ধর্ষণ প্রশ্নে একই কাতারে যখন বিজয়ী আর বিজিত
পারভীন সুলতানা ঝুমাঃ কিছুদিন আগে মিসরের বিখ্যাত আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুয়াদ সালিহ বলেছিলেন, “আল্লাহ মুসলিম পুরুষদের অমুসলিম নারীদের ধর্ষণ করার অনুমতি দিয়েছেন। যৌনদাসীদের সঙ্গে পুরুষদের যৌনসম্পর্ক স্থাপন করার পথ আল্লাহ খোলা রেখেছেন।” এ বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতায় ওই নারী অধ্যাপক ইহুদি নারীদের ধর্ষণ করার পক্ষেও সাফাই গান। ইহুদিরাও বা ছাড়বে কেন? ইসরাইলি এক রাব্বি বলেন, যুদ্ধকালীন নারীদের ধর্ষণ করা অনুমোদনযোগ্য।
“যুদ্ধ মানে শত্রু শত্রু খেলা”– এই খেলায় নারীর উপর যত ধরনের বর্বরতা করা যায় তার উদাহরণ পৃথিবীর সবকটি যুদ্ধে দেখা গেছে। বলা যায়, যুদ্ধের ইতিহাস যত দিনের নারীদের উপর সহিংসতার ইতিহাসও তত দিনের।
ধর্ম প্রবর্তনের আগ থেকেই শত্রুপক্ষের নারীদের উপর অত্যাচারের অনুমোদন ছিল। ধর্ম প্রবর্তনের পর সেটির উপর নিষেধজ্ঞা জারি না করে বরং তা আরও উৎসাহিত করা হয়েছে। ইসরাইলের মতো চরম ধর্মতান্ত্রিক দেশের রাব্বি যেমন এ ধরনের বক্তব্য দিতে পারেন তেমনি ইসলামি ধারায় রাজত্ব কায়েমের আকাঙ্ক্ষাকারীরা ‘গনিমতের-মাল’ ধারণাটি জোরালোভাবে ধারণ করে থাকেন।
হুমায়ুন আজাদ তাঁর ‘নারী’ বইয়ে বলেছেন–
“সব ধর্মেই নারী অশুভ, দূষিত, কামদানবী, নারীর কাজ নিষ্পাপ স্বর্গীয় পুরুষদের পাপবিদ্ধ করা এবং সব ধর্মেই নারী অসম্পূর্ণ মানুষ।”
এ কারণে ‘অসম্পূর্ণ’ মানুষের উপর পুরুষদের যখন যা কিছু করার ‘লাইসেন্স’ দেয় ধর্ম। এক ধর্ম অন্য ধর্মের নারীকে সম্ভোগ করার বৈধতা দিয়েছে বটে, কিন্তুু তাই বলে নিজ ধর্মের নারীদের ছাড় দিয়েছে, তা নয়। তালেবান বা আইএস মুসলিম মেয়েদেরও ধরে নিয়ে যৌনদাসী বানাচ্ছে। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি অমুসলিম নারীদের উপর যেমন নির্যাতন করেছে তেমনি বাঙালি মুসলিম নারীদেরও ছাড় দেয়নি। তবে একাত্তরে পশ্চিম পাকিস্তানিরা মনে করত, পূর্ব পাকিস্তানে কোনো মুসলিম নেই, সবাই হিন্দুু। কারণ, নারীরা কপালে টিপ দেয়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়।
খুবই দুঃখজনক ব্যাপার যে, এখনও এই মানসিকতার মানুষের আর্বিভাব শুধু নয়, তাদের সংখ্যাও বাড়ছে ভয়ঙ্করভাবে। মুসলিম কর্তৃক মুসলিম নারীদের উপর অত্যাচারের ঘটনা শুধু একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ঘটেনি, বহু আগে হারারা যুদ্ধে ইয়াজিদ সেনারা মদিনায় তিনদিন ধরে গণহত্যা ও গণধর্ষণ চালায় (মোহম্মদিয়া ব্লগ)। গণধর্ষণের ফলে এক হাজারের বেশি শিশু জন্ম নেয় বলে জানা যায়।
যুদ্ধে নারীর উপর অত্যাচারকে (ধর্ষণ) যুদ্ধচালনার একটি কৌশল হিসেবেও গণ্য করে অনেক সেনাবাহিনী। এবং সেনাপ্রধানের উৎসাহে তারা শত্রুপক্ষর নারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
একাত্তরে সামরিক শাসক নিয়াজির ধর্ষণের বিষয়ে বহু আলোচিত বক্তব্য “আমার সেনারা পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ করবে আর নারী খুঁজতে বেলুচিস্তান যাবে?” স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয় ধর্ষণ কতটা ‘জায়েজ’ করে নিয়েছিল তারা।
কিছুদিন আগেও যুদ্ধে বেসামরিক জনগণ হত্যা যেভাবে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হত, ধর্ষণকে ততটা নয়। তবে যুদ্ধে ধর্ষণ অপরাধ হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে গণ্য করার পরও শুধু ধর্ষণের জন্য বিচার কাজ হয়েছে– এমন নজির খুব একটা দেখা যায় না।
বিষয়টি পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। ধর্ষণ যত না দুই পক্ষের বিবাদের ফল, তার চেয়েও বেশি পুরুষদের শক্তিমত্তা দেখানো বা ব্যবহারের ফল।
গণহত্যা যেখানে ঘটে, সেখানে ‘গণধর্ষণ’ একটা সমার্থক শব্দের মতোই কাজ করে। সার্বিয়ায় কী হয়েছে? কী হয়েছে রুয়ান্ডায়? ‘এথনিক ক্লিনজিং’এর নামে লাখ লাখ মুসলিম নারীকে ধর্ষণ করে সার্ব সেনারা। রুয়ান্ডায় জাতিগত সংঘাতের কারণে লাখ লাখ নারী পাশবিক শিকারের বলি হয়েছে। কঙ্গোকে তো বলা হয় পৃথিবীর ‘ধর্ষণের রাজধানী’! শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করতে, তাদের মনোবলে ধস নামাতে অথবা এথনিক ক্লিনজিংয়ের জন্য শুধু নয়, অনেক ক্ষেত্রে সেনাদের পুরস্কৃত করার জন্যও রণনেতারা ধর্ষণ উৎসাহিত করে। এমনকি প্রশাসন স্বয়ং সেনাবাহিনীকে মজুরির পরিবর্তে নারী সম্ভোগের অনুমোদন দেয়– যেমন: দক্ষিণ সুদানে।
যুদ্ধ ছাড়াও বিভিন্ন সংঘাত-সংঘর্ষ, দাঙ্গায় হত্যা, লুটের পাশাপাশি নির্বিচারে চলে ধর্ষণ। সাতচল্লিশের দাঙ্গাকালীন ধর্ষণের ভয়াবহতা দেখতে পাই কৃষণ চন্দরের লেখায়। তাঁর বিখ্যাত ‘গাদ্দার’ বইটির একটি অংশ উল্লেখ করছি। হুবহু না হলেও বিষয়টি অনেকটা এমন ছিল–
লেখক একটা লম্বা একটি লাইনে দাঁড়ানো এক লোককে জিজ্ঞাস করেন, “কিসের রেশন দেওয়া হচ্ছে?” লোকটির উত্তর, “এখানে সেক্সের রেশন দেওয়া হচ্ছে।” অর্থাৎ একটা ঘরে একটা মেয়েকে রাখা হয়েছে আর পুরুষরা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে মেয়েটিকে বলৎকার করার জন্য।
এসব পুরুষ সেনাবাহিনীর সদস্য নয়, নয় কোনো বিদ্রোহ বাহিনীরও; তারা সাধারণ মানুষ (পুরুষ)। কিন্তুু লাইনে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়েকে সম্ভোগ করার জন্য। এসব পুরুষ হয়তো বাড়িতে রেখে এসেছে তাদের বোন, মা বা স্ত্রী।
ধর্ষণস্পৃহা অনেক পুরুষের মনে বাস করে, সুযোগ পেলেই তার প্রকাশ ঘটে। পাঞ্জাব, নোয়াখালী বা গুজরাত অথবা বাংলাদেশে ২০০১ সালের নির্বাচনের পর যারা নারীদের উপর নির্যাতন চালিয়েছে তারা ভিনদেশ থেকে আসেনি, তারা ছিল নির্যাতনের শিকার নারীদের প্রতিবেশী, আশেপাশের মানুষজন।
আইএস সদস্যরা যৌনদাসী কেনাবেচা করছে। সেই জঙ্গিদের যখন কিছু সংখ্যক নারী সমর্থন দেয় তখন সত্যি বিস্ময়ের অন্ত থাকে না! যারা নারীদের ‘সেক্স অবজেক্ট’ ছাড়া কিছুই মনে করে না তাদের কিভাবে নারীরা সমর্থন জানায়, তা উপলদ্ধি করা সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এসব নারী যখন নিজেদের চরম অবমাননা মেনে নিয়ে জঙ্গিদলে নাম লেখায়, তখন তাদের প্রতি আরও বেশি ধিক্কার আসে।
ঘৃণা প্রকাশের বিভিন্ন সময় যখন কেউ এদের ‘গণবলৎকার করা উচিত’ বলে মন্তব্য করে, তখন আহত হতে হয়। এরাই আবার পুরুষ জঙ্গিদের ক্ষেত্রে শাস্তি হিসেবে কোনো যৌননির্যাতনের কথা বলে না। তাদের হয়তো ‘ক্রস ফায়ার’এ দিতে বলে, বা অন্য কোনোভাবে সাজা দিতে চায়, কিন্তুু তাদের ‘বলৎকার’ করতে হবে– এ কথা বলতে শোনা যায় না।
নারীদের বিষয়ে তথাকথিত প্রগতিশীল পুরুষরা মুখ ফসকে অনেক সময় অনেক কথা বলে ফেলে যা থেকে প্রমাণিত হয় তাদের মনের কোণে পুরুষতান্ত্রিকতা ঘাপটি মেরে আছে।
পৃথিবীর একটি অঞ্চলে যেখানে স্বাধীনতার জন্য প্রায় ৭০ বছর ধরে স্থানীয় অধিবাসীরা লড়াই করে যাচ্ছে, দখলদার বাহিনী সেখানে অকথ্য নির্যাাতন চালাচ্ছে। আমার পরিচিত একজনের আত্মীয় বিবাহসূত্রে সেখানে বসবাস করেছে বেশ কয়েক বছর। সত্য-মিথ্যা জানি না, তবে সেই আত্মীয় জানিয়েছেন, যতই অত্যাচার করুক, দখলদারবাহিনী তাদের নারীদের উপর তেমন পাশবিক নির্যাতন চালায় না। এ তথ্য আমার আরেক সংস্কৃতিমনা পুরুষ সহকর্মীকে জানালে তার সরল উত্তর, “তাহলে সেই দখলদার বাহিনীর জন্য বিকল্প কোনো ব্যবস্থা আছে।”
সেই প্রগতিশীল ব্যক্তিটিও মনে করেন, যুদ্ধে ধর্ষণ খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কারণ, এতদিন লুট আর ধর্ষণকে একই অপরাধ হিসেবে বিবেচিত করা হত। সম্প্রতি জাতিসংঘ ধর্ষণকে যুদ্ধকালীন অপরাধ হিসেবে স্বতন্ত্রভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
যুদ্ধে, তা যে কোনো ধরনেরই হোক, দুই রাষ্ট্রের বা জাতির মধ্যকার যুদ্ধ অথবা একাধিক গোষ্ঠীর মধ্যকার সংঘাত, আমরা বিজয়ী দলের নারীদের উপর বিপক্ষ দলের অত্যাচারের কাহিনি বলি। কিন্তুু বিজিত দলের নারীদের উপরও নির্যাতন চলে সমানভাবে। যারা একটি ‘আদর্শ’ সামনে রেখে যুদ্ধ করে তারাও বিপক্ষ শিবিরের নারীদের উপর পাশবিক অত্যাচার করার ব্যাপারে পিছপা হয় না।
আমরা জানি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাৎসি বাহিনী ইহুদি নারীদের উপর কী বীভৎস অত্যাচার চালিয়েছিল। আমরা কজন বলি, মিত্রবাহিনীর সোভিয়েত সেনারা জার্মান নারীদের বলৎকার করেছিল।
সোফিয়া লরেনের অভিনীত ‘টু উইমেন’ ছবিতে দেখা যায়, মা-মেয়েকে গির্জার মধ্যে মিত্রবাহিনীর সেনারাই ধর্ষণ করে।
আমরা কি জানি, আমাদের পার্বত্য চট্রগ্রামের নারীদের উপর কী হচ্ছে? আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘের শান্তিবাহিনীর কিছু সদস্যের বিরুদ্ধেও ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, যখনই সুযোগ পাওয়া গেছে তখনই পুরুষ তার এই ‘পুরুষত্ব’ প্রয়োগ করে নির্বিঘ্নে; এখানে শিক্ষা, পদমর্যাদা, সংস্কৃতি, সভ্যতা কোনো কিছুরই পরোয়া করে না তারা। এভাবেই বিজয়ী ও বিজিত যোদ্ধারা একই কাতারে সামিল হয়।
যুদ্ধে ধর্ষিত নারীরা পরবর্তীতে অসহনীয় যন্ত্রণা আর কষ্টের মধ্যে দিনযাপন করেন।
বর্তমান সরকারের অন্যতম বড় কৃতিত্ব বীরাঙ্গনাদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। স্বাধীনতার পর বীরাঙ্গনাদের একাংশ আত্মহত্যা করেন। একাংশ নাকি পাকসেনাদের সঙ্গে পাকিস্তানেও চলে গেছেন। বাকি যারা ছিল তারা বৈরী সমাজের সঙ্গে মিশে যেতে পারেননি। কিছু পুরুষ তাদের বিয়ে করে বাইরে উদারতা দেখালেও প্রকৃতপক্ষে নিজ স্বার্থ হাসিলে তা করে।
রিজিয়া রহমানের ‘রক্তের অক্ষর’ উপন্যাসে এ ধরনের ঘটনার কথা বলা হয়েছে। ব্যবসার কাজে বৌকে ‘উৎকোচ’ দিয়ে কাজ আদায় করা ছিল এক উদার ভদ্রলোকের মূল উদ্দেশ্য। অতঃপর বীরাঙ্গনা নারী বেশ্যালয়ে আশ্রয় নেন। শরীর বেচে যদি চলতেই হয় তাহলে আর স্বামীর ঘর করা কেন? যে নারীদের একবার ‘ইজ্জত’ যায় তাঁরা সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যান। তাঁদের আর কোনো অধিকার নেই স্বাভাবিক জীবনযাপন করার। তাঁরা হয়ে যান সবার ভোগ্য! এ ধরনের মানসিকতা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আজও চলছে।
বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কাজ করেন এমন এক নারী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন–
“স্বাধীনতার পর কোনো কোনো রাতে পাড়ার প্রভাবশালী পুরুষ এসে বীরাঙ্গনাদের নিয়ে যেত ভোগ করার জন্য।”
যারা মনে করে যুদ্ধের সময় ধর্ষণের ঘটনা স্বাভাবিক, তারা কিন্তুু ধর্ষিত নারীদের সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করে না। ধর্ষণকে যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের বিপক্ষে এখন সোচ্চার হয়ে উঠছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সংগঠন।
সম্প্রতি কলম্বিয়া সরকার ও ফার্ক বিদ্রোহীদের মধ্যে যে শান্তিচুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে, সেখানে ধর্ষণের মতো অপরাধ সাধারণ ক্ষমতার বাইরে রাখা হয়েছে। এল সারভাদরে মাক্সবাদী বিদ্রোহীরা ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজ থেকে বিরত থাকার প্রতিজ্ঞা করে যুদ্ধ করছে।
যত দিন নারীকে পুরুষের সম্পত্তি মনে করা হবে তত দিন যুদ্ধ-সংঘাতে বিজয়ী ও বিজিত উভয় দলের পুরুষ যোদ্ধারা ধর্ষণকে যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবেই দেখবে।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো
লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন
আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা
“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন
বাবা যখন ধর্ষক
যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন