সোমবার, নভেম্বর ২৫, ২০২৪

আমাদের কণ্ঠস্বর

প্রধান ম্যেনু

ন্যাশনাল ক্রাইম নিউজ পোর্টাল

কাশ্মির সঙ্কটের সমাধান কোন পথে?

ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্তি-পরবর্তী ভারতবর্ষের মুসলিম ও হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ সমন্বয়ে, সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ১৪ ও ১৫ আগস্ট যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারত নামক দু’টি পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তখন ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত ৬৫০টি দেশীয় রাজ্যকে পাকিস্তান অথবা ভারত এ দু’টি রাষ্ট্রের যেকোনো একটিতে যোগ দেয়ার অথবা স্বাধীনভাবে থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। সে সময় জম্মু ও কাশ্মির একটি দেশীয় রাজ্য ছিল। ভারতবর্ষ বিভাজনকালীন জম্মু ও কাশ্মিরের মহারাজা ছিলেন হরি সিং। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকেরা হরি সিংয়ের পিতামহ গোলাব সিংয়ের কাছে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু ও কাশ্মির ১৮৪৬ সালে বিক্রি করে দেয়। হরি সিং পাকিস্তান নাকি ভারতের অধীনে যোগ দেবেন, এ বিষয়ে মনস্থির করতে না পেরে স্বাধীন থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার অব্যবহিত পর মহারাজা হরি সিং কর্তৃক অযৌক্তিক করারোপের কারণে প্রজা অসন্তোষ দেখা দিলে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়। বিদ্রোহীরা মহারাজার অত্যাচার থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য পার্শ্ববর্তী পাকিস্তান রাষ্ট্রের পাঠান গোত্রপ্রধানদের সাহায্য প্রার্থনা করেন। পাঠান গোত্রপ্রধানদের সৈন্য বাহিনী মুসলিম প্রজাদের দ্বারা সমর্থনপুষ্ট হয়ে শ্রীনগর অবধি পৌঁছে গেলে হরি সিং ভারতের রাজধানী দিল্লিতে পলায়নপূর্বক রাষ্ট্রটির কাছে সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করেন। তৎকালীন ভারত সরকার ভারতে যোগ দেয়ার শর্তসাপেক্ষে সামরিক সাহায্য প্রদানে সম্মত হয় এবং এর ফলে মহারাজা হরি সিং ২৬ অক্টোবর ১৯৪৭ সালে কাশ্মিরের ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়া বিষয়ক দলিলে স্বাক্ষর করেন। তারপর ১৯৪৭-৪৮ সালে পাকিস্তান ও ভারতীয় সৈন্যদের মাঝে, কাশ্মিরের ভূখণ্ডে প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ভারত ১ জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে কাশ্মির বিবাদ প্রসঙ্গ জাতিসঙ্ঘে উত্থাপন করে। জাতিসঙ্ঘ ১৩ আগস্ট ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার তাদের সৈন্য অপসারণের জন্য প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং প্রস্তাবে উল্লেখ করে যে, তাদের সৈন্য অপসারণ-পরবর্তী ভারতও রাজ্যটি থেকে তাদের বেশির ভাগ সৈন্য প্রত্যাহার করবে। প্রস্তাবে সৈন্য অপসারণ-পরবর্তী গণভোটের কথা বলা হয়। সৈন্য অপসারণ কার্যকর না হওয়ায় গণভোট অনুষ্ঠান সম্ভব হয়নি। ইত্যবসরে ৩০ অক্টোবর ১৯৪৮ সালে ভারতের মদদে কাশ্মিরে শেখ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে একটি জরুরি সরকার গঠিত হয়। ১ জানুয়ারি ১৯৪৯ সালে যখন পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়, সে সময় রাজ্যটির ৩৭ শতাংশ পাকিস্তানের দখলে এবং অবশিষ্ট ৬৩ শতাংশ ভারতের দখলে ছিল। যুদ্ধবিরতি-পরবর্তী যে নিয়ন্ত্রণ রেখা টানা হয়, তা পরে দু’টি দেশের প্রকৃত সীমানা হিসেবে স্বীকৃত হয়, যা অদ্যাবধি অব্যাহত আছে।

১৯৫৭ সালে কাশ্মির আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং দেশটির সংবিধানের অনুচ্ছেদ নম্বর ৩৭০-এ অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি অকাশ্মিরি ভারতীয়দের তথায় ভূমি ক্রয়ের অধিকার দেয়া হয়নি। কাশ্মির সঙ্কটকে কেন্দ্র করে ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে পুনঃযুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং ওই মাসেই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয়া হয়। অতঃপর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মধ্যে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দে ১ জানুয়ারি ১৯৬৬ সালে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিটিতে বিরোধ নিরসনের কথা বলা হলেও শাস্ত্রীর মৃত্যু এবং ’৬৯ সালে আইয়ুব খানের ক্ষমতাচ্যুতি অচলাবস্থার জন্ম দেয়। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে তৃতীয় যুদ্ধ সংঘটনের ফলে পাকিস্তানের পূর্বাংশের প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ নামে অভ্যুদয় ঘটে। ১৯৭২ সালে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সিমলায় স্বাক্ষরিত চুক্তিতে তাসখন্দ চুক্তির ভিত্তিতে কাশ্মির সমস্যা সমাধানের বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করা হয়। পাকিস্তান ও ভারতের অন্যান্য অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে কাশ্মির সমস্যা সাময়িকভাবে চাপা থাকাকালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৭৭ সালে সামরিক শাসক জিয়াউল হক দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হন এবং পরে তার ফাঁসির দণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অভ্যন্তরীণ সমস্যা সামাল দিতে ব্যর্থ হয়ে ১৯৭৫ সালে দেশটিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। ভারতের বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক জরুরি অবস্থাকালীন ক্ষমতার অপপ্রয়োগে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জনপ্রিয়তায় বিপুল ধস নামে এবং ১৯৭৭ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তার দল কংগ্রেসের শোচনীয় পরাজয় ঘটে।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মদদে বিভিন্ন সময়ে কাশ্মিরে যেসব সরকার গঠিত হয়, এর বেশির ভাগের পেছনেই জনসমর্থন ছিল না। ভারতভুক্ত কাশ্মিরে জনসাধারণের মধ্যে ১৯৮০-পরবর্তীকালে ক্রম-অসন্তোষ পুঞ্জীভূত হতে থাকলে সেখানকার জনমানুষ স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার হতে থাকে। এ সময় নিয়ন্ত্রণ রেখা ভারত ও পাকিস্তানের বরাবর সৈন্যদের মধ্যে নিত্য গুলিবিনিময় একটি স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

কাশ্মিরের যে অংশটি পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত, এটি আজাদ কাশ্মির ও গিলগিটÑ বালতিস্থান সমন্বয়ে গঠিত। এ অঞ্চলটির আয়তন ৮৫ হাজার ৭৯৩ বর্গকিলোমিটার, যা জম্মু ও কাশ্মিরের মোট দুই লাখ ২২ হাজার ২৩৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ৩৭ শতাংশ। কাশ্মিরের অন্তর্ভুক্ত লাদাখ অঞ্চলকে চীন বরাবরই তিব্বতের অংশ হিসেবে দাবি করে আসছিল। ব্রিটিশরা ভারত বিভাজনের সময় এ অঞ্চলটি এবং ভারতের একেবারে পূর্বাঞ্চলের অরুণাচল প্রদেশকে ভারতভুক্ত দেখালেও চীন কখনো এ দু’টি অঞ্চলের ওপর ভারতের সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়নি। ১৯৬২ সালে ভারত ও চীনের মধ্যে যে সীমান্ত যুদ্ধ সংঘটিত হয়, তাতে চীন লাদাখ অঞ্চলের প্রায় ১৫ হাজার কিলোমিটার ভূমি নিজ দখলে নিয়ে এ অঞ্চলটিকে আকসাই চীন নামে অভিহিত করেছে। সে সময় অরুণাচল রাজ্যটিকেও চীন নিজ দখলে নিয়েছিল; কিন্তু চীন কর্তৃক একতরফা যুদ্ধবিরতিকালে চীন অরুণাচলের দখল ত্যাগ করলেও আকসাই চীন দখল অব্যাহত রেখেছে।

চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত ১৯৬৩ সালে সীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী, পাকিস্তান গিলগিট বালতিস্তানভুক্ত পাঁচ হাজার ১৮০ বর্গকিলোমিটার ভূমি চীনের বরাবরে এবং ভারতের সাথে কাশ্মির বিরোধের স্থায়ী সমাধান না হওয়া সাপেক্ষে ছেড়ে দেয়। পাকিস্তান কর্তৃক চীনের কাছে ছেড়ে দেয়া এ অঞ্চলটি বর্তমানে চীনের জিনজিয়াং উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের অংশ।

১৯৯৯ সালে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর কারগিল সীমান্তে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে অপর একটি সীমিত যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে উভয় দেশের সেনাবাহিনীর সদস্যসহ স্বাধীনতাকামী কাশ্মিরি অনেক মু্িক্তযোদ্ধা নিহত হন। যুদ্ধবিরতির পর উভয় দেশের সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর ফিরে যায়।

ভারত বিভাজনের সময় যে জম্মু ও কাশ্মির একটি অখণ্ড অঞ্চল ছিল, এ অঞ্চলটির তৎকালীন মহারাজার জনমানুষের স্বার্থের পরিপন্থী সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে আজ অঞ্চলটি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে এর ৪৩, ৩৭ ও ২০ শতাংশ যথাক্রমে ভারত, পাকিস্তান ও চীনের নিয়ন্ত্রণে। বর্তমানে তিনটি দেশের অন্তর্ভুক্ত, কাশ্মিরের জনমানুষের মধ্যে তিন ধরনের মতাবলম্বী রয়েছে। এর একটি বড় অংশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকতে চায়। এর চেয়ে অপেক্ষাকৃত একটি ছোট অংশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে থাকতে চায় আর ভারতের অংশ হিসেবে যারা থাকতে চায়, এ সংখ্যাটি ক্রমহ্রাসমান। চীনের দখলবহির্ভূত অঞ্চলের জনমানুষ যেমন চীনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়ে আগ্রহী নয়, অনুরূপ চীনের দখলকৃত অংশের জনমানুষও যে চীনের দখলে থাকতে চায়, সেটিও স্পষ্ট নয়।

আজাদ কাশ্মির, গিলগিট ও বালতিস্তানের অধিবাসীদের প্রায় শতভাগই মুসলিম। আজাদ কাশ্মিরের অধিবাসীরা গুরজার, জাঠ, পাহাড়ি রাজপুত, সুধান, আব্বাসি ও আওয়ান সম্প্রদায়ভুক্ত। অপর দিকে গিলগিট ও বালতিস্তানের অধিবাসীরা ইয়াসকুন, সিন, মোগল, ওয়াখি, গুরজার, বালটি, কাশ্মিরি সদাত ও হুনজা সম্প্রদায়ভুক্ত। উভয় অঞ্চল স্বশাসিত এবং উভয় অঞ্চলের কোনোটি থেকেই পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে সদস্য নির্বাচনের কোনো ব্যবস্থা নেই। অঞ্চল দু’টি পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে আসার পর থেকে পাকিস্তান সরকার উভয় অঞ্চলে বসবাসরত অধিবাসীদের আর্থসামাজিক, শিক্ষা ও জীবনের মান উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর ফলে উভয় অঞ্চলের মানুষের মধ্যে যেমন শিক্ষার প্রসার ঘটেছে, এর পাশাপাশি কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হয়েছে। উভয় অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে স্বাধীনভাবে থাকার চেয়ে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকার পক্ষবর্তীই অধিক। উভয় অঞ্চলের জনগণের পক্ষ থেকে একাধিকবার পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভুক্তির দাবি উঠলেও, এর দ্বারা ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের জনগণের স্বাধীনতার দাবি ক্ষুণœ হবে, সে বিবেচনায় পাকিস্তান অন্তর্ভুক্তির পক্ষে অগ্রসর হয়নি।

ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মির ভারতের একমাত্র রাজ্য, যেখানে মুসলিম জনগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মতো এ রাজ্যের মুসলিম জনগোষ্ঠী গরু জবাইয়ের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। এমনকি, সম্প্রতি রাজ্যটির বিধানসভার এক মুসলিম সদস্য কর্তৃক আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে গরুর গোশত দ্বারা আপ্যায়নের ব্যবস্থা থাকায়, তিনি বিধানসভার অধিবেশন কক্ষে সহকর্মী হিন্দু সদস্য দ্বারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন। ভারতবর্ষ বিভাজন-পরবর্তী পর্যায়ে রাজ্যটির মুসলিম জনগোষ্ঠী বিভিন্নভাবে অত্যাচার ও নিষ্পেষণের শিকার হওয়ার কারণে তারা ক্রমেই ভারতবিদ্বেষী হয়ে ওঠে এবং ১৯৮০-পরবর্তীকালে তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ কথাটি অনস্বীকার্য, ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে জাতিসঙ্ঘের গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী গণভোটের ব্যবস্থা করা হলে রাজ্যটির জনমানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই স্বাধীনতা অথবা পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভুক্তির সপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করবে।

বর্তমানে স্বাধীনতার দাবিতে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের অভ্যন্তরে যে চারটি সংগঠন অধিক সক্রিয়, এগুলো হলো লশ্কর-ই তৈয়েবা; হিজবুল মুজাহিদীন, হরকাতুল মুজাহিদীন এবং জম্মু ও কাশ্মির লিবারেশন ফ্রন্ট (জেকেএলএফ)। এ সংগঠনগুলোর সশস্ত্র সদস্য রয়েছে এবং তারা স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার। ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের অভ্যন্তরে ভারতের সেনাবাহিনীও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ছয় লক্ষাধিক সদস্য মোতায়েন রয়েছে। এদের দ্বারা প্রতিনিয়ত সেখানে বয়স ও নারী-পুরুষ নির্বিভেদে মুসলিম জনগোষ্ঠী অত্যাচার, হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। এদের হাতে রাজ্যটির কোনো না কোনো অঞ্চলে প্রতিদিনই এক বা একাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটছে।
কাশ্মিরকে কেন্দ্র করে ভারতের সাথে পাকিস্তানের ১৯৪৭ ও ১৯৬৫ সালে যে দু’টি যুদ্ধ এবং ১৯৯৯ সালে যে সীমিত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, এর কোনোটিই কোনো দেশের জন্য চূড়ান্ত বিজয় বয়ে আনেনি। বরং তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে বিবাদের অবসান ঘটে। বর্তমানে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে বৈরিতা, এর মূলে রয়েছে কাশ্মির সমস্যা। কাশ্মিরকে কেন্দ্র করে উভয় দেশের মধ্যে আধুনিক সমরাস্ত্র দ্বারা সজ্জিত হওয়ার তীব্র প্রতিযোগিতা বিরাজ করছে। এরই মধ্যে উভয় দেশ পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশে পরিণত হয়েছে। এ প্রতিযোগিতার কারণে উভয় দেশের প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং উভয় দেশের জনমানুষ যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে মুক্ত হতে পারছে না।

ভারতের মতো পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরেও দেশটির সেনাবাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে। ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ও সামরিক খাতে ব্যয়ের বহর বিশাল হওয়ার বড় একটি কারণ হলো কাশ্মির সমস্যা। এর শান্তিপূর্ণ সমাধান হলে উভয় দেশের সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যাসহ সামরিক ব্যয়ের ব্যাপক হ্রাস ঘটবে, যা প্রকারান্তরে দেশ দু’টির অর্থনৈতিক উন্নয়নে অশেষ অবদান রাখবে।

কাশ্মির সমস্যার কারণে পৃথিবীর বড় অস্ত্র প্রস্তুতকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য প্রভৃতির অস্ত্র ব্যবসা জমজমাট। কাশ্মির সমস্যাটি সমাধান হয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বৈরিতার অবসান হোক, তা এ রাষ্ট্রগুলোর কোনোটিই আন্তরিকভাবে চায় না।

ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মির থেকে উদ্ভূত সিন্ধু, ঝিলম, চেনাব, সাতলেজ, বিয়াস ও রাভি নামক ছয়টি নদী পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এ ছয়টি নদীর পানির হিস্যা নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে যে বিবাদ ছিল, তা বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ১৯৬০ সালে সমাধা হয় এবং এর ফলে উত্তরের তিনটি নদী সিন্ধু, ঝিলম ও চেনাবের পানির বৃহদংশ পাকিস্তান ভোগ করে আসছে। অপর দিকে দক্ষিণের তিনটি নদী সাত্লেজ, বিয়াস ও রাভির পানির বৃহদংশ ভারত ভোগ করছে। উভয় দেশের জনমানুষের মধ্যে যারা শান্তি, স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির সপক্ষে, তাদের প্রশ্নÑ পানির হিস্যার ব্যাপারে উভয় দেশ সমঝোতা অনুযায়ী চলতে পারলে অপর সব বিষয়ে সমঝোতা নয় কেন? তাদের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন- ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে বিভাজিত ভারতবর্ষের ব্যাপকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত প্রদেশ কোন যুক্তিতে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলো? আর অন্তর্ভুক্তিকে যদি মেনে নেয়া হয়, সে ক্ষেত্রে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের বিচ্ছেদে জাতিগত সত্তা যদি মূল কারণ হয়ে ভারতের প্রত্যক্ষ সমর্থনের কারণে বাস্তব রূপ পেয়ে থাকে, তাহলে জাতিগত অভিন্নসত্তার ভিত্তিতে জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবমতো গণভোট আয়োজনে কাশ্মিরের জনগণের নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণে বাধা কোথায়? উল্লেখ্য, কাশ্মিরের জনগণের ভাষা, সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাস প্রভৃতি ভারতের মূল ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

কাশ্মিরের সাথে পৃথিবীর পাঁচটি বৃহৎশক্তির একটি, চীনের সীমানা রয়েছে এবং এ সীমানা ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশব্যাপী বিস্তৃত। তা ছাড়া ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের উত্তর-পূর্ব দিকের একটি বড় অংশ এবং পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের উত্তর দিকের ক্ষুদ্র একটি অংশ চীনের নিয়ন্ত্রণাধীন। প্রথমোক্ত অংশটি চীন কর্তৃক ভারত থেকে যুদ্ধবিজয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত। শেষোক্ত অংশটি পাকিস্তান কর্তৃক চীনের বরাবরে সমঝোতার ভিত্তিতে সমর্পিত।

সাম্প্রতিক সময়ে চীন দেশটির জিনজিয়াং প্রদেশ থেকে পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মির অভিমুখী কারাকোরাম মহাসড়কটি প্রশস্তকরণ ও উন্নীতকরণ এবং বেলুচিস্তানের গোয়াদর গভীর সমুদ্রবন্দর অবধি এটির বিস্তৃতি, পাকিস্তানের রেল যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ও গোয়াদর অবধি সম্প্রসারণ এবং গোয়াদর গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে ৪৬ বিলিয়ন ডলারের অধিক অর্থ বিনিয়োগ চলমান রয়েছে। এ বিনিয়োগ যে, চীনের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের সফলতা বয়ে আনবে, সে বিষয়ে সবাই ওয়াকিবহাল। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মিরকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের বৈরিতায় পাকিস্তান ক্ষতিগ্রস্ত হলে, তা চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। সে বিবেচনায় যেকোনো বৈরিতায় চীনের অবস্থান যে পাকিস্তানের সপক্ষে হবে, এটি কারো না বোঝার কথা নয়। আর সে কারণে বর্তমানে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মিরকেন্দ্রিক যেকোনো যুদ্ধে প্রচলিত অস্ত্রের ব্যবহারে ভারতের জয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ। এ অবস্থায় যেকোনো দেশ পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করলে তা উভয় দেশের অখণ্ডতাকেই বিপন্ন করে এ অঞ্চলের জনমানুষের ব্যাপক হতাহত হওয়ার কারণ ঘটাবে। বিশ্ব এ ধরনের বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হোক, এটি এ অঞ্চলের কিছু উগ্র মানুষ ছাড়া কারো কাম্য নয়।

ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে যারা জনমানুষের অধিকার আদায়ে সোচ্চার, তারা সবাই স্বাধীনতাকামী। অথচ ভারত এদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করতে সদাতৎপর। ভারতের কাশ্মিরের এসব স্বাধীনতাকামীর সাথে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী এবং ১৯৭১ সালে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে ছিলেন, তাদের কোনো পার্থক্য নেই। কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামী মানুষের ওপর ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অত্যাচার ও নিষ্পেষণ এতই বর্বর ও নির্মম যে, তা বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছে। আর এ কারণে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর ভারতের কাশ্মিরের উরি সেনাঘাঁটিতে স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র চারজনের আকস্মিক হামলায় বিশজন ভারতীয় সেনা নিহতের ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলের কোনো বড় দেশ ভারতের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। ভারত কখনো দেখা গেছে ধর্মীয় জাতিসত্তার প্রবক্তা, আবার কখনো জাতিগত জাতিসত্তার প্রবক্তা। কাশ্মিরের ক্ষেত্রে উভয় অবস্থানের যেকোনোটির ভিত্তিতে জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে গণভোটের মাধ্যমে তিনটি দেশের নিয়ন্ত্রণাধীন, কাশ্মিরের জনগণের ভাগ্য নির্ধারণের সুযোগ দেয়া হলে তা কাশ্মির সঙ্কটের স্থায়ী সমাধানের ভিত হিসেবে কাজ করবে, এ বিশ্বাস এ উপমহাদেশের জনমানুষের মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক

এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ

খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো

লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন

আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা

“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন

বাবা যখন ধর্ষক

যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন

  • দুই বড় দেশ যখন প্রতিবেশী ও প্রতিযোগী
  • মৌসুমি নৌকা শোরুম
  • ভারতবিদ্বেষ কেন বেড়ে চলেছে?
  • জনগণের কাছে শেখ হাসিনাই জয়ী
  • ‘গুলিস্তান’ নেই, তবু আছে ৬৪ বছর ধরে
  • পদ্মা ব্রিজ দিয়ে কী হবে?
  • যুদ্ধাহতের ভাষ্য: ৭০– “এখন অমুক্তিযোদ্ধারাই শনাক্ত করছে মুক্তিযোদ্ধাদের”
  • আসুন, বড় হই
  • আসুন, পিঠের চামড়া না তুলে পিঠ চাপড়ে দিতে শিখি
  • বাড়িওয়ালা মওদুদ ও বাড়িছাড়া মওদুদ
  • ব্রিটেনের নতুন সরকার নিয়ে যে শঙ্কা!
  • আওয়ামী লীগ ছাড়া কি আসলে কোনো বিকল্প আছে?