দুঃখিত তাসকিন, রাজনীতিমুক্ত হোক ক্রিকেট
শনিবার (১৯.৩.২০১৬) বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। কলকাতার আকাশে তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। শনিবার রাতেই ইডেন গার্ডেনে পাক-ভারত মহারণ। ওপার বাংলার কলকাতায় বৃষ্টি হলেও এ পার বাংলায় যেন ঝড় বয়ে গেল। বাংলাদেশ ক্রিকেটকে বড় ধাক্কা দিল আইসিসি। এই বিষণ্ণ বিকেলেই স্পিনার আরাফাত সানীর পর পেসার তাসকিন আহমেদের বোলিং অ্যাকশনকে অবৈধ ঘোষণা করে আইসিসি।
সানী-তাসকিনকে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধের খবর দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর ভেঙে পড়ে পুরো বাংলাদেশ, ক্রিকেটপ্রেমীরা। হায়! হায়! তাসকিনও নি…। এ যেন বাড়ন্ত গাছকে ধাক্কা দিয়ে উপড়ে ফেলার মতো। যারাই ক্রিকেটে একটু মাথাচাড়া দিতে শুরু করে তাদেরকেই হঠাও। উঠতে দেওয়া যাবে না। কারণ আমরা মোড়ল। আমরাই শাসন করব ক্রিকেট। বাহ! কী বাহাদুরি।
২.
ঘটনার সূত্রপাত গত ওয়ানডে বিশ্বকাপে। মেলবোর্নে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশকে হারানোর এবং ভারতকে জেতানোর জন্য এমন কিছু নেই যা করা হয়নি। মাঠে এবং মাঠের বাইরে একযোগে কাজ করা হয়েছে। ভারতের সুবিধামতো ভেন্যু পরিবর্তন করা হয়েছে। মাঠের আম্পায়ারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যরাও অমার্জনীয় ও নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করেন। যেকোনো উপায়ে বাংলাদেশকে হারানেই ছিল মিশন এবং তা কার্যকর করা হয়। ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট ও আইসিসি পারস্পরিক যোগসাজশেই যে এই মিশন কার্যকর ও সফল করে, বিশ্ববাসীর তা অজানা নেই। সেই ম্যাচে আম্পায়ারদের অন্তত তিনটি সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের বিপক্ষে গিয়েছিল। এমনিতে ক্রিকেটে বাজে আম্পায়ারিংয়ের অনেক উদাহরণ আছে। সেই ম্যাচটিও তার একটি হতে পারে। কিন্তু সাধারণ দর্শকরা সেটিকে টুর্নামেন্টে ভারতকে টিকিয়ে রাখতে আইসিসির কৌশল হিসেবে বিবেচনা করে।
সে সময় আম্পায়ারিং নিয়ে প্রকাশ্যে প্রশ্ন তোলেন আইসিসির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ‘অপরাধে’ ফাইনালে তার ট্রফি তুলে দেওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত আইসিসির চেয়ারম্যান ভারতীয় এন শ্রীনিবাসনের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন বিষেদগার করেই চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন আ হ ম মুস্তফা কামাল।
৩.
এখানেই শেষ নয়। বিশ্বকাপের সময় ভারতের টিভিতে বাংলাদেশকে নিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার হয়েছিল ‘মওকা, মওকা’। আলিম দার আর ইয়ান গোল্ডের সৌজন্যে সে মওকা তারা পেয়েছিল। আরেকবার বিজ্ঞাপনে বাংলাদেশকে বাচ্চা হিসেবে দেখানো হয়। তবে ভারত ঢাকায় বাংলাদেশের কাছে হারার পর মাঠে যখন দর্শকরা মওকা মওকা বলে চিৎকার করছিল, তখন ভারতীয় অধিনায়ক ধোনি বলেন, এটা তো বিজ্ঞাপন, আমি না।
ঘটনা এখানেই শেষ নয়, সে সময় সুধীর গৌতমের ঘটনা নিয়েও ভারতীয় মিডিয়া ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করে। অথচ সুধীর গৌতম নিজেই বলেছেন, তাকে হেনস্থা করা হয়নি। বাংলাদেশের কয়েকটি টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সুধীর নিজেই। তাহলে কেন ভারতীয় মিডিয়ায় এ অপপ্রচার?
৪.
এবার আসা যাক সানী-তাসকিন প্রসঙ্গে। এবার এশিয়া কাপে বাংলাদেশ যখনই ভালো খেলা শুরু করল, তখনই চোখ পড়ে বিশ্ববাসীর। টাইগারদের পারফরম্যান্সে বিশ্বের তারকা ক্রিকেটাররা বাংলাদেশকে বাহবা দিতে শুরু করে। ওয়ানডের পর এবার ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ টি-২০ তেও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু সমস্যা এখানেই। বিশ্ব ক্রিকেটের তিন মোড়ল ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড যেন চায় না ক্রিকেটে কেউ তাদেরকে টপকে যাক। যখনই কোনো দল কিংবা ক্রিকেটার ভালো খেলতে শুরু করে, তখনই তাদেরকে রুখে দেওয়ার ষড়যন্ত্র শুরু হয়।
কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা আরো স্পষ্ট হবে। নিয়মবহির্ভূত বোলিং অ্যাকশনের দায়ে বাংলাদেশের তরুণ অফস্পিনার সোহাগ গাজীকে নিষিদ্ধ করে আইসিসি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের সময় সোহাগের বোলিং অ্যাকশন নিয়ে আইসিসির কাছে রিপোর্ট করেন ম্যাচ পরিচালনাকারীরা। পরে বোলিং শুদ্ধির পরীক্ষা দিয়ে আবারও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরে আসেন সোহাগ। মনে পড়ে, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে একই টেস্টে হ্যাট্রিক ও সেঞ্চুরি করে ইতিহাস গড়েন সোহাগ গাজী। যে রেকর্ড এর আগে কোনো খেলোয়াড়ের ছিল না। বাংলাদেশের হয়ে ১০টি টেস্ট, ২০টি ওয়ানডে ও ৯টি টি২০ খেলা সোহাগ মোট উইকেট সংগ্রহ করেছেন ৬২টি।
এর আগে সাইদ আজমল ও সচিত্রা সেনানায়েকেকেও বোলিং অ্যাকশন নিয়ে নিষেধাজ্ঞায় পড়তে হয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সুনিল নারাইন (বিশ্ব ক্রিকেটে আরেক তরুণ নক্ষত্র) তাকেও বোলিং অ্যাকশনের দায়ে নিষিদ্ধ করা হলো। এভাবে উঠতি ক্রিকেটারদের, বিশেষ করে নতুন দেশ যারা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে শুরু করেন, তাদেরকে হঠানোর রাস্তা (ওমুকের বোলিং অ্যাকশন অবৈধ) বের করা হয়।
৫.
তাসকিন ও সানীর বিরুদ্ধে অ্যাকশন সমস্যার কথা উঠলেই এর প্রতিবাদ করেন বাংলাদেশের কোচ হাথুরুসিংহে। শাস্তির ভয় না পেয়ে, তথাকথিত নিয়মের ধার না ধেরে বাংলাদেশের কোচ বলে ফেললেন, ‘তাদের যদি আমার বোলারদের নিয়ে সন্দেহ থাকে, আমারও তাদের (আইসিসির) অ্যাকশন নিয়ে সন্দেহ আছে।’
আইসিসির বিপক্ষে অভিযোগকে আরো উস্কে দেয় ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২০ বছর ধরে আইসিসির বোলিং অ্যাকশন বিষয়ক ব্যাপার দেখভাল করা প্রতিষ্ঠান ইউডব্লিউএ। এই প্রতিষ্ঠানের একাধিক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, আইসিসি বর্তমানে যে পদ্ধতিতে এবং যে রকম অস্বচ্ছতার সঙ্গে বিভিন্ন পরীক্ষাগারে পরীক্ষাগুলো করছে তা হাস্যকর, সন্দেহজনক ও ত্রুটিপূর্ণ। এ নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বেশ কিছুদিন ধরেই আইসিসির টানাপোড়েন চলছিল। তারই চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে গত বছরের মার্চে। যখন ইউডব্লিউএ দাবি করে যে, তারা আইসিসির পাশ থেকে সরে যাচ্ছে। এই টানাপোড়েনের এক পর্যায়ে পরস্পরের বিপক্ষে আইনজীবী নিয়োগের মতো পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয়েছিল। এরপর থেকে আইসিসি বোলিং অ্যাকশন পরীক্ষার দায়িত্ব দেয় কার্ডিফ, ব্রিসবেন ও চেন্নাইয়ের তিনটি ল্যাবরেটরিকে। ইউডব্লিউএ দাবি করেছে, এই তিনটি পরীক্ষাগারে পুরানো পদ্ধতি নিয়ে যেভাবে পরীক্ষা করা হচ্ছে, তাতে কিছুতেই সঠিক ফলাফল পাওয়া সম্ভব না।
৬.
এর আগে যেসব বোলারকে সন্দেহ করা হয়েছিল, তাদের অনেকেই পরে বৈধ বলে পরে স্বীকৃতি পেয়েছেন। এ ছাড়া আইসিসির বিগ থ্রি নামে পরিচিত তিনটি দেশ ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের কোনো উল্লেখযোগ্য বোলার কখনোই সন্দেহের তালিকায় এখন পর্যন্ত আসেননি। ফলে মাঠের বাইরে খেলা হচ্ছে, এমন সন্দেহও তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি বোলিং অ্যাকশন নিয়ে আইসিসির ‘অবৈজ্ঞানিক’ অবস্থান নিয়েও আছে নানা অভিযোগ।
৭.
ক্রিকেট বিশ্বে নতুন পরাশক্তি বাংলাদেশ। লাল-সবুজের ক্রিকেট দল আজ সারা দুনিয়ায় বাংলাদেশের সেরা ব্র্যান্ড। পাকিস্তান, ভারত, সাউথ আফ্রিকাকে সিরিজ হারানোর পর থেকে দেশ-বিদেশের মিডিয়াগুলোতে বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা। হয়তো এ কারণেই বাংলাদেশ ক্রিকেট যেন সামনে এগুতে না পারে এ কারণেই নানা ষড়যন্ত্র। আর এর শিকার এখন হয়তো তাসকিন-সানী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, এরপর হয়তো মুস্তাফিজও এরকম ঘটনার শিকার হতে পারেন। তাই এজন্য বলব, বিশ্বের লিজেন্ড ক্রিকেটারদের এখন মুখ খুলতে হবে। এসব ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে হবে। যেমনটা শুরু করেছেন বাংলাদেশের কোচ হাথুরুসিংহে। সানী-তাসকিনের বোলিং অ্যাকশন অবৈধ সন্দেহের পর হাথুরুসিংহে বলেছিলেন-‘আমাদের জন্য খবরটি বিস্ময়ের হলেও তা মেনে নিতেই হবে। আমার বোলারদের নিয়ে যদি তাদের উদ্বেগ থাকে, তবে তাদের কর্মকাণ্ড নিয়েও আমার উদ্বেগ আছে। কারণ আমি (বোলারদের) কোনো ভুল দেখছি না।’ ‘তাসকিন ও আরাফাত সানির বোলিং অ্যাকশনে সন্দেহ করার কিছু নেই। আমার বিশ্বাস ওদের অ্যাকশন যথেষ্টই ঠিক। ওরাও তাই বিশ্বাস করে।’
সরি তাসকিন, তা আর হলো না।
যাতে কেউ বাংলাদেশের ক্রিকেটকে কলঙ্কিত করতে না পারে, সেজন্য বিসিবিকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য আমার কয়েকটি প্রস্তাব এখানে তুলে ধরছি- সব ধরনের অপপ্রচার থেকে বাঁচাতে শক্তিশালী স্পোর্টস মিডিয়া তৈরি করতে হবে। ইএসপিএনের মতো ওয়েবসাইট করতে হবে। শুধু আতাহার আলী খান ও শামীম চৌধুরী নয়, আরো বেশি বেশি এ রকম ধারাভাষ্যকার তৈরি করতে হবে। এনামুল হক মনি, শরফুদ্দৌলা সৈকত নয়, আইসিসিতে আরো বেশি বাংলাদেশি আম্পায়ার রাখার জন্য বিসিবিকে উদ্যোগ নিতে হবে। বেশি বেশি ক্রিকেট বিশ্লেষক তৈরি করতে হবে, যারা আন্তর্জাতিক স্পোর্টস মিডিয়ায় আলোচনা করবেন।এসব হলেই কেবল মাঠের বাইরের রাজনীতিতে সফল হওয়া যাবে।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো
লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন
আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা
“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন
বাবা যখন ধর্ষক
যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন