গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অন্যতম বলি শহীদ নূর হোসেন
নূর হোসেন বাংলাদেশের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য আন্দোলনের স্মরণীয় একজন মানুষ। পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার ঝাটিবুনিয়া গ্রামে ১৯৬১ সালে এক দরিদ্র অটোরিকশাচালক মুজিবুর রহমান ও গৃহিণী মা মরিয়ম বিবির গর্ভে জন্ম নেন তিনি।
বাবা ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলে জীবিকার জন্য ঢাকায় ৭৯/১ বনগ্রাম রোডে চলে আসেন। তার পর তিনি সেখানে বনগ্রামের পাশেই রাধাসুন্দরী প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু অষ্টম শ্রেণি অবধি পড়াশোনা করার পর আর্থিক দৈন্যের কারণে আর লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেননি। তখনই তিনি তাঁর বাবার মতো মোটর ড্রাইভিং স্কুলে ড্রাইভিং শেখার জন্য ভর্তি হন। সেখান থেকে ড্রাইভিং শিখে তিনি ঢাকার জুরাইনে একটি কোম্পানির গাড়ি চালাতে থাকেন। সেইসঙ্গে রাজনীতির প্রতি তাঁর প্রবল ইচ্ছা থাকার কারণে তিনি তখন ঢাকা সিটির বনগ্রাম এলাকার আওয়ামী যুবলীগের প্রচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তখন থেকেই তাঁর মনের ভেতর এলাকার জন্য, দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য ব্যতিক্রমধর্মী কোনো কিছু একটা করার প্রবল ইচ্ছা।
১৯৮২ সাল থেকে দেশে স্বৈরাচারী এরশাদের সামরিক শাসন চলছে। ১৯৮৭ সাল। স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম চলছে। সেই আন্দোলন কখানো বেগবান হয়, আবার কখনো বা একটু স্তিমিত হয়। এভাবে চলতে চলতে ১৯৮৭ সালে এরশাদের শাসনবিরোধী আন্দোলন বেশ তুঙ্গে। তারই ধারাবহিকতায় ১০ নভেম্বর আওয়ামী লীগসহ সব প্রগতিশীল বিরোধী দলের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি ছিল সেদিন। অন্যান্য দিনের মতো ২৬ বছর বয়সী মোটর মেকানিক ও ড্রাইভার নূর হোসেনও সেদিন সেই অবরোধের সপক্ষের মিছিলে শামিল হওয়ার জন্য গুলিস্তানের দিকে আসতে থাকেন। তবে অন্যান্য দিনের চেয়ে তাঁর বিষয়টি একটু আলাদা ছিল এ জন্য যে তিনি সেদিন নিজেই মিছিলের শারীরিক পোস্টার কিংবা ব্যানার হয়ে যান। কারণ, তাঁর সামনের দিকে বুকে লিখেছিলেন ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ স্লোগান, আর পেছনের দিকে পিঠে লিখেছিলেন ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগানটি। এভাবে নিজেই যখন একটি জ্বলন্ত স্লোগানে পরিণত হয়ে সামনে এগোতে লাগছিলেন, তখন ওই মিছিলে পুলিশ অতর্কিতে হামলা চালায়।
সেখানেই বুকে-পিঠে স্লোগান লেখা নূর হোসেনের দেহঘড়ির পোস্টারটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। একই সঙ্গে আরো যে দুজন যুবলীগ নেতা মৃত্যুবরণ করলেন, তাঁরা হলেন নুরুল হুদা বুলবুল ও আমিনুল হুদা টিটু। যে সাংবাদিক সেদিনের নূর হোসেনের বুকে স্লোগান লেখা ছবিটি তুলেছিলেন, তিনি হলেন দীনু আলম এবং পেছনের দিককার ছবিটি তুলেছেন পাভেল রহমান। নূর হোসেন আজ দেশের গণতন্ত্র রক্ষায় কাজ করতে গিয়ে জীবন উৎসর্গ করে বিখ্যাত হয়েছেন। আর সে ছবিটি তুলে রাখার জন্য ফটোসাংবাদিক দীনু আলম ও পাভেল রহমানও বিখ্যাত হয়েছেন নিঃসন্দেহে। নূর হোসেনসহ তিনজনকে গুলি করে মারার জন্য তাঁদের স্মরণে এবং বিচারের দাবিতে পরে ১১ ও ১২ নভেম্বর-১৯৮৭ সারা দেশে অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়।
এভাবেই আন্দোলন-সংগ্রামে চলছিল স্বৈরাচারের (১৯৮২-১৯৯০) নয় বছর। এ সময়ে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অনেককে জীবন দিয়ে শহীদ হতে হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় এরশাদের স্বৈরশাসনের শুরুর দিকেই ১৯৮৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে এক প্রতিবাদ মিছিলের ওপর নির্মমভাবে ট্রাক চালিয়ে দিয়ে ঢাকার রাজপথে পিষে হত্যা করা হয় সেলিম ইব্রাহিম ও দেলোয়ার হোসেন নামের দুই ছাত্রলীগ নেতাকে। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর নূর হোসেন শহীদ হওয়ার পর ক্ষণে ক্ষণে আন্দোলন যখন বেগবান হতো, তখনই কোনো না কোনো দমন-নির্যাতন ও নিপীড়ন চালিয়ে তা নস্যাৎ করার চেষ্টা করা হতো। শেষের দিকে এসে আন্দোলনকে আরো বেগবান করার লক্ষ্যে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নেতৃত্বে সব প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন একত্রে মিলে সৃষ্টি করা হয় সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ছিল সাতদলীয় জোট, বিএনপির নেতৃত্বাধীন আটদলীয় জোট এবং ওয়ার্কার্স পার্টির নেতৃত্বধীন পাঁচদলীয় জোট।
সবাই মিলে তিন জোটের রূপরেখা প্রণয়ন করে শক্ত আন্দোলন গড়ে তোলা হলে ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মিছিল করার সময় তৎকালীন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) যুগ্ম মহাসচিব এবং বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডা. শামসুল আলম খান মিলন পুলিশের চালানো গুলিতে নিহত হন। অন্যদিকে তার পরদিন ২৮ নভেম্বর ময়মনসিংহ শহরের রামবাবু রোডে মিছিলরত অবস্থায় পুলিশের গুলিতে জীবন দেন ছাত্রনেতা মো. ফিরোজ আলম ও মো. জাহাঙ্গীর হোসেন। এসব আন্দোলনের ফলেই তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে বিশ্ব বেহায়াখ্যাত এরশাদ তাঁর ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন। এরপর এক সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। বিএনপি এ দিনটিকে আগে ‘ঐতিহাসিক ১০ নভেম্বর স্মরণ’ দিবস হিসেবে পালন করত। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সেটাকে ‘নূর হোসেন দিবস’ হিসেবে পালন করা শুরু করে।
একটি উল্লেখ করার মতো বিষয়, যেখানে জাতীয় পার্টিও দিনটিকে ‘গণতন্ত্র দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। আর জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে ক্ষমতার অংশীদার হলে এরশাদ নূর হোসেন হত্যার জন্য জাতির কাছে এবং নূর হোসেনের মা-বাবার কাছেও ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কাজেই দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে শহীদ নূর হোসেন একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। নিজে বেশি শিক্ষিত না হয়েও দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণ ভাবনায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন তিনি। তাই আজো তাঁকে নিয়ে ভাবে দেশ ও জাতি। সে জন্যই আওয়ামী লীগ যে জায়গাটিতে নূর হোসেন নিহত হয়েছিলেন, সেই জিপিওর পাশের জিরো পয়েন্টকে পরিবর্তন করে সেটাকে ‘শহীদ নূর হোসেন স্কয়ার’ প্রতিষ্ঠা করে।
প্রতিবছরের ১০ নভেম্বর নূর হোসেনকে স্মরণ করার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়ে থাকে। সেখানে সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন দিনটিকে স্মরণ করার অংশ হিসেবে পুষ্পস্তবক অর্পণসহ আলোচনা সভা, শোকর্যালি ইত্যাদির আয়োজন করা হয়ে থাকে। নূর হোসেনকে নিয়ে ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ নামে একটি বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। নিয়ামত ইমাম নামের এক ঔপন্যাসিক ‘দ্য ব্ল্যাক কোট’ উপন্যাসে তাঁর নামে একটি চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। ১৯৯১ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত ২৫ বছর ধরে দেশে যে গণতান্ত্রিক ধারার সূচনা হয়েছে, তা টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব সবার।
এ বিশেষ দিনটি সামনে নিয়ে তাই নূর হোসেনকে স্মরণ করার পাশাপাশি বর্তমানে চলমান গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে আগামী দিনে যেকোনো ধরনের অসাংবিধানিক শাসনব্যবস্থাকে ঘৃণা করতে হবে। তাহলেই নূর হোসেনসহ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সব শহীদের আত্মদান সার্থক হবে।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো
লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন
আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা
“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন
বাবা যখন ধর্ষক
যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন