রবিবার, নভেম্বর ২৪, ২০২৪

আমাদের কণ্ঠস্বর

প্রধান ম্যেনু

ন্যাশনাল ক্রাইম নিউজ পোর্টাল

পর্ন, যৌনশিক্ষা এবং জাপানি দৃষ্টান্ত

বছর খানেক আগে জাপানে এক মোবাইল সেবা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ কাজে গিয়েছিলাম। জাপানে মোবাইল অপারেটরগুলির সিস্টেম হলো সিম কার্ডসহ মোবাইল বিক্রি করা।

তাই এখানকার কাস্টমার কেয়ারগুলো আইফোন, ট্যাব, স্মার্টফোন ডিসপ্লে করে। যাই হোক, আমাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলায় আমি সাজিয়ে রাখা বিভিন্ন ধরনের মোবাইলে সেটগুলো দেখছিলাম।

হঠাৎ চোখে পড়লো ৮/৯ বছরের এক শিশু একটি ট্যাবে পর্ন দেখছে। আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে অন্যস্থানে চলে গেলাম। একটু পিছনে তাকিয়ে দেখি, ওই ছেলে শিশুটি তার দেখা বন্ধ করেনি।

পরে যখন বাসায় ফিরছিলাম, তখন ভাবছিলাম এই এত অল্প বয়সের শিশু পর্ন বিষয়টার কি বোঝে! যে বয়সে আমাদের শব্দগুলো অজানা ছিল আজ এই সভ্য দেশে এই বিষয়গুলো যেন ডাল-ভাত হয়ে গেছে।

ছবি: রয়টার্স

ছবি: রয়টার্স

জাপানে আসার আগে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে জাপান সম্পর্কে যে বাজে ধারণাগুলো পেয়েছিলাম তার মধ্যে অন্যতম ছিল ‘জাপানি পর্ন’। সভ্য ও যন্ত্র জাতির আড়ালে যৌনতা এক ধরনের তারল্য বিষয় হলেও গত দুই বছরে আমার অভিজ্ঞতা শূন্যের কোটায়।

ওই শিশুটির কথা ভেবে একদিন আমার জাপানি বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, জাপানে যৌনশিক্ষা কিংবা পর্ন দেখার বিষয়টি কীভাবে দেখা হয়?

পর্নদেখার বিষয়টি বলাতে সে বলল, “আসলে আমাদের পর্ন দেখা শুরু হয় জুনিয়র স্কুল থেকে। যৌন শিক্ষার বিষয়গুলো ভালভাবে রপ্ত করার এটি একটি পূর্ববর্তী শিক্ষা।

“স্কুলগুলোতে যৌন শিক্ষার খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দেওয়া হয়, যাতে ভবিষ্যত জীবনে যৌনাচারের স্বাভাবিক বিষয়গুলো সে বুঝতে পারে। তবে সরাসরি যৌন শব্দটি কিছুটা এড়িয়ে যাওয়া হয়।

আর তা পূরণ করে পর্ন কিংবা জাপানি জনপ্রিয় কৌতুক বা মাঙ্গা। মাঙ্গা হলো জাপানে কার্টুন কৌতুক। বলতে গেলে, মাঙ্গা বলতে জাপানিরা পাগল।

ওই বন্ধু আরো বললো, সেক্স বিষয়টি সমাজে উন্মুক্ত বলার নিয়ম না থাকলেও যৌনতার বিষয়ে প্রতিটি পরিবারের সদস্যরা সচেতন থাকে। শিশুরা কম্পিউটার কিংবা স্মার্টফোনে যৌন বিষয়গুলোর সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে।

বিষয়টি শোনার পর আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। স্কুলে যখন ক্রোমোসোম এক্স এবং ওয়াই নিয়ে স্যারেরা আমাদের পড়িয়েছিল, তখন আমাদের চোখমুখ লাল হয়ে গিয়েছিল। এমনকি স্যারেরাও মানব দেহের বিশেষ অঙ্গ বিষয়ে পড়াতে দ্বিধাবোধ করতেন। আর এখানে কিনা প্রাইমারি স্কুল থেকে যৌন শিক্ষা শুরু হয়?

বিশ্ববিদ্যালয়ের আগ পর্যন্ত আমি নিজেও যৌনাঙ্গগুলোর নাম লজ্জায় উচ্চারণ করতে পারতাম না। এমনকি ‘সেক্স’ শব্দটি প্রথম বলেছি স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে এসে। সেখানে জাপানি শিশুদের দৌরাত্ম্য দেখলে মনে হবে, আমরা খুব ‘সেকেলে’ টাইপের যুগে জন্ম নিয়েছিলাম।

যাই হোক, এই লেখার সারমর্ম বলে নেওয়া ভাল। কয়েকদিন আগে আমাদের ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী এবং আমাদের ছোটবেলার বিটিভির অন্যতম মুখ তারানা হালিম ‘পর্ন’ সাইট বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কয়েকটি খবরের কাগজ ও নিউজ পোর্টালে সংবাদ এসেছে- তারানা হালিম পর্ন ওয়েবসাইটে ঢোকেন, এমন সবার তালিকা প্রকাশ করবেন বলে হুমকি দিয়েছেন।

একদিন পরে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করলেও এর রেশ কাটবে বলে মনে হয় না। সভ্যতার আলোয় যখন সর্বত্র জয়জয়কার তখন, আমাদের রাষ্ট্রের পথদ্রষ্টারা ভুল পথগুলো আলিঙ্গন করে। এই সময়ে এসে তাই সভ্য দেশগুলোর দুই একটি উদাহরণ দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করছি।

যৌনতা কিংবা জৈবিক বিষয়গুলো প্রাকৃতিক। এই প্রাকৃতিক বিষয়গুলোকে ধর্মীয় অনুশাসনে লুপ্ত করার বিধানে আমাদের সমাজে অন্ধত্ব কিছুটা হলেও গাঢ়তা ছড়াচ্ছে। ধর্মীয় বিষয়ের মোড়কে যৌনতা থাকলেও জ্ঞানের অভাবে অপরিপক্কতা সমাজে রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাস করতে শুরু করেছে। এইসব আমাদের নৈমত্তিক বিষয়গুলোর অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

জাপানের ১৯৯০ সালের সামাজিক আইন অনুযায়ী এই দেশের স্কুলগুলোতে যৌনতা বা নারী পুরুষের যৌনাঙ্গ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ২০০২ সালের সংশোধিত আইন অনুযায়ী কীভাবে জন্মনিরোধক ব্যবহার করতে হয় তা ছাত্র/ছাত্রীদের বোঝাতে স্কুলের জন্য নির্দেশনায় জোরালোভাবে বলা হয়েছে।

পরের বছর অর্থাৎ ২০০৩ সালের আইন অনুযায়ী দেশটিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে যৌন নিপীড়ন কিংবা গর্ভবতী বিষয়ে আইন পাঠদানের কথা বলা হয়েছে, যা আমাদের দেশে গোপনীয়তার আশ্রয় নেয়া হয়। এতে জাপানিরা গর্ভপাতের মতো কঠিন বিষয়গুলো নিয়ে সম্যক ধারণা পান।

২০০৮ সালের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছিল যে, এই দেশটির স্কুলগুলোতে বছরে ৩ ঘণ্টার একটি করে সেমিনার হয়,যা মূলত যৌনাচার ও যৌন দৃষ্টিভঙ্গির সরেস উপস্থাপনের জন্য।

শুধু তাই নয়, কিছু কিছু স্কুলে শিক্ষার্থীদের কীভাবে সেক্সচুয়াল ট্রান্সমিটেড ডিজিসেস বা এসটিডি ছড়ায় তা সচেতন করতে পাঠদান করা হয়। এটাকে জাপানিরা ‘জেকে’ বলে ডাকে।

কিন্তু আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িকতা যেখানে আষ্টেপৃষ্টে লেগে গেছে, অন্ধতা সমাজের লোমকূপের মতো বিরাজ করছে, ধর্ষণ যেখানে পান্তাভাত, সেখানে এমন অদূরদৃষ্টি সম্পন্ন সিদ্ধান্ত কীভাবে সরকার নিতে চায় তা আমার বোধগম্য নয়।

যৌনতাকে কেন এতো গোপন করার চেষ্টা করা হয় তা কী কেউ বলতে পারেন? ঢেকে রাখা জিনিসের প্রতি কৌতুহল বেশি, এরপরও আমাদের বুদ্ধির রশ্মি কেন ক্ষীয়মাণ?

পর্ন বন্ধ করলে কি সমাজে ধর্ষণ কমবে? নাকি সচেতনতার চাদর বিছানো জরুরি? যে জাপানে যৌন বিষয়ে উন্মুক্ত পাঠদান করা হয়, সেখানে কি আমাদের শিক্ষাবিদরা কল্পনা করতে পারেন যে শিশুদের কিংবা কিশোরদের জন্য যৌনপাঠ জরুরি?

সভ্য হতে গেলে অসভ্যতা যেখানে লুকিয়ে আছে তাকে টেনে হিচঁড়ে বের করা উচিত। জাপানি এতো যে পর্ন দেখছে, মাঙ্গা দেখে যৌন সুরসুরি নিচ্ছে, এরপরও কি তারা ধর্ষণ করছে? কিংবা রাস্তায় যৌন বিকার বা ইভটিজিং?

ছবি: রয়টার্স

ছবি: রয়টার্স

এই উত্তরে বলবো, না। আমি এখন পর্যন্ত এমন কোন নারী দেখিনি যারা রাস্তায় অশালীন পোশাকে বের হয়েছে। এমন কোন পার্ক দেখিনি যেখানে নারী-পুরুষ আলিঙ্গন করছে। এরা যৌনজ্ঞান লাভ করেন ভবিষ্যতে স্বচ্ছভাবে চলার জন্য।

যৌন বিষয়গুলোর জ্ঞান থাকায় সমাজে ধর্ষণ নেই বলেই চলে। যৌন বিষয়ে ধারণা নেওয়ার জন্য এই দেশের লাখ লাখ কনভিনিয়েন্ট স্টোরগুলোতে বিশেষ ম্যাগাজিন (যৌনতা ও পর্ন কনটেন্টে ভর্তি) উন্মুক্ত বিক্রি হয়।

জাপানে ৪৪ শতাংশ ভার্জিন নারী-পুরুষ রয়েছে বলে সম্প্রতি এক জরিপে উঠে এসেছে। স্থানীয় জনসংখ্যা ও সামাজিক নিরাপত্তা গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই গবেষণায় দেখা গেছে, জাপানের ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সি শতকরা ৭০ ভাগ অবিবাহিত পুরুষ এবং ৬০ ভাগ অবিবাহিত নারী প্রেমের সম্পর্কে নেই। যাদের মধ্যে শতরা ৪৪ দশমিক ২ ভাগ ভার্জিন বা সতীত্ব নষ্ট করেননি।

তাহলে কি এরা পর্ন দেখে, যৌন উত্তেজক ম্যাগাজিন পড়ে কিংবা মাঙ্গা দেখে,এদের শিশুরা বখে গিয়েছে? এরা কি রাস্তায় ইভটিজিং করছে?

না, এই সবের কিছুই দেখি না। কারণ, এরা যৌনজ্ঞান লাভ করে তার সঠিক ব্যবহার করছে। কিন্তু আমাদের সমাজের বিকৃত মানসিকতার জন্ম নিচ্ছে কেবলমাত্র পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের গোঁড়ামির কারণে। আমরা ছেলে-মেয়ের মধ্যে যে দূরত্ব করে দিয়েছে তা দিয়ে কি আমাদের সমাজের রুগ্নতা ঘুঁচিয়েছে?

ছবি: রয়টার্স

ছবি: রয়টার্স

সময় এসেছে, প্রাকৃতিক বিষয়গুলো সহজভাবে তুলে ধরা। পর্ন সাইটে নজরদারিতে কিছু যায় আসে না কিংবা সেই বিষয়ে আমার কোন মন্তব্য নেই। কিংন্তু যৌন শিক্ষার বিষয়টি ভাবনার সময় এসেছে।

স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচিতে যৌনশিক্ষা  জরুরি বলেই মনে করছি। ‘অবাধ যৌনতা’ শব্দটি নিয়ে যেমন আপত্তি আছে তেমনি,’নিরোধক চিন্তা’ নিয়ে উন্মেষতার সুযোগ থাকবে।

লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক

ইমেইল: [email protected]

এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ

খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো

লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন

আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা

“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন

বাবা যখন ধর্ষক

যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন

  • দুই বড় দেশ যখন প্রতিবেশী ও প্রতিযোগী
  • মৌসুমি নৌকা শোরুম
  • ভারতবিদ্বেষ কেন বেড়ে চলেছে?
  • জনগণের কাছে শেখ হাসিনাই জয়ী
  • ‘গুলিস্তান’ নেই, তবু আছে ৬৪ বছর ধরে
  • পদ্মা ব্রিজ দিয়ে কী হবে?
  • যুদ্ধাহতের ভাষ্য: ৭০– “এখন অমুক্তিযোদ্ধারাই শনাক্ত করছে মুক্তিযোদ্ধাদের”
  • আসুন, বড় হই
  • আসুন, পিঠের চামড়া না তুলে পিঠ চাপড়ে দিতে শিখি
  • বাড়িওয়ালা মওদুদ ও বাড়িছাড়া মওদুদ
  • ব্রিটেনের নতুন সরকার নিয়ে যে শঙ্কা!
  • আওয়ামী লীগ ছাড়া কি আসলে কোনো বিকল্প আছে?