান পর্যন্ত গড়ায়। মেয়র ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামানকে বিষয়টি তদন্তের দায়িত্ব দেন। তদন্তে দেখা যায়, কেবল রাস্তার বিপরীতে একাধিক কার্যাদেশ দেওয়া ছাড়াও আধুনিকায়নের জন্য যে ব্যয় ধরা হয়েছে, তাও প্রায় দ্বিগুণ।
এক রাস্তার জন্য শুধু দুই প্রকল্প নয়, ব্যয়ও ধরা হয় দ্বিগুণ :রাস্তাটির ক্ষেত্রে কেবল ওভারল্যাপিংই (দুটি কার্যাদেশ) নয়, প্রকল্প ব্যয়ও ধরা হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ডিএসসিসির একাধিক প্রকৌশলী জানান, এ কাজের জন্য ৩ কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে। সেখানে একই কাজের বিপরীতে দুটি পৃথক প্রকল্প বানিয়ে ধরা হয়েছে প্রায় ৯ কোটি টাকা। এই একটি কাজ থেকেই চক্রটি অন্তত ৬ কোটি টাকা লুটে নেওয়ার ব্যবস্থা চূড়ান্ত করেছিল। এ ছাড়া আরেকটি প্রকল্পের ক্ষেত্রে ওভারল্যাপ করা না হলেও সেটার ক্ষেত্রেও প্রায় দ্বিগুণ ব্যয়ে কার্যাদেশ দেয় চক্রটি। সে রাস্তাটি হলো ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডেরই দীননাথ সেন বাইলেন কোকাকোলার গলির ১০১/৪ নম্বর হোল্ডিং থেকে ৯৫/১/৯৬ হয়ে ৯৪/৭ নম্বর হোল্ডিং পর্যন্ত। এ কাজের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯৫ লাখ ১৩ হাজার টাকা। কাজ পেয়েছিল মেসার্স মাইশা ট্রেডার্স নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ তিনটি প্রতিষ্ঠানেরই স্বত্বাধিকারীদের দু’জন যুবলীগের শীর্ষ ও মাঝারি পর্যায়ের নেতা। আরেকজন স্বেচ্ছাসেবক লীগের মাঝারি পর্যায়ের নেতা। ডিএসসিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, এই তিনটি কাজের মাধ্যমে ৭ কোটি টাকা লুটপাট হয়ে যেত।
অপকর্মের সঙ্গে যারা জড়িত :কোনো ঠিকাদারি কাজের প্রকল্প প্রণয়ন থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকেন প্রকৌশল বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী, সহকারী প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলী। এ তিনটি কাজের ক্ষেত্রে যুক্ত ছিলেন অঞ্চল-৫-এর সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মুন্সি আবুল হাশেম, সহকারী প্রকৌশলী (পুর) পারভেজ রানা, উপসহকারী প্রকৌশলী (পুর) আতিক উল্লাহ মৃধা ও উপসহকারী প্রকৌশলী (পুর) মো. ফরিদুজ্জামান। মুন্সি আবুল হাশেম বর্তমানে অঞ্চল-১-এ নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্বে আছেন। তদন্তে তাদের চারজনের বিরুদ্ধেই লুটপাটের ষড়যন্ত্রের প্রমাণ মিললে গত ১৬ অক্টোবর আতিক উল্যাহ মৃধা, পারভেজ রানা ও মো. ফরিদুজ্জামানকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়। একই সঙ্গে নির্বাহী প্রকৌশলী মুন্সি আবুল হাশেমের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির সচিব খান মোহাম্মদ রেজাউল করিম সমকালকে বলেন, তারা চারজনই কাজের এস্টিমেটের (প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ) সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। কিন্তু সহকারী ও উপসহকারী প্রকৌশলীরা যেহেতু মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন, এ জন্য তাদের সাময়িক বরখাস্ত ও বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে এবং নির্বাহী প্রকৌশলী যেহেতু মাঠে থাকেন না, এ জন্য তার বিরুদ্ধে কেবল বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য :এ প্রসঙ্গে নির্বাহী প্রকৌশলী মুন্সি আবুল হাশেম ঘটনার আংশিক সত্যতা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ধূপখোলা মাঠের উত্তর-পশ্চিম পাশে দুই-আড়াই কিলোমিটার রাস্তার ড্রেন, রাস্তা, ফুটপাত নির্মাণের কিছু অংশের কাজে ওভারল্যাপিং হয়েছিল। তবে সেটা সংশোধন করা যেত। ঠিকাদার তো কাজ করে ফেলেননি। বিলও তো দেওয়া হয়নি। এটা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে সহকারী প্রকৌশলী পারভেজ রানা বরাদ্দ বেশি করার কথা স্বীকার করেন। তবে তিনি বলেন, এটা হয়তো তাদের ভুল হয়েছে। কিন্তু সংশোধনেরও তো সুযোগ ছিল। কর্তৃপক্ষ বললে সংশোধন করে দেওয়া যেত।
এ প্রসঙ্গে অঞ্চল-৫-এর নির্বাহী প্রকৌশলী বোরহান আহমেদ কিছু বলতে রাজি হননি। এ ঘটনার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান ঘটনার সত্যতা স্বীকার করলেও বেশি কিছু বলতে রাজি হননি। তিনি জানান, তদন্তে যা পেয়েছেন, সেটাই তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে বেশি টাকার কাজ পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স ওপাল ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মো. জুয়েল প্রকৌশলীদের সঙ্গে যোগাসাজশের কথা অস্বীকার করেন। তিনি সমকালকে বলেন, সাধারণ ঠিকাদার হিসেবে দরপত্রে অংশ নিয়ে কাজ পান। কিন্তু কার্যাদেশ পাওয়ার পর কাজ করতে গেলে তাকে কাজ করতে দেওয়া হয়নি। কয়েকদিন আগে জানতে পারেন ওই কাজে ওভারল্যাপিং হয়েছে। অথচ ইতিমধ্যে এই কাজের পেছনে তার অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এসব খরচ কোথায় হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনি তো জানেন একটি ঠিকাদারি কাজের কার্যাদেশ পেতে গেলেও তো ২ শতাংশ অর্থ দিতে হয়। -লেটেস্টবিডিনিউজ.
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো
লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন
আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা
“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন
বাবা যখন ধর্ষক
যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন