চীনা রাষ্ট্রপ্রধানের সফর শেষের হিসাব-নিকাশ
এতদিন একক বৈশ্বিক পরাক্রমে পরিচালিত হচ্ছিল বিশ্ব। ‘দিনে দিনে বাড়িয়াছে দেনা সুধিতে হইবে ঋণ’। পাশ্চাত্য পিছিয়ে পড়ছে। আর এগিয়ে যাচ্ছে প্রাচ্য। সেদিনের ‘দরিদ্র ও দুর্বল’ মহাচীনের মহাপ্রতাপ এখন। বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক পরাশক্তি সে। আর জাপান তৃতীয় শক্তি। এশিয়ায় ‘রাইজিং টাইগার’দের সংখ্যাও অনেক। আর আঞ্চলিক পরাশক্তির প্রকাশ ঘটছে বিশ্বরাজনীতিতে। আঞ্চলিক শক্তিধরদের সমন্বয়ে ব্রিকস (BRICS) এখন তুঙ্গে। ব্রিকসের সদস্যবর্গ- ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চায়না এবং দক্ষিণ আফ্রিকা শীর্ষ সম্মেলনের মাধ্যমে ভারতের পর্যটন নগরী গোয়াতে পরামর্শক সভা শেষ করেছে। এতে রীতিমতো নেতৃত্ব দিয়েছে চীন।
অর্থনৈতিক শক্তির প্রতীক বাস্তবতায় গঠিত হয়েছে- Asian Infrastructure Investment Bank-AIIB। পশ্চিমা নেতৃত্বে বিশ্ব ব্যাংকে চ্যালেঞ্জ করছে নবগঠিত এই এশীয় ব্যাংক। অর্থবিত্ত বাড়লে নাকি চিত্তও বাড়ে। অর্থনৈতিক শক্তি অর্জনের পর এখন চীন সামরিক সাম্রাজ্যের সীমানা সম্প্রসারণ করতে প্রস্তুত। এরই মধ্যে পীত সাগরে চীন-মার্কিন সামরিক শক্তির মহড়া চলছে। সাংহাই থেকে সুদূর বন্দর সুদান পর্যন্ত দীর্ঘায়িত সামরিক জলপথ নিরাপদ করতে চায় চীন। পশ্চিমা সমরবিদরা এর নাম দিয়েছে ‘দি স্ট্রিং অব পার্লস’ (The String of pearls)।
মহাচীনের মহাপরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে আফ্রিকার অনেক দেশ। বিশেষত এর পূর্ব উপকূল। পাকিস্তানের গোয়াদরে নির্মিত হচ্ছে পাক-চীন সংযুক্ত সমুদ্রবন্দর। শ্রীলঙ্কায় চীনের অধিপত্য এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের সোনাদিয়ায় অথবা পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে চায় তারা। তাহলে হয়তো বঙ্গোপসাগরে তাদের প্রভুত্ব প্রসারিত হয়। এতে বাংলাদেশ সরকারেরও অমত নেই। কিন্তু বাদ সেধেছে ভারত। খোদ পরিকল্পনামন্ত্রী জানিয়েছেন এ কথা। এ নিয়ে সম্ভবত চীন-বাংলাদেশ মান-অভিমান চলছে। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরকালে বাংলাদেশ এ বিষয়গুলো উত্থাপন করুক- এ রকম আশা করেছিল চীনা দূতাবাস। কিন্তু তা হয়নি। সফর শেষে যৌথ ঘোষণায় বাংলাদেশ চীনের সম্পর্ক স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপে বা কৌশলগত অংশীদারত্বে পৌঁছেছে বলে বলা হয়। কৌশলগত অংশীদারত্বের যে ব্যাখ্যা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে রয়েছে তার অর্থ হলো- ‘A Strategy is a plan for dealing with every possible by the other player at every stage of the game’, কিন্তু চুক্তিটি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমরা দেখি ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন কার্যক্রম।
এখানে কৌশলগত সম্পর্ক, রাজনৈতিক তাগিদ এবং সামরিক সহযোগিতা-কোনোটিই উল্লেখিত হয়নি। কেউ যদি এটা বোঝাতে চান যে এসব বিষয়ে হয়তো অকথিত বা অপ্রকাশ্য সমঝোতা রয়েছে, তাহলে প্রশ্ন উত্থাপন করা যায় যে ভারত-বাংলাদেশ উষ্ণ সম্পর্কের কী হবে? আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রতিটি পর্যবেক্ষক জানেন যে, ভারতের বিপক্ষে চীন রয়েছে এবং চীনের বিরুদ্ধে ভারত রয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্ব এলাকা যা পূর্বে নেফা বা নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ার এজেন্সি বলে পরিচিত ছিল, যার নাম এখন হিমাচল প্রদেশ- সেখানে স্পর্শকাতর সীমান্ত সমস্যা রয়েছে। এ নিয়ে দেশ দুটি ১৯৬২ সালে বড় ধরনের যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এটা সত্য কথা যে এতদসত্ত্বেও চীন-ভারত ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। ভারতের মতো বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক সমতাভিত্তিক নয়। এখানে চীন দাতা আর বাংলাদেশ গ্রহীতা। তাই বাংলাদেশের সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারত্ব না হয়ে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সম্পর্কে সীমিত রয়েছে।
চীন বাংলাদেশে ব্যাপক অর্থায়ন করছে। স্বাক্ষরিত এবং প্রক্রিয়াগত প্রকল্পের সংখ্যা ৩৪টি। সব মিলিয়ে বিনিয়োগের পরিমাণ ২৪.৪৫ বিলিয়ন ডলার। বর্তমান সফরকালে দুই সরকারের মাঝে ২৭টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ১৩টির ক্ষেত্রে চীন বাংলাদেশ যৌথ প্রকল্প চুক্তি অনুমোদিত হয়েছে। এই ১৩টি প্রকল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৩.৬ বিলিয়ন ডলার। আরো ৩৪টি প্রকল্পে কোনো না কোনোভাবে চীন অর্থনৈতিক সহযোগিতা দেবে। আরো রয়েছে দুটি ঋণচুক্তি। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ পাবে ৪৬৪ মিলিয়ন ডলার ঋণসুবিধা। এসব বড় বড় অর্থায়ন প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে- পদ্মা সেতুতে রেললাইন সংযোজনের জন্য ৩.৩ বিলিয়ন, মেরিন ড্রাইভ এক্সপ্রেসওয়ের জন্য ২.৮৬ বিলিয়ন, এনার্জি সেক্টরের জন্য ২.৪৬ বিলিয়ন, পায়রা সমুদ্রবন্দর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১.৯ বিলিয়ন ডলার, ঢাকা-সিলেট চার লেন হাইওয়ের জন্য ১.৬ বিলিয়ন, ঢাকা-আশুলিয়া নৌপথের জন্য ১.৩৯ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে, কর্ণফুলী টানেলের জন্য ৭০৩ মিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত সাহায্য। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, বড় ধরনের অর্থযজ্ঞ।
এই বিশাল বরাদ্দের অর্থের ছাড়করণ, উন্নয়ন কার্যক্রম ত্বরান্বিতকরণ, যথার্থ পরিদর্শন এবং সততা-স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রকল্প সমাপ্তকরণ- এক বিরাট ধরনের দায়িত্ব। তাই সঙ্গতভাবেই এই বিপুল অঙ্কের প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। বিভিন্ন প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের সক্ষমতা নিয়েও নানা ধরনের কথা রয়েছে। এমনিতেই বাংলাদেশে প্রকল্প বাস্তবায়নের সুনাম নেই। দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন লোকের যেমন অভাব, ঠিক তেমনি দীর্ঘসূত্রতা, দুর্নীতি এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার প্রমাণ রয়েছে। বাংলাদেশের জন্য প্রকল্পগুলো নিঃসন্দেহে সুদূরপ্রসারী উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিবহ, অবশ্য যদি চীনের সঙ্গে আমাদের প্রতিশ্রুতির ধারাবাহিকতা, সময়মতো টাকা ছাড়করণের সুরাহা হয়। এর আগে টাকা ছাড়করণের জটিলতায় ১৭৬টি প্রকল্পে অর্থ সাহায্য অসমাপ্ত কিংবা মাঝপথে বন্ধ হয়ে যাওয়ার নজির রয়েছে। গত ২০১৪ সাল থেকে চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত প্রকল্পগুলোর চুক্তির বাস্তবায়ন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঝুলে আছে। আবার অর্থায়নের দীর্ঘ অপেক্ষার পর চীনের সাড়া না পাওয়ায় ৪৩টি প্রকল্প তাদের ঋণের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এ ধরনের জটিলতা পরিহার করার জন্য শুধু চুক্তির মধ্যে আটকে না থেকে দ্রুত চীনের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নের জন্য আমাদের কাজ করে যেতে হবে। কার্যত দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচনের পথে এক ঐতিহাসিক নবযাত্রার সূচনা হয়েছে। বাংলাদেশ সকল প্রতিকূলতা অতিক্রম করে সাফল্য লাভ করবে বলে সবাই আশাবাদী।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো
লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন
আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা
“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন
বাবা যখন ধর্ষক
যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন