রবিবার, সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৪

আমাদের কণ্ঠস্বর

প্রধান ম্যেনু

তারুণ্যের সংবাদ মাধ্যম

নারী নির্যাতনকারী পুরুষরা বোধহয় এমনই হয়

“তুমি ভেবেছো শুধু বাবাই তোমাকে মারে। যাও খোঁজ নিয়ে দেখো তোমার বান্ধবীদেরও তাদের হাবিরা (স্বামী) মারে।”- ১৩ বছর বয়সী রায়হানের কথা শুনে কান্তার ফর্সা মুখটা বেদনায় নীল হয়ে গেলো। রায়হানের বাবা যেদিন প্রথম কান্তার গায়ে হাত তুলেছিল সেদিনও কান্তা এতোটা কষ্ট পায়নি। তার চোখ দিয়ে পানি গড়াতে লাগল।

দুই.

আমি যখন কান্তার ঘটনা শুনলাম বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। আমার মাথায় আসছিল না কী করে ১৩ বছরের একটি ছেলে (পুরুষ মানুষ) তার মাকে এমন কথা বলতে পারে। কিন্তু এটাই সত্যি। আর এই সত্য আমাকে আরো অনেক সত্য জানতে সাহায্য করেছে।

এখন আমার কেন জানি মনে হয় রায়হান বড় হয়ে তার বউকে পেটাবে। এমনকি রায়হানের বোনকে তার স্বামী পেটালে সেটাও রায়হান স্বাভাবিক ভাববে। কারণ নারী নির্যাতনকারী পুরুষরা বোধহয় এমনই হয়। তাদের চিন্তা চেতনায় নারী নির্যাতন একটি স্বাভাবিক ব্যাপারমাত্র। আমি আমার পরিচিতদের মধ্যে দেখতে পাই, শারীরিক নির্যাতনের চেয়েও নারীরা বেশি নির্যাতিত হচ্ছেন মানসিকভাবে। আর সেই নির্যাতনে অনেকসময় পুরুষ মানুষের পরিবারের সদস্যদের সমর্থন ও সহযোগিতা থাকছে।

তিন.
আমি এক দম্পতিকে চিনি যারা প্রেম করে বিয়ে করেছে। তাদের সংসারে যতোদিন অভাব ছিল ততোদিন পুরুষ মানুষটি নিজের ভেতরের পশুকে দমিয়ে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু যখনই তার হাতে পরিশ্রম ছাড়াই টাকা আসতে লাগল, তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা পশুটা বের হয়ে এলো। বউকে পেটানো ও মানসিক নির্যাতন করা তার কাছে এক ধরনের খেলায় পরিণত হলো। আর তার এই নির্যাতনে মা ও বোনদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন রয়েছে। “স্বামীরা এক আধটু শাসন করেই।”- এই ধরনের কথা তারা প্রায়ই নির্যাতনের শিকার বউকে স্মরণ করিয়ে দেয়। খোঁজ নিয়ে দেখা গেলো- নির্যাতনকারী পুরুষের বাবাও তার মাকে মারত। আবার তার মায়ের বাড়িতে মামারা তাদের বউকে পেটায়। ফলে, নির্যাতনকারী পুরুষের মা যেমন নিজের জীবনে নির্যাতিত হয়েছেন, নির্যাতিত হতে দেখেছেন ভাইয়ের বউদের, সেকারণে তার কাছে তার ছেলের বউকে পেটানো স্বাভাবিক মনে হয়। কিন্তু বিপদ হয়েছে মেয়েটির। কারণ মেয়েটির পরিবারে দাদা বাড়ি কিংবা নানা বাড়ি কোনটাতেই বউ পেটানোর ঘটনা নেই। ফলে মেয়েটি তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় দিন কাটাচ্ছে।

চার.

আমাদের দেশের নির্যাতনকারী পরিবারগুলো এবং সমাজের আরেকটি বড় সমস্যা হলো নারীর শারীরিক নির্যাতনকে কেউ কেউ গুরুত্ব দিলেও; নারীর মানসিক নির্যাতন বেশিরভাগ সময় গুরুত্ব পায় না কিংবা চোখের আড়ালে থেকে যায় কিংবা গুরুত্ব পায় না।

একজন গৃহবধূকে তার স্বামী পুরুষ মানুষটি যখন বলে- দুই পয়সা তো কামাই করার মুরোদ নেই সংসারেরটা তো খেয়ে খেয়ে গায়ে গতরে ভালোই মোটা হয়েছো; তখন সেই গৃহবধূর নিশ্চয়ই মনে হয় মাটি তুই আমাকে কেন এখনো নিয়ে যাচ্ছিস না! খুব ভালো হতে পারত, যদি নির্যাতিত নারী ওই পুরুষ মানুষটির মুখে ভাতের হাড়ি ছুড়ে মেরে চলে আসতে পারত। কিন্তু বেশিরভাগ নারীর পক্ষে সেটা সম্ভব হয় না। এমনকি আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকলেও।

যেমন রায়হানের মা কান্তা খুব ভালো একটি চাকরি করে। মাস শেষে যা বেতন পায় সেটা তার নিজের চলার জন্য যথেষ্ট। তারপরও কান্তা রায়হানের বাবার মুখে কখনো কষে একটা চড় দিতে পারেনি, যা তার স্বামী তার মুখে বুকে পিঠে পায়ে হরহামেশা দিয়ে থাকে। হয়তো কান্তা তার পরিবারে সেই শিক্ষা পায়নি। কিংবা অন্য কোন অজানা কারণে কান্তা হাত গুটিয়ে থাকে। এটাও সামাজিক গবেষণার বিষয় হতে পারে।

পাঁচ.
পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে, বউ পেটানোর ঘটনা বাংলাদেশের সমাজে বেড়ে যাচ্ছে। ২০১১ সালের এক জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, বাংলাদেশে ১০ জনের ৯ জন নারীই নির্যাতনের শিকার। এর মধ্যে শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, যৌন সব ধরনের নির্যাতন রয়েছে। আজ থেকে ৪০ বছর আগেও বাংলাদেশে বউ পেটানোর ঘটনার হার এতোটা ছিল না। যতোটা এখন দেখা যাচ্ছে। কেউ যদি বলেন, আগেও এমন ছিল কিন্তু সেটা প্রকাশ পাইনি। আমি সেটা মানব না। ৮০ এমনকি ৯০ এর দশকেও পুরুষ মানুষেরা অনেক সমঝে চলেছে। কেন আগে নারী নির্যাতন বিশেষ করে বউকে নির্যাতন কম ছিল এখন বেড়েছে সেটা সামাজিক গবেষণার বিষয়। তবে আমার কিছু পর্যবেক্ষণ আছে।

মোটা দাগে আমি মনে করি বাংলাদেশের সমাজে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার নিম্নগতির সঙ্গে সঙ্গে নারী নির্যাতন বেড়েছে। ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি মানুষের অনাগ্রহও নারী নির্যাতন বাড়তে সহায়তা করেছে। মুসলিম প্রধান বাংলাদেশের মানুষের ধর্ম ইসলাম। আর ইসলাম ধর্মে নারীকে উচ্চতর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। অন্য ধর্মেও নারীদের প্রতি সম্মান দেখানো হয়েছে। কিন্তু যেহেতু কর্মব্যস্ত পুরুষ মানুষেরা ধর্ম অধ্যয়ন ও চর্চা থেকে দূরে সরে গেছে তাই তারা ধর্মের সঠিক শিক্ষা পাচ্ছে না কিংবা জানলেও চর্চা করছে না। এছাড়াও আমাদের দেশে পুরুষ মানুষের নির্যাতনকারী হওয়ার আরো কিছু কারণ আছে। আমি এখানে দু’টি বিষয় উল্লেখ করতে চাই:

ক. বাংলাদেশের সমাজে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙ্গে যাচ্ছে, এমনকি একক পরিবারগুলোর মধ্যে যোগাযোগও কমে যাচ্ছে। ফলে, আগে যেখানে পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠরা কিংবা প্রতিবেশীরা স্বামী-স্ত্রীর কলহ মিটমাট করতে ভূমিকা রাখতে পারত কিংবা স্বামী স্ত্রী বৃহত্তর পারিবারিক পরিবেশ বা আবহে থাকার কারণে নিজেরাই নিজেদের সামলে রাখত সেই দিন গত হয়েছে। এটা শহর ও গ্রামে সবত্রর্ই।

খ. দ্বিতীয় কারণটি হলো অর্থকেন্দ্রিক সম্মান ও সামাজিক মূল্যবোধ। বাংলাদেশের সমাজে এখন যার টাকা আছে তার যেন সব করার অধিকার তৈরি হয়। সমাজ ও রাষ্ট্র সেটা মেনেও নিচ্ছে। আর এর মধ্য দিয়ে পুরুষ মানুষ আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

ছয়.
প্রশ্ন হলো এমনটা কী চলতেই থাকবে? এর সহজ উত্তর হলো- এটা চলতে থাকবে নাকি বন্ধ হবে নাকি নিয়ন্ত্রিত হবে সেটাও নির্ভর করছে সমাজ ও রাষ্ট্র কি চায় তার উপর।

আমরা যদি নারী নির্যাতনের ভয়াবহতাকে রুখতে চাই তাহলে আমাদের দরকার হবে নিবিড় সামাজিক পর্যবেক্ষন ও নারী নির্যাতনের মতো পরিস্থিতিগুলোর গভীর বিশ্লেষণ এবং সামাজিক সমাধান খুঁজে বের করা। মনে রাখা যেতে পারে যে, বাংলাদেশে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে চমত্কার সব আইন আছে। সেসব আইনের প্রয়োগও আছে।

কিন্তু একথাও মনে রাখতে হবে যে, আইন নিজে নিজে কোন সমস্যার সমাধান করতে পারে না। নির্যাতিতকে আগে আইনের শরনাপন্ন হতে হয়। এখানেই সমস্যা। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে নানান সময়ে প্রকাশিত তথ্য থেকে দেখা যায় যে, বেশিরভাগ নির্যাতিত নারী প্রথমত নির্যাতনকারী “পুরুষ মানুষ”কে আদালতে নিয়ে যেতে আগ্রহী হন না। দ্বিতীয়ত, যারা সাহস করে সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে “পুরুষ মানুষের” বিরুদ্ধে রুখে দাড়ান তাদের জীবনটা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ে। এই অবস্থা দেখে পরবর্তীতে অন্যরা নিরুত্সাহিত হন স্বাভাবিক নিয়মে।

তাহলে উপায়টা কী?

উপায় নিশ্চয়ই আছে। সমস্যার মধ্যেই সমাধানের ইঙ্গিত রয়ে গেছে। যে বীর পুরুষ বউ পেটায় কিংবা বউকে মানসিক নির্যাতন করে সেতো আর পরিবার আর সমাজের বাইরের কেউ নয়। পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামোতে একজন পুরুষ কীভাবে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠে সেটা জানাও কঠিন কিছু নয়। একসময় এই দেশের পুরুষ অনেক নমনীয় এবং মানবিক বোধসম্পন্ন ছিল। কেন তখন ভালো ছিল আর এখন কেন নাই সেটা জানাও কঠিন কিছু নয়। কোন সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশের সমাজে ঘুণেপোকা ধরেছে। আর সেই সুবাদে পুরুষ মানুষের নির্যাতনমূলক কর্মকান্ড দিনে দিনে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে সমাজে যে বিশৃঙ্খলতা দেখা দেবে তাতে আগামী প্রজন্ম কঠিন বিপদে পড়তে বাধ্য হবে।

এই অবস্থায় আমাদেরকে এখনই সোচ্চার হতে হবে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র যে পুরুষের একার নয়, এটা সব মানুষের সেই কথাটি ভুলে যাওয়া পুরুষদের মনে করিয়ে দিতে হবে। আর পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাঙ্গনে নীতি ও নৈতিকতা শেখানোর সেই পুরনো ধারা ফিরিয়ে আনতে হবে।

রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে যাতে নির্যাতিতরা নির্ভয়ে আইনের শরণাপন্ন হতে পারে। পরিচয় নির্বিশেষে নির্যাতনকারীর উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। নারী নির্যাতন রুখে দেওয়া নারীর একার পক্ষে সম্ভব নয়।আমরা পুরুষ মানুষেরা যেন আমাদের দায়িত্বের কথা ভুলে না যাই!

এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ

খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো

লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন

আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা

“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন

বাবা যখন ধর্ষক

যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন

  • দুই বড় দেশ যখন প্রতিবেশী ও প্রতিযোগী
  • মৌসুমি নৌকা শোরুম
  • ভারতবিদ্বেষ কেন বেড়ে চলেছে?
  • জনগণের কাছে শেখ হাসিনাই জয়ী
  • ‘গুলিস্তান’ নেই, তবু আছে ৬৪ বছর ধরে
  • পদ্মা ব্রিজ দিয়ে কী হবে?
  • যুদ্ধাহতের ভাষ্য: ৭০– “এখন অমুক্তিযোদ্ধারাই শনাক্ত করছে মুক্তিযোদ্ধাদের”
  • আসুন, বড় হই
  • আসুন, পিঠের চামড়া না তুলে পিঠ চাপড়ে দিতে শিখি
  • বাড়িওয়ালা মওদুদ ও বাড়িছাড়া মওদুদ
  • ব্রিটেনের নতুন সরকার নিয়ে যে শঙ্কা!
  • আওয়ামী লীগ ছাড়া কি আসলে কোনো বিকল্প আছে?