জনপ্রতিনিধি হলেই কী যা ইচ্ছে তাই করবেন
এটি সত্য যে ফেসবুকের যুগ না হলে সমাজে সংঘটিত অনেক ইতরামি-ফাজলামিই অপ্রকাশিত থেকে যেত। কেউ কিছু জানতেও পারতো না, বলতেও পারতো না। অনেক অপকর্মই দ্রুত আড়ালে-আবডালে চলে যেতে। ফেসবুকের কল্যাণেই দেশের জনগণ সম্প্রতি দু’জন নতুন মানুষকে দেখতে পেয়েছেন। এ দুজনের একজন হলেন নূর হোসেন পাটোয়ারী।
তবে তিনি শুধু মানুষ নন, একজন উপজেলা চেয়ারম্যান এবং চাঁদপুর জেলার হাইমচর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। অন্যজন হলেন জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলার দিলদার হোসেন। দুজনেই সমস্ত শিষ্টাচার ভঙ্গ করে শিশু শিক্ষার্থীদের চরমভাবে অপমান করার গৌরবজনক অধ্যায় রচনা করেছেন।
গত সোমবার চাঁদপুর জেলার হাইমচর উপজেলার উপজেলা চেয়ারম্যান উপজেলার নীলকমল ওসমানিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানে স্কুলের নবম ও দশম শ্রেণীর ছাত্ররা মিলে একটি মানবসেতু তৈরি করেছিল। সেই সেতুর উপর দিয়ে তিনি হাসতে হাসতে বিগলিত হয়ে হেঁটে যান। তার পায়ে নিচে পড়ে থাকে স্কুলের শিশুরা। তিনি বুঝে বা না বুঝে বা অজ্ঞানে-স্বজ্ঞানে যেভাবেই এই কাজটি করুন না কেন-শিক্ষার্থীদের তৈরি মানবসেতুর উপর দিয়ে তার হেঁটে যাওয়ার ছবিটি ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকের মাধ্যমে। জানাজানি হয়ে যায় সর্বত্র।
ফেসবুকে বিষয়টি নিযে সমালোচনার ঝড় উঠে। সেই ঝড় এখনও চলমান। ইতিমধ্যে স্কুলের এক অভিভাবকের পক্ষ থেকে উপজেলা চেয়ারম্যানসহ ৫ জনকে আসামী করে মামলা করা হয়েছে। হয়ত এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও উপজেলা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আশু কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু যে ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হোক, উপজেলা চেয়ারম্যান যে একটা দৃষ্টিকটু, রীতিনীতিহীন উদাহরণ তৈরি করেছেন এতে সন্দেহ নেই।
হয়ত তিনি বলবেন বা বলেছেনও যে না বুঝেই করেছেন এটি ছিল প্রতীকি, কাউকে বাধ্য করে করেননি বা তেমন কোনো খায়েশও দেখাননি। উল্টো এও বলতে পারেন যারা আয়োজক সেই স্কুল কর্তৃপক্ষের অনুরোধেই তিনি করেছেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষকও নাকি বলেছেন না এটি তেমন কিছু নয়। এটি সাদামাটা ঘটনা মাত্র।
এদিকে জামালপুরের মেলান্দহের মাহমুদপুর বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে একই ঘটনা ঘটিয়েছে জমিদাতা দিলদার হোসেন। দৈনিক কালের কণ্ঠ লিখেছে, গত রবিবার (২৯ জানুয়ারি) মাহমুদপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুল লতিফ এবং এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায়ী অনুষ্ঠান ছিলো। অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিদ্যালয়ের স্কাউট দলের সদস্যরা একটি মানবসেতু নির্মাণ করে। সেই মানবসেতুর ওপর দিয়ে হেঁটে যান অনুষ্ঠানের অতিথি এবং বিদ্যালয়ের জমিদাতা দিলদার হুসেন প্রিন্স।
এসময় সেই দৃশ্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করার পাশাপাশি তাকে হেঁটে যেতে সাহায্য করেন ওই বিদ্যালয়ের শরীরচর্চা শিক্ষক হাফিজুর রহমান। বিদ্যালয়ের স্কাউট সদস্যদের নির্মিত মানবসেতুর উপর দিয়ে কোনো শিক্ষার্থীর পরিবর্তে দিলদার হুসেন প্রিন্সের হেঁটে যাওয়ার ঘটনাটি স্থানীয়দের মাঝে ব্যাপক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং ছবিটি সেই দিন থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
ছবিতে দেখা যায়, শিশুদের কাঁধে চড়ে হাঁটছেন দিলদার হোসেন প্রিন্স। দুই পাশ থেকে দু’জন তার হাত ধরে সহযোগিতা করছেন। কেউ কেউ সেই দৃশ্যের ছবি তুলছেন। এর চার দিকে বিদ্যালয়ের ছাত্র ও অন্যান্য দর্শনার্থীরা দৃশ্যটি দেখছেন।
এই শিষ্টাচারহীনতা কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো বিষয় কী? অনেকেই শিক্ষকদের দোষ দিচ্ছেন। স্কুল কর্তৃপক্ষকে গালিগালাজ করছেন। অবশ্যই তাদের দায়দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু বিষয়টি দেখতে হবে ভিন্ন জায়গা থেকে। প্রথমত যে ঘটনা ঘটেছে এটি হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চরম ব্যক্তিকরণের ফলাফল। এখানে দলীয়করণ বলব না এই কারণে দেশের বিভিন্ন জাযগাতেই দলীয়করণের বদলে এখন ব্যক্তিকরণ হয়েছে।
বিশেষ ব্যক্তিরাই হর্তাকর্তা, অভিভাবক। তাদের হাতের আঙুলের ইশারাতেই সব চলে। তারা যা বলবে তাই হবে। আর এ কারণেই দেশের প্রায় প্রতিটি উপজেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে ম্যানেজমেন্ট কমিটি চলমান তারা সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির তাবেদার ছাড়া কিছুই নয়। সেই তাবেদারদের কথা মতোই স্কুলের প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে সবার চলতে হয়। আর তাই স্কুলে কোনো অনুষ্ঠানে সেই ব্যক্তিরাই নির্ধারণ করেন কাকে আনতে হবে, কাকে সামনের চেয়ারে বসাতে হবে-ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে দুটি ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে আমাদের মননশীলতার র্যাংকিং এখন কতোটা নিচে।
জনপ্রতিনিধি সাহের যে অপকর্মটি করেছেন সেটিও বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। দলীয় জনপ্রতিনিধিরাই এখন স্কুল-মাদ্রাসা-কলেজের (দু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া) সবকিছু। তারা যা বলবেন তাই হবে। তারা স্কুল বা কলেজে গেলে শিক্ষকদের সব কাজ ফেলে তাদেরকে কূর্ণিশ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ফেলে তাদের ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে বরণ করে নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের রোদের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। এরপর আবার প্রধান অতিথি এবং তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের ভালো খাওয়াতে হবে, পরাতে হবে। বাজার থেকে বড় বড় আপেল, কমলালেবু আনতে হবে। সামনে টিস্যু বক্স দিতে হবে।
সব জায়গাতেই এখন এসব চলছে। আর জনপ্রতিনিধিরা স্কুল কলেজে গেলে কখনই একা যান না। সাথে দলবল নিয়ে যান। মটর সাইকেলবাহিনীও থাকে। ফলে এদের আদর আপ্যায়ন করতে গিয়ে হাজার হাজার টাকা খরচ হয়ে যায় স্কুল কর্তৃপক্ষের। পেরেসানও কম হতে হয় না। আর যুগের চাহিদার কারণে চামচামিতো করতেই হয়।
সবখানেই এখন এই অবস্থা চলমান। দেশের বেশিরভাগ স্কুল-কলেজের বার্ষিক খেলাধুলো বা সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্থানীয় কোনো সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বা ক্রীড়াবিদদের ডাকা হয় না। তাদের কোনো দাম নেই। এসব ঘটনা স্পষ্টতই প্রমাণ করছে যা ঘটছে এসবই হলো ব্যক্তিকরণের ফলাফল। দলীয়করণের চেয়েও শতগুন ভয়াবহ ব্যক্তিকরণ। চাঁদপুর আর জামালপুরের ঘটনাকে তাই বিচ্ছিন্ন করে দেখার অবকাশ নেই।
সমাজে জবাবদিহিতার জায়গা সংকুচিত হয়ে এলে আর সবকিছু ব্যক্তিকেন্দ্রিক হলে এমন হতেই থাকবে। এ দুটি ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কী চর্চা হচ্ছে।
বেসরকারি স্কুল-মাদ্রাসার বার্ষিক খেলাধুলো বা সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানে চেয়ারম্যান, মেম্বারদের থাকতে হবে কেন? এ ধরনের অনুষ্ঠানে সবার আগে রাখা প্রয়োজন মর্যাদাবান স্থানীয় শিক্ষক, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদেরই।
যাদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা সত্যিকার অর্থেই কিছু জানতে পারবে, শিখতে পারবে এবং অনুপ্রাণিত হতে পারবে। দুটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের যেভাবে অপমান করা হয়েছে অবশ্যই তার সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার হওয়া প্রয়োজন। শিশু শিক্ষার্থীদের সাথে যে আচারণ করা হয়েছে তা অবশ্যই নিপীড়ন। কোনো জনপ্রতিনিধিরই যা ইচ্ছে তাই করার সুযোগ নেই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো
লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন
আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা
“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন
বাবা যখন ধর্ষক
যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন