কীভাবে রাসুল [সা.] ইতেকাফ করতেন?
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানে এতেকাফ পালন করতেন, একান্ত কিছু সময় যাপন করতেন আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্যে। রাসুলের এতেকাফকালীন সময় বিচার করলে এ ব্যাপারে তার আচরণ, সুন্নত ও অবস্থা স্পষ্টরূপে আমাদের নিকট প্রতিভাত হবে।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানে এতেকাফ পালন করতেন, একান্ত কিছু সময় যাপন করতেন আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্যে। রাসুলের এতেকাফকালীন সময় বিচার করলে এ ব্যাপারে তার আচরণ, সুন্নত ও অবস্থা স্পষ্টরূপে আমাদের নিকট প্রতিভাত হবে।
প্রতি বছর রাসুল মদিনায় এতেকাফ পালন করতেন। আয়েশা রা. বর্ণনা করেন: রাসুল প্রতি রমজানে এতেকাফ পালন করতেন। [বোখারি : ২০৪১।] রাসুল মাসের প্রতি দশে এতেকাফ করেছেন, অত:পর লাইলাতুল কদর শেষ দশ দিনে জেনে তাতে স্থির হয়েছেন। এ ব্যাপারে বিভিন্ন হাদিস রয়েছে—
রাসুল বলেন :—
إني اعتكفت العشر الأُوَل ألتمس هذه الليلة، ثم اعتكفت العشر الأوسط، ثم أُتيت فقيل لي: إنها في العشر الأواخر؛ فمن أحب منكم أن يعتكف فليعتكف؛ فاعتكف الناس معه.
আমি কদরের রাত্রির সন্ধানে প্রথম দশ দিন এতেকাফ করলাম। এরপর এতেকাফ করলাম মধ্যবর্তী দশদিনে। অত:পর ওহি প্রেরণ করে আমাকে জানান হল যে তা শেষ দশ দিনে। সুতরাং তোমাদের যে এতেকাফ পছন্দ করবে, সে যেন এতেকাফ করে। ফলে, মানুষ তার সাথে এতেকাফ যাপন করল। [মুসলিম : ১১৬৭।]
আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যু-পূর্ব পর্যন্ত রমজানের শেষ দশ দিনে এতেকাফ পালন করেছেন। [বোখারি : ২০২৬।]
এতেকাফকালীন রাসুল মসজিদে সকলের থেকে আলাদা করে একটি তাঁবু-সদৃশ টানিয়ে দেওয়ার আদেশ দিতেন। সকল হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাতে তিনি আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্য যাপন করতেন। অন্তরের যাবতীয় একাগ্রতা ও মনোযোগ, আল্লাহর জিকির, বিনয়-বিনম্রতার সাথে নিজেকে তার দরবারে সমর্পণ যেন হয় অন্তরের একমাত্র চিন্তা ও ধ্যান—এ উদ্দেশ্যেই রাসুল নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে একান্ত সময় যাপন করতেন।
আবু সাইদ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসুল এক তুর্কি তাঁবুতে এতেকাফে বসলেন, যার প্রবেশমুখে ছিল একটি চাটাইয়ের টুকরো। তিনি বলেন : রাসুল সে চাটাইটি হাতে ধরে একপাশে সরিয়ে রাখলেন এবং মুখমন্ডল বের করে মানুষের সাথে কথোপকথনে নিয়োজিত হলেন। [ইবনে মাজা : ১৭৭৫।]
নাফে বিন উমর হতে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দশ দিনে এতেকাফ করতেন। নাফে বলেন: আব্দুল্লাহ রা. মসজিদের যে অংশে রাসুল এতেকাফ করতেন, তা আমাকে দেখিয়েছেন। [মুসলিম : ১১৭১।]
ইবনে কায়্যিম বলেন : এসব আয়োজন এতেকাফের উদ্দেশ্য ও রুহ লাভের জন্য। মূর্খরা যেমন করে জনবহুলভাবে, জাঁকজমকের সাথে এতেকাফ করে, তা সিদ্ধ নয় কোনভাবে। [যাদুল মাআদ : ইবনে কায়্যিম, খন্ড : ২, পৃষ্ঠা : ৯০।]
বিশ তারিখের দিবসের সূর্যাস্তের পর একুশ তারিখের রাতের সূচনাতে রাসুল তার এতেকাফগাহে প্রবেশ করতেন, এবং তা হতে বের হতেন ঈদের চাঁদ দেখা যাওয়ার পর। মধ্যবর্তী এই সময়টি শেষ দশদিন, যাতে এতেকাফের বিধান দেয়া হয়েছে। আবু সাইদ খুদরি হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের মধ্যবর্তী দশ দিনে সম্মিলিতভাবে এতেকাফ পালন করতেন। বিশতম রাত্রি বিগত হয়ে একুশতম দিবস উদিত হলে তিনি গৃহে প্রত্যাবর্তন করতেন, এবং যারা তার সাথে এতেকাফ যাপন করত, তারাও ফিরে আসত, সম্মিলিতভাবে যাপিত রাত্রিগুলোর যে রাতে তিনি প্রত্যাবর্তন করতেন, একবার সে রাত্রি যাপন করলেন সকলকে নিয়ে, সকলের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন, তাদের নির্দেশ দিলেন আল্লাহ তাআলার আদেশ বিষয়ে। অত:পর বললেন : আমি ইতিপূর্বে এই দশে সম্মিলিতভাবে এতেকাফ পালন করতাম। এখন আমাকে জানানো হয়েছে যে, শেষ দশ রাত্রিতে সম্মিলিতভাবে যাপন করা কাম্য, সুতরাং যে আমার সাথে এতেকাফ করবে, সে যেন এতেকাফস্থলে অবস্থান করে। আমাকে এ (লাইলাতুল কদর) দেখানো হয়েছিল, অত:পর আমি তা বিস্মৃত হয়েছি। তোমরা তা শেষ দশ দিনে অনুসন্ধান কর, এবং অনুসন্ধান কর প্রতি বেজোড়ে। আমি দেখতে পেয়েছি যে, আমি পানি ও কাদায় সেজদা দিচ্ছি। একুশের রাতে আকাশ ঝেপে বৃষ্টি এল, এবং রাসুলের জায়নামাজে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি পড়ল। [বোখারি : ১৯১৪। ] হাদিসটি প্রমাণ করে, একুশের রাত্রি হতেই এতেকাফের সূচনা, এবং এতেকাফ দিবসগুলোর শেষ দিবসের সূর্যাস্তের পরই কেবল এতেকাফকারী আপন গৃহে প্রত্যাবর্তন করবে।
এস্থলে উল্লেখ্য যে, আয়েশা রা. কর্তৃক বর্ণিত এক হাদিসে আমরা দেখতে পাই, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজর বাদে এতেকাফস্থালে প্রবেশ করতেন। তার বর্ণিত হাদিসে এসেছে—
كان رسول الله صلي الله عليه و سلم إذا أراد أن يعتكف صلى الفجر ثم دخل معتكفه.
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এতেকাফের ইচ্ছা পোষণ করতেন, তখন ফজর আদায় করে এতেকাফগাহে প্রবেশ করতেন। [মুসলিম : ১১৭৩।]
—এতে উভয় বর্ণনার মাঝে সংঘর্ষ হবে না। কারণ, বোখারির ভিন্ন এক রেওয়ায়েতে একই হাদিস কিছু শাব্দিক তারতম্য সহ বর্ণিত হয়েছে, এবং তাতে আছে— دخل مكانه الذي اعتكف فيه অর্থাৎ, তিনি প্রবেশ করলেন এমন স্থানে যাতে তিনি ইতিপূর্বে এতেকাফ করেছেন। [বোখারি : ১৯৩৬।] পূর্বের রাতে—একুশের রাতে—এখানে এতেকাফ করে রাসুল কোন কারণে হয়ত বেরিয়েছিলেন, এবং ফজর বাদ তাতে আবার প্রবেশ করেছেন। ইবনে উসাইমিন বলেন : এ বর্ণনাটি প্রমাণ করে যে, রাসুল তাতে প্রবেশের পূর্বে অবস্থান করেছেন। কারণ, হাদিসে বর্ণিত اعتكف অতীতকালীন ক্রিয়া, যার মানে হল তিনি ইতিপূর্বে তাতে এতেকাফ করেছেন। এ জাতীয় ক্ষেত্রগুলোতে শব্দকে তার মৌলিক অর্থে রাখাই কাম্য।
উক্ত বর্ণনার আলোকে, এতেকাফে আগ্রহী ব্যক্তি বিশ তারিখ দিবসের সূর্যাস্তের পর এতেকাফের স্থানে প্রবেশ করবে এবং ত্রিশ পূর্ণ হওয়া কিংবা দুজন সাক্ষীর সাক্ষ্যের মাধ্যমে মাস শেষ হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর উক্ত এতেকাফগাহ হতে প্রস্থান করবে। এখানেই এতেকাফের কালের সমাপ্তি। এতেকাফের কাল রমজানেই সীমাবদ্ধ, অন্য কোন মাসে নয়।
তবে, সালফে সালিহীনের কেউ কেউ ঈদের জামাতে বের হওয়া অবধি মসজিদে অবস্থান করেছেন। [মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে উসাইমিন : খন্ড : ২০, পৃষ্ঠা : ১৮৪।]
এতেকাফরত অবস্থাতেও রাসুল পাক-পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার প্রতি গুরুত্বারোপ করতেন, যেমন বর্ণিত হয়েছে উরওয়ার হাদিসে। তিনি বলেন : আয়েশা রা. আমাকে বলেছেন—হায়েজা অবস্থায় তিনি রাসুলের কেশবিন্যাস করে দিতেন। রাসুল তখন মসজিদে অবস্থান করতেন, গৃহে অবস্থানরতা আয়েশার নিকট তিনি মস্তক এগিয়ে দিতেন, এবং তিনি হায়েজা অবস্থাতেই তার কেশ বিন্যাস করে দিতেন। [বোখারি : ২৯৬।]
ইবনে হাজার বলেন : হাদিসটি প্রমাণ করে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সুগন্ধি ব্যবহার, গোসল, ক্ষৌরকর্ম, কেশ বিন্যাস বৈধ। অধিকাংশ আলেমের মত এই যে, এতেকাফকালীন কেবল সেসব বিষয় মাকরূহ, যা মাকরূহ সচরাচর মসজিদে। [ফাতহুল বারি : খন্ড ৪, পৃষ্ঠা : ৩২০।]
এতেকাফকালীন রাসুল কোন অসুস্থ ব্যক্তির দর্শনে যেতেন না, অংশ নিতেন না কোন জানাজায়, বর্জন করতেন স্ত্রী সংস্পর্শ বা সহবাস। আয়েশা রা. বলেন : এতেকাফকারীর সুন্নত হচ্ছে অসুস্থের দর্শনে গমন না করা, জানাজায় অংশ না নেয়া, নারী সংসর্গ ও সহবাস বর্জন করা এবং অত্যবশ্যকীয় কোন প্রয়োজন ব্যতীত এতেকাফ হতে বের না হওয়া। [আবু দাউদ : ২৪৭৩।]
এতেকাফরত অবস্থায় রাসুলের স্ত্রী-গণ তার সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং কথোপকথন করতেন তার সাথে। সাফিয়া রা. বলেন : রাসুল এতেকাফরত অবস্থায় আমি তার সাথে সাক্ষাতের জন্য এলাম, তার সাথে আলাপ করে অত:পর চলে এলাম…। [বোখারি : ৩০৩৯।] অপর রেওয়ায়েতে আছে—একদা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে অবস্থানকালীন তার স্ত্রী-গণ তার পাশে ছিলেন, তারা ছিলেন আনন্দিত….। [বোখারি : ১৮৯৭।]
হাদিসগুলো প্রমাণ করে, এতেকাফরত অবস্থাতেও রাসুল স্ত্রী-গণের সংবাদ নিয়েছেন। এতেকাফের ফলে যে মূর্খরা তাদের পরিবার-পরিজনের কথা ভুলে যায়, তারা এ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। আমার বোধগম্য নয় যে, আল্লাহ তাআলার স্পষ্ট বর্ণনা সত্ত্বেও তারা কীভাবে এ আচরণ করতে দু:সাহস দেখায়। আল্লাহ বলেন :—
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ لاَ تَخُونُواْ اللّهَ وَالرَّسُولَ وَتَخُونُواْ أَمَانَاتِكُمْ وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ. [الأنفال: 27
হে মোমিনগণ ! জেনে শুনে আল্লাহ ও তার রাসুলের বিশ্বাস ভঙ্গ করবে না, তোমাদের পরস্পরের আমানতের খেয়ানতও করবে না। [সূরা আনফাল : আয়াত : ২৭।]
—এবং হাদিসে এসেছে—রাসুল বলেছেন :—
كفى بالمرء إثماً أن يضيع من يقوت.
মানুষের জন্য পাপ হিসেবে এতটুকুই যথেষ্ট যে, যার ভোরণ-পোষণ তার দায়িত্ব তাকে বিনষ্ট করে দেয়। [আহমদ : ৬৪৯৫।]
পরিবারের সাথে এ জাতীয় আচরণ, সন্দেহ নেই, হারাম। এর পাপ এতেকাফের সওয়াব অপেক্ষা বড়। কারণ, এর ফলে ওয়াজিবকে পরিত্যাগ করে মোস্তাহাবের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়। উমরা, এতেকাফ ও এ জাতীয় অন্যান্য আমলের ক্ষেত্রে একই হুকুম।
ওয়াজিব ছুঁড়ে ফেলে মোস্তাহাব আমল নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকার ফলে যখন এমন সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয়েছে, তখন সহজে অনুমেয় যে, পার্থিব ক্ষুদ্র উপার্জনের সন্ধানে যে ভুলে যায় পরিবার-পরিজনের কথা, আল্লাহ তাকে কী পরিমাণ শাস্তি দিবেন, পরকালে তার কী পরিণতি হবে।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যবশ্যকীয় কোন কারণ ব্যতীত এতেকাফগাহ হতে বের হতেন না। আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসুল এতেকাফরত অবস্থায় কোন কারণ ব্যতীত গৃহে প্রবেশ করতেন না। [বোখারি : ২০২৯।] সাফিয়া রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতেকাফরত অবস্থায় এক রাতে আমি তার সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে গমন করলাম। আমি তার সাথে আলোচনা সেরে উঠে চলে এলাম। আমাকে পৌঁছে দেয়ার জন্য তিনি এলেন। সাফিয়ার আবাস ছিল উসামা বিন যায়েদের বাড়িতে। [বোখারি : ৩২৮১।]
প্রবল কোন কারণ বশত: কখনো কখনো রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পবিত্র দেহের কিছু অংশ এতেকাফগাহ হতে বের করতেন। আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : এতেকাফরত অবস্থায় রাসুল মসজিদ হতে তার মস্তক বের করতেন, আর আমি হায়েজা অবস্থাতেই তা ধৌত করে দিতাম। [বোখারি : ১৮৯০।]
রাসুল একবার তার স্ত্রী-গণকে উত্তম পথ প্রদর্শন, মনোরঞ্জন ও আনন্দ প্রদানের জন্য রমজানের এতেকাফ ত্যাগ করেছেন—তবে, একই বছরের শাওয়াল মাসের প্রথম দশ দিনে উক্ত এতেকাফের কাজা আদায় করে নিয়েছেন।
উম্মুল মোমিনীন আয়েশা রা. বর্ণনা করেন : রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এতেকাফে মনস্থ হলেন, ফজরের সালাত আদায় করে এতেকাফগাহে প্রবেশ করলেন। রাসুল তাঁবু টানানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন, কারণ, তিনি রমজানের শেষ দশ দিন এতেকাফ করার মনস্থ করেছিলেন। জয়নবকেও নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, সেটিও টানানো হয়েছিল, তিনি ছাড়া অন্যান্যদেরকেও নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, ফলে তাদেরগুলো টানানো হয়েছিল। ফজরের সালাত শেষে রাসুল অনেকগুলো তাঁবু দেখতে পেলেন। তিনি বললেন : তোমরা কি এর মাধ্যমে পুণ্য অর্জনের ইচ্ছা করছ ? রাসুল অত:পর নির্দেশ দিলে তার তাঁবু গুটিয়ে নেয়া হল, এবং তিনি রমজানে এতেকাফ পরিত্যাগ করলেন এবং শাওয়ালের প্রথম দশদিন এতেকাফের কাজা আদায় করলেন। [ইবনে হিববান : ৩৬৬৩।]
রাসুল, এভাবে, দুটি ভাল কাজ একই সাথে সমাধা করেছেন—এক দিকে এতেকাফ পালন করেছেন, অপরদিকে স্ত্রী-গণের মানসিকতার প্রতি সহানুভূতিপ্রবণ দৃষ্টি রেখেছেন, তাদের শিক্ষা দিয়েছেন যে, অযাচিত কোন কারণ বশত: ইবাদত বন্দেগির মাঝে বিঘ্ন সৃষ্টি সর্বার্থে অনুচিত। [দ্র : আল্লামা আইনি, উমদাতুল ক্বারি : খন্ড : ১১, পৃষ্ঠা : ১৪৮।]
কোন কারণ বশত যদি এতেকাফ ছুটে যেত, তবে রাসুল পরবর্তীতে তা কাজা করে নিতেন—পূর্বের হাদিসে যেমন উল্লেখ হয়েছে যে, স্ত্রী-গণের হকের প্রতি লক্ষ্য রেখে তিনি এতেকাফ বর্জন করেছিলেন, পরবর্তীতে, শাওয়ালের প্রথম দশ দিনে তা কাজা করে নিয়েছেন। একবার সফরে থাকার কারণে এতেকাফ পালন সম্ভব না হলে রাসুল পরবর্তী বছরে বিশ দিন এতেকাফ করে তা কাজা করে নিয়েছিলেন। আনাস বিন মালেক হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দশদিনে এতেকাফ পালন করতেন। এক বছর তিনি এতেকাফ পালনে সক্ষম হলেন না, তাই, পরবর্তী বছরে তিনি বিশ দিন এতেকাফ করে নিয়েছিলেন। [তিরমিজি : ৮০৩, হাদিসটি সহি।]
উবাই বিন কাব হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসুল রমজানের শেষ দশ দিনে এতেকাফ পালন করতেন, একবার সফর জনিত কারণে তিনি এতেকাফ করলেন না, পরবর্তী বছরে, তাই, দশ দিন এতেকাফ করে নিলেন। [ইবনে হিববান : ৩৬৬৩। তার বর্ণিত সূত্র ইমাম মুসলিমের শর্ত অনুসারে।]
এতেকাফের কারণে রাসুল সফর বাদ দেননি, সফর সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রয়োজন ও কল্যাণ হতেও পিছপা হননি, এবং ভুলে যাননি এতেকাফের কথা, পরবর্তী বছরে তাই, তাৎক্ষণিক এতেকাফ সহ কাজা এতেকাফও আদায় করে নিয়েছিলেন। বর্তমান আলেম সমাজ, সংস্কারক ও দায়িদের আমরা দেখতে পাই যে, সাময়িক যৌক্তিক কোন কারণ বশত: হয়তো তারা নির্দিষ্ট কোন ইবাদত মওকুফ করতে বাধ্য হন, অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কর্মের সাথে সমন্বয় সাধন করে তা পালন করতে পারেন না বিধায় তাকে ত্যাগ করেন। কিন্তু, রাসুলের প্রদর্শিত হেদায়েত অনুসারে পরবর্তীতে তা পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন না।
এতেকাফ পরিত্যাগের প্রবণতা বর্তমানে খুবই ব্যাপক হারে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইমাম যুহরি বলেন : অবাক ব্যাপার ! মুসলমানগণ এতেকাফ পরিত্যাগ করছে হর-হামেশা, অথচ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় আগমন পরবর্তীতে মৃত্যু অবধি এতেকাফ পরিত্যাগ করেননি। [ইবনে হাজার : ফাতহুল বারি : খন্ড : ৪, পৃষ্ঠা : ৩৩৪।]
উম্মতের মহান দায়িত্ব সত্ত্বেও, রাসুলের এতেকাফ, মসজিদে স্থাপিত তাঁবুতে একাকিত্ব যাপন, মাওলার ইবাদত ও জিকিরে আত্মা ও মনন সমর্পণ ইঙ্গিত করে—যে কোন কালের দায়ি, সংস্কারক ও আলেম মাত্ররই কর্তব্য ও দায়িত্ব নিজের জন্য একাকী-নির্বিঘ্ন কিছু সময় নির্ধারণ করা, যাতে আত্মিক অনুসন্ধান ও নফ্সের মোহাসাবায় নিরত হবে।
এ ব্যাপারে উদাসীনতা, গাফিলতি ও ভ্রূক্ষেপ-হীনতা নফ্সের ক্লেদাক্ততা ও অসুস্থতা কেবল বৃদ্ধিই করে ; এক সময় বাসা বাধে মানুষের অনুভূতি ও চিন্তার গোপনতম এলাকায়, কুড়ে কুড়ে নষ্ট করে দেয় ঈমান ও বিশ্বাসের বিনির্মাণগুলো। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন। আল্লাহ পাকের সাহায্য-সহযোগিতা প্রার্থনা পরিত্যাগ লাঞ্ছনা ও ধ্বংসের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়, বান্দা সহজে হারিয়ে ফেলে নিজেকে পাপের অতল নিমজ্জনে। আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা, আকুতি জানান, ও নিজেকে তার দরবারে বিলীন করবার উত্তম পন্থা হল : আত্মার পরিমার্জন ও উন্নতিকল্পে একাকিত্ব যাপন—তার অপূর্ণতাগুলো ঢেকে দেয়া, হিম্মত ও প্রতিজ্ঞার সঞ্চার, আল্লাহ ও আখেরাতের পথে নিজেকে মহীয়ান করে গড়ে তোলা—সন্দেহ নেই, এ উদ্দেশ্য রূপায়ণে এতেকাফই হচ্ছে বান্দার জন্য সর্বোত্তম উপায়।
আধুনিকতা ও সংস্কৃতির ছায়ায় গড়ে উঠছে আমাদের যে নতুন প্রজন্ম, তাদের প্রতি ন্যুনতম লক্ষ করলেই দেখতে পাবেন—মহত্ত্ব ও কল্যাণের সর্ব-ব্যাপকতা সত্ত্বেও, তারা এ সুন্নতকে পরিত্যাগ করছেন অনায়াসে, তাই, আত্মার পরিমার্জন ও পরিচ্ছন্নতা অর্জন তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না কোনভাবে। যদিও কোন কোন শ্রেণির মাঝে এই সুন্নত বিস্তার লাভ করছে ধীরে ধীরে, কিন্তু এখনও তাদের ও তাদের কর্মের মাঝে রাসুলের প্রদর্শিত হেদায়েত বিরোধী কর্মকান্ডের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, কিংবা এতেকাফের উদ্দেশ্য ও আদব ক্ষুণ্ণ হয় নানাভাবে। নিম্নে তার কিছু উল্লেখ করা হল :—
এতেকাফের মৌলিক উদ্দেশ্য বিরোধী ও একাগ্রতা বিনষ্টকারী যে বিষয়টি সর্বপ্রথম লক্ষণীয়, তাহল, মোবাইল ব্যবহার। আল্লাহর তরে অন্তরের নিবিষ্টতা, পার্থিব যাবতীয় সম্পর্ক ও যোগাযোগ হতে কিছু সময়ের জন্য বিচ্ছিন্নতা, জিকির ও ধ্যানে অবগাহন—ইত্যাদি চূড়ান্তভাবে লঙ্ঘিত হয় মোবাইল ব্যবহারের ফলে। [ইবনে উসাইমিন তার রচিত মাজমুউ ফাতাওয়া-তে উল্লেখ করেন (খন্ড : ২০, পৃষ্ঠা : ১৫৮) এতেকাফকারী পার্থিব যাবতীয় বিষয় হতে নিজেকে মুক্ত রাখবে, সুতরাং, বেচা-কেনা ও ব্যবসায় নিজেকে জড়াবে না।]
তবে, মুসলমানদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় কোন কর্মে শর্তহীনভাবে কি মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ ? এ ব্যাপারে দ্বিমত রয়েছে। মূলত: যদি এতেকাফের শরয়ি উদ্দেশ্য ও বাস্তবতা ক্ষুণ্ণ না হয়, লঙ্ঘিত না হয় তার মৌলিক উদ্দেশ্য, তবে শর্তহীনভাবে মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হবে না। এ বিষয়ে আল্লামা ইবনে উসাইমিন বলেন : এতেকাফরত অবস্থায় মোবাইল যদি মসজিদে থাকে, তবে মুসলমানদের ধর্মীয় প্রয়োজনে মোবাইল ব্যবহার বৈধ। কারণ, এর ফলে তাকে মসজিদ থেকে বের হতে হচ্ছে না। তবে, যদি মসজিদের বাইরে হয়, তাহলে ব্যবহার করবে না। কেউ যদি মুসলমানদের প্রয়োজনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে, তবে সে এতেকাফ পালন করবে না। কারণ, মুসলমানদের প্রয়োজন পূরণ করা এতেকাফের তুলনায় গুরুত্বপূর্ণ। মুসলমানদের কল্যাণ সর্বব্যাপী ও প্রবৃদ্ধিশীল, এতেকাফের পরিসর সংক্ষিপ্ত। তবে সংক্ষিপ্ত ও প্রবৃদ্ধি-বিলগ্ন বিষয়ও যদি হয় ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব হুকুম, তবে তা পালন করাই হবে আবশ্যকীয়। [ইবনে উসাইমিন, মাজমুউ ফাতাওয়া : খন্ড : ২০, পৃষ্ঠা : ১৮০।]
কেউ কেউ পিতা-মাতার আদেশ উপেক্ষা করে এতেকাফ পালন করে। এতেকাফ সুন্নত, পিতা-মাতার আদেশ মান্য করা ওয়াজিব। সুন্নতের তুলনায় ওয়াজিব পালন অগ্রগামী—সন্দেহ নেই।
আল্লাহ তাআলা হাদিসে কুদসিতে ইরশাদ করেন :—
وما تقرب إليَّ بشيء أحب إليَّ مما افترضته عليه.
আমার আরোপিত ফরজই বান্দাকে আমার নিকটবর্তীকারী আমলের মাঝে সর্বাধিক প্রিয়। [বোখারি : ৬৫০৩।]
সুতরাং, ফরজ পালনই বান্দার জন্য অধিক যুক্তিযুক্ত ও অগ্রগণ্য। আল্লামা ইবনে উসাইমিন এ বিষয়ে যে বিস্তারিত বর্ণনা প্রদান করেছেন, এখানে তার উল্লেখ খুবই সময়োচিত বলে আমি মনে করি। তিনি বলেন :—তোমার পিতা যদি তোমাকে এতেকাফে বাধা প্রদান করে এবং এতেকাফ ত্যাগ করার মত যৌক্তিক কারণ উল্লেখ করে, তবে তুমি এতেকাফ পালন কর না। কারণ, হয়তো এ ব্যাপারে তিনি তোমার মুখাপেক্ষী। এতেকাফ ত্যাগ করার মত প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের মানদন্ডও তার কাছে, তোমার কাছে নয়। তুমি যে মানদন্ড মান্য কর, এতেকাফের প্রতি আসক্ত হওয়ার ফলে হয়তো তা সঠিক ও ন্যায্য নয়। তবে, পিতা যদি প্রয়োজনীয় বিষয়টির উল্লেখ করে কল্যাণের ব্যাখ্যা না করেন, তবে, এক্ষেত্রে তার আদেশ কায়মনোবাক্যে মান্য করা তোমার জন্য আবশ্যক নয়। কারণ, এমন বিষয়ে তাকে তোমার মান্য করার প্রয়োজন নেই, যা কল্যাণ শূন্য। [ইবনে উসাইমিন, মাজমুউ ফাতাওয়া : খন্ড : ২০, পৃষ্ঠা : ১৫৯।]
কেউ কেউ অসময়ে নিদ্রা, অনর্থক আলাপ-আলোচনা ও গল্প-গুজবে সময় নষ্ট করে, যা কোনভাবেই কাম্য নয়। এগুলো এড়িয়ে যাওয়া এতেকাফকারীর জন্য অবশ্য কর্তব্য।
হাদিসে দিবস ও রাতের যে সকল সময়-নির্দিষ্ট অনির্দিষ্ট সুন্নত উল্লেখ করা হয়েছে—যেমন : ফরজ সালাতের পূর্বে ও পরে পালিত সুন্নত, দ্বিপ্রহরের সুন্নত, ওজুর সুন্নত, জিকির-আজকার ও কোরআন পাঠ, এতেকাফকারীদের সাথে দ্বীনি আলোচনায় অংশগ্রহণ, সালাতে প্রথম কাতারের সংরক্ষণ, সালাত শেষে নির্দিষ্ট জিকির পাঠ—ইত্যাদির ক্ষেত্রে কেউ কেউ অনীহ আচরণ করে থাকে। এ ইবাদত ও জিকির-আজকারের মাধ্যমে এতেকাফকারীর সময়গুলো হিরণ্ময় হয়ে উঠে, বিশুদ্ধ হয় তার আত্মা, পূরণ হয় এতেকাফের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।
নিজ এলাকা ও দেশের বাইরে সফররত অবস্থায় যারা এতেকাফ পালন করেন,—যেমন হারামাইন—সফরের কারণ প্রদর্শন করে নফল সালাত ত্যাগ করেন, এ কোনভাবেই ঠিক নয়। কারণ, সফরে থাকা সত্ত্বেও রাসুল নফল সালাত হতে বিরত থাকতেন না। রাসুল বরং, জোহর, মাগরিব ও এশার সুন্নত ত্যাগ করতেন, অন্যান্য নফল ইবাদতগুলো যথাযথভাবেই পালন করতেন। [ইবনে উসাইমিন, মাজমুউ ফাতাওয়া : খন্ড : ২০, পৃষ্ঠা : ১৬৭।]
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
ঈদের ছুটির পর বুধবার থেকে নতুন অফিস সময়সূচি
পবিত্র ঈদুল আজহার পর সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিতবিস্তারিত পড়ুন
সৌদিতে হজে বিভিন্ন দেশের ৫৫০ হাজির মৃত্যু
সৌদি আরবে এ বছর হজ পালনে গিয়ে কমপক্ষে ৫৫০ জনবিস্তারিত পড়ুন
ঈদে ১ কোটি ৪ লাখ ৮ হাজার ৯১৮ টি গবাদিপশু কোরবানি
এ বছর পবিত্র ঈদুল আজহায় সারাদেশে মোট ১ কোটি ৪বিস্তারিত পড়ুন