ট্রাম্প
পাকা বেল ও কাকের গল্প
কদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এক বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বুঝলাম মন খারাপ। খানিক চিন্তিত। প্রবাসজীবনে প্রথম ভোট দেওয়ার খুশিতে ছাই ফেলেছে পছন্দের প্রার্থীর হেরে যাওয়া। ঠাট্টা করে বললাম- ভোট দিলে কাকে? হিলারি না ডেমোক্রেটদের? বলল, ‘দুটোই। হাই হিলের হিলারিকে মসনদে বসানোর কলিজা কি আর আমেরিকানদের আছে? তাই বঙ্গ সন্তানের কলিজাটা দেখিয়ে দিলাম। আমাদের দেশ দেখেও শেখে না মাথা মোটাগুলো’- বলেই ঠা ঠা করে হাসি।
অবাক হলাম, খয়েরি পাসপোর্টের জন্য ‘কী না করা?’ এই বন্ধু এখনো বলে ‘আমার দেশ!’ ‘আজ থেকে আমি আমেরিকান’ এমন শপথ নেওয়ার পরও বলে, ‘আমার দেশ!’
দীর্ঘশ্বাস চেপে বললাম, ডেমোক্রেট কেন? এই দল এলে কি আমাদের দেশ নিরাপদে থাকত?
উত্তর : পাগলা ষাঁড়ের চেয়ে শেয়াল ভালো। (এবার আর দেশকে টানতে দেখা গেল না তাকে) সম্মানজনক পেশা, নিজের বাড়ি, স্বচ্ছল জীবন! কিসের এত ভয়?
‘বর্ণবিদ্ধেষ’- চটজলদি জবাব তার।
যে এলাকায় আমার আমেরিকান বন্ধুর বাস তা ডেমোক্রেটদের দখলে। তাই আপাতত ভয়ের কোনো কারণ নেই। আর তা না হলেও সমস্যা কি? কথায় কথায় বুলি আওড়ানো ‘আফটার অল ইটস আমেরিকা’ আওড়ানো জাতি বলে কথা! কিন্তু গত ১১ মাসে নির্বাচনী নাটকে ধর্ম-বর্ণ নিয়ে বিদ্বেষের যে বিষবাক্য শুনতে হয়েছে গোটা জাতিকে, সেই বিবেচনায় বুকে হাত দিয়ে অন্তত আমি বলতে পারি- আমার দেশ স্বর্গতুল্য।
প্রবাসী বন্ধুর এই ভয় এখন প্রায় প্রতিটি অভিবাসীর। বৈধ হয়েও যুযু বুড়ির আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের। ধর্মের প্যানপ্যানানির জন্য দেশের ওপর যে গোস্বা সেই একই কাহিনী সাদা চামড়াদের দেশেও। আর বৈধ করার যে মুলো আট বছর ধরে ঝুলিয়ে রেখেছিল ওবামা সরকার তা যে ভেস্তে গেছে এটা বুঝতে পেরে ঘর থেকে বেরুনো প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে অনেকে। ধরা পড়লে, পুরোই ধরা…।
এ তো গেল ওখানকার মানুষের কথা। কিন্তু শত যোজন মাইল দূরে কোন না কোন ডোনাল্ড ট্রাম্প রাষ্ট্রপ্রধান হলো তাতে সিএনজিচালক মনিরুলের কি? এ তো আর খালেদা-হাসিনার স্বচ্ছ ব্যালটের যুদ্ধ নয়! কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির তাপ যখন নিজের পকেটেও লাগে, তখন সমীকরণ মেলাতে নিজেকে কসরৎ করতে হয় বৈকি!
এটা সত্যি যে জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে অন্যান্য দেশ আর যাই হোক বাংলাদেশের মতো দ্বিখণ্ডিত নয়। পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণেও ১৮০ ডিগ্রি উল্টে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে দেখা যায় কম। কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন। চরম রক্ষণশীল মানসিকতা যেখানে ‘হাইয়েস্ট লিবারেল’ আমেরিকানদের মন জয় করে নেয় সেখানে আদার ব্যাপারীদের একটু না চমকালে চলে?
বর্ণ বিদ্বেষ, অভিবাসন ইস্যু, একটি বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের প্রতি তার মারাত্মক ক্ষোভসহ নানা ইস্যুতে মারমুখী আচরণ যে ঝড়ের আশঙ্কা তৈরি করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্লেষকরা একে নির্বাচনী কৌশল বলছেন বটে। তবে ফাইল-পত্তর নিয়ে নিউইয়র্কের মেয়রের ট্রাম্প ভবনে দৌড়ে যাওয়ার দৃশ্য কোনোভাবেই স্বস্তিদায়ক নয়। ট্রাম্পবিরোধী আন্দোলন, গ্রেপ্তার, বিদায়ী রাষ্ট্রপ্রধানের বেজার মুখ- সব মিলিয়ে গা গুলোনো পরিস্থিতি। নির্বাচনী ইশতেহারের সিকিভাগও যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলে এসব শর্তে পড়ে যাওয়া মানুষগুলোর ভাগ্যে কী ঘটবে তা সবার জানা।
যুক্তরাষ্ট্র প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভেতর বেশ চাপা উত্তেজনা নজর এড়িয়ে যাওয়ার নয়। সে বিষয়ে পরে আসছি। প্রথমে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে কিছু কথা বলি। আশা প্রকাশ করা হচ্ছে, নতুন সরকার আসায় ওয়াশিংটন-ঢাকা সম্পর্কে খুব একটা প্রভাব পড়বে না। কারণ বাণিজ্য সম্পর্কে মাত্র পাঁচ বিলিয়নের রপ্তানিকারক দেশ বাংলাদেশ বেশি কী আর ফেইস করবে? তবে মোটা দাগের সম্পর্কের মোড়কে রয়েছে আরো অনেক কিছু।
দেশের প্রেক্ষাপটে প্রতি পাঁচটি পরিবারের মধ্য অন্তত একটি পরিবারের কেউ না কেউ প্রবাসী। আর গ্রিনকার্ডের দেশ আমেরিকা পছন্দের তালিকায় বরাবরই শীর্ষে। উন্নত আর নিরাপদ ভবিষ্যতের কাছে আমাদের লাল-সবুজের পতাকা যেন বড্ড মলিন। কী নেই প্রবাসে? ঘণ্টা হিসেবে পারিশ্রমিক, স্বাস্থ্যবিমা, জানমালের নিরাপত্তা, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিশ্চিত এক ভবিষ্যৎ। আখের গুছিয়ে রেখে তবেই দেশে থাকছেন এমন সংখ্যাও নেহাত কম নয়। কী আর করা? পোড়া দেশে যখন শোবার ঘরও নিরাপদ নয়, তখন হয় আমার মতো বেকুব নয়তো অপরাগরাই দেশে থেকে যায়। তবে এটাও ঠিক ব্যক্তিগত পছন্দে ‘প্রবাস জীবন’ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কারো কিছু করার নেই। তারপরও। ‘বংশোদ্ভূত’ বলে একটি শব্দ কিন্তু রয়ে যায়। ঠিক ঘুড়ি-লাটাইয়ের মতো।
৪০ লাখ অবৈধ অভিবাসীর মধ্যে কতভাগ বাংলাদেশি রয়েছে তা বলা মুশকিল। কোনোভাবে ধরা খেলে বা অন্য দেশে পাড়ি জমাতে না পারলে এরা কী করবে? ঘরের ছেলেরা ঘরে ফিরতে চাইতে পারে। কিন্তু ঘরে যেখানে বাড়ন্ত সংসার, সেখানে তাদের হাসিমুখে বরণ করা মুশকিল না? পররাষ্ট্রনীতির অংশীদারিত্বে হয়তো বিষয়টি পড়ে না। কিন্তু তাদের স্বরাষ্ট্রনীতির যাঁতাকলে আমাদেরও যে ছাতু হতে হবে এটা পরিষ্কার। আমার ভাবনার বিপরীতে কথা থাকতে পারে। সেটি নিশ্চয় কেউ না কেউ লিখবেন আশা করি। দেখুন, দেশের বিভিন্ন বিষয়ে আন্তর্জাতিক চাপের কথা আওয়ামী লীগ সরকার বরাবরই বলে এসেছে। দেশীয় রাজনীতিতে অন্য দেশের মাতব্বরি, মানবাধিকার প্রশ্নে কড়া সমালোচনা কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে নানা ধরনের উটকো ঝামেলা পাকানোতে ওস্তাদ কারা এটিও সময়ে সময়ে স্পষ্ট হয়েছে। খোলামেলাই বলছি- এই সমস্ত বিষয় বিবেচনায় ‘হিলারি বাংলাদেশের জন্য বন্ধুবর হতো না’ এই কথাটি অনেকে বলেছেন। কিন্তু সাংবিধানিকভাবে মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশ কট্টরপন্থী ট্রাম্পের কাছে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে বিবেচিত হবে তা বলি কীভাবে? ‘আপাদমস্তক ব্যবসায়ী’ ট্রাম্প আর ‘আপাদমস্তক রাজনীতিক’-এর পালস এক হবে না। তাই বিভিন্ন ইস্যুতে এখনই রিপাবলিকান ঘরানার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করা প্রয়োজন। বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত-পাকিস্তান-চীন-মিয়ানমারকে নিয়ে হোয়াইট হাউসের নয়া বাসিন্দার ভাবনাচিন্তা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ আমাদের জন্য। ভুলে গেলে চলবে না প্রতিবেশী যতই হাসিখুশি হোক স্বার্থ বিবেচনায় ছাড় দেয় না কেউ। দিলে আন্তর্জাতিক আদালতে দৌড়ানো লাগত না।
সম্প্রতি জাতিসংঘের ‘জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন’ (কপ-২২) হলো। গালগপ্পে ভরা এই সম্মেলন কাজের কাজ যে কী করে তা তো দেখাই যায়। এ কারণেই কিনা… ট্রাম্পের নির্বাচনী ইশতেহারে জুড়ে দেওয়া হয়েছে জাতিসংঘের পরিবেশ তহবিলে আর অর্থ ঢালা হবে না। সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং প্যারিস চুক্তিকে এর মধ্যেই ‘ইউ আর ফায়ার্ড’ বলে দিয়েছে ট্রাম্প। তাঁর ট্রানজিশন টিমে রেখেছেন এমন একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে যিনি জলবায়ু পরিবর্তনকে ‘কচু’ দেখান। এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সির (ইপিএ) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ওই ব্যক্তিকে। জ্বালানি হিসেবে ফসিল ব্যবহার করা হয় এমন কারখানার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এমন আরো অনেকে আছেন উপদেষ্টাদের তালিকায়। তার মানে কী দাঁড়াচ্ছে?
নির্বাচনী প্রচারণা কেবলই কথার ফুলঝুরি নয়, এটা কিন্তু জন কেরির কপালের ভাঁজও বলে দিয়েছে। কপ-২২ সম্মেলনে দেওয়া ভাষণে কেরি আশা প্রকাশ করেন- আসছে সরকার তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে পুনর্বিবেচনা করবে। কিন্তু ট্রাম্প যদি তাঁর অবস্থানে দৃঢ় থাকেন, তাহলে পরিণাম হবে ভয়াবহ। প্রশ্ন হলো এতে বাংলাদেশের মাথা ঘামানোর কী আছে? কেবল বাংলাদেশ নয়, এমন হলে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার মাথায় বাড়ি। বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন নোয়াম চমস্কি।
ওয়ার্ল্ড মেটেরোলজিক্যাল অর্গাইনাইজেশন (ডব্লিউএমও)-এর বরাত দিয়ে চমস্কি বলেন, তাপমাত্রার দিক দিয়ে গত পাঁচ বছর বিশ্ব ছিল সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত। রেকর্ড পরিমাণ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অপ্রত্যাশিত দ্রুতগতিতে গলে যাচ্ছে বরফ। এই অবস্থা কমবে না বৈ বাড়বে। ফলে জলের দেশ বাংলাদেশের মানচিত্রে আসতে পারে পরিবর্তন। গৃহহারা হবে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ। গোটা দক্ষিণ এশিয়াকেও ভুগতে হবে এর জন্য। জলবায়ুর এই পরিবর্তনের কারণে মিঠাপানির সরবরাহ ব্যবস্থা পড়ে যাবে হুমকিতে। এরই মধ্যে ভারতে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ খাবারের পানির অভাবে ভুগছে। অবস্থা আরো বিগড়ে গেলে কোথায় যাবে এই মানুষগুলো?
ধরে ধরে স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে হাত দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। তাঁর ক্রোধ আর বিচ্ছিরি ভাষা কতটা যে মারাত্মক তা নির্বাচনী প্রচারণার সময়ে দেখে অবাক হয়েছি। ক্ষ্যাপাটে ট্রাম্প গণমাধ্যমের ওপর যে পরিমাণ ক্ষ্যাপা, তার সুদূর পরিণাম কী হবে কে জানে। প্রতিপক্ষকে জিতিয়ে দিতে সর্বোচ্চ পক্ষপাতিত্ব করেছে মিডিয়া- এই অভিযোগ প্রথম থেকেই ছিল তাঁর। ক্ষমতায় বসার পর গণমাধ্যমকে যে বেশ ক’হাত দেখাতে ছাড়বেন না তিনি, তা অনুমান করা যায়। এর অংশ হিসেবেই হয়তো গণমাধ্যমকে এড়িয়ে সামাজিক যোগযোগমাধ্যমকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন তিনি। গণমাধ্যমের ছুড়ে দেওয়া নানা প্রশ্নের জবাবও দিচ্ছেন টুইট করে। এটি কিসের আলামত? একটি দেশের ষষ্ঠ স্তম্ভ গণমাধ্যম। সেটার স্বাধীনতায় যদি বারোটা বাজে তাহলে কী হয় সে তো সবারই জানা। আবার গণমাধ্যম যদি পক্ষপাতদুষ্ট হয় তবে তো কথাই নেই। এখন কথা হলো নিজেদের পিঠ বাঁচাতে যদি মার্কিন গণমাধ্যমের চেহারাতেও কট্টর ভাব আরো প্রখর হয় তাহলে তো জন্য আম-ছালা দুটোই যাবে। এমনিতেই উঠতে বসতে সব দোষ নন্দ ব্যাটার। তৃতীয় বিশ্ব বা সমানে সমান দেশকে এবার না জানি কোন কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়।
অভিবাসী প্রসঙ্গে আসি আবার। প্রচারণায় বর্ণ-ধর্ম-নারী বিদ্বেষী খিস্তিখেউর হতে পারে তাঁর নির্বাচনী কৌশল। তবে যা রটে তা তো কিছুটা বটেই। মেক্সিকো-আমেরিকার সীমান্তে প্রাচীর তোলার হুঁশিয়ারি এরই মধ্য হিস্পানিক আমেরিকানদের ভয় পাইয়ে দিয়েছে। এশিয়ান আমেরিকানরা বাদ পড়েনি এই আতঙ্ক থেকে। কোথাও দেয়াল, কোথাও কাঁটাতারের বেড়া। অর্থ আদায় হবে মেক্সিকান সরকারের কাছ থেকে, এমনটাই হুমকি দিয়েছিলেন ট্রাম্প। ভাগ্য বিপর্যয় এড়াতে এরই মধ্যে কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ নানা দেশে কড়া নাড়তে শুরু করেছে অভিবাসীপ্রত্যাশীরা। কিন্তু চাইলেই তো আর হয় না। এটি একটি দীর্ঘসূত্রতার বিষয়। এখন কোথায় ঠাঁই মিলবে তাদের? অন্যদিকে, মুসলিম প্রসঙ্গে ট্রাম্পের যে দৃষ্টিভঙ্গি তার সঙ্গে জেরুজালেমের তাল মেলানো কোন অমঙ্গলকে উসকে দেবে কে জানে? তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়াল? অধিকার রক্ষায় এবার আফ্রিকান-আমেরিকান, ল্যাটিনো, হিস্পানিক, এশিয়ান, খাঁটি আমেরিকানরা যে যার মতো অবস্থান নিতে শুরু করবে। তাহলে কি বর্ণ বিবাদ এবার চরমে উঠবে? আর এটা হয়ে থাকলে বাংলাদেশি ‘বংশোদ্ভূত’ আমেরিকানরাও পড়বেন সেই রোষানলে। ধর্ম-বর্ণকে প্যাকেজ করে যে ডিসকো বল বানিয়েছেন ট্রাম্প, তাতে কিন্তু ভালোই নেচেছেন ট্রাম্পীয় ভোটাররা। এটা ওদের বিষয় বলে হালকাভাবে নেওয়ার অবকাশ অন্তত আমি পাচ্ছি না। বাদামি চামড়ার ঘটি তাও আবার জন্মসূত্রে মজসিদগামী-বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মুসলমান অভিবাসীদের মনে এই ভয় কাজ করছে।
ধর্মের প্রসঙ্গ উঠল যখন, তখন এই বিষয়ে আরেকটু বলার লোভ সামলাতে পারছি না। ধর্ম-নিরপেক্ষতার এবং জঙ্গি দমন প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান পরিষ্কার। কিন্তু গলায় একটা কাঁটা কেমন খচখচ করে। সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ এখনো ইসলামী রাষ্ট্র। ওআইসির সদস্য বাংলাদেশ ফিলিস্তিনিদের পাশে যে রয়েছে, তা কি কেবলই মানবিকতার খাতিরে? ধর্মের প্রতি দুর্বলতা নয়? এই অবস্থায় জেরুজালেম-আমেরিকা, ফিলিস্তিন–বাংলাদেশ, নাহ হিসাবটি এত সহজ নয়। অন্তত ব্যবসায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কট্টরপন্থী চিন্তাভাবনা ডেমোক্রেটদের মতো হবে না বলে মনে হয়। জেরুজালেমের সঙ্গে ট্রাম্পের গভীর বন্ধুত্বের স্বীকারোক্তি আর জয়ী হওয়ার পর নেতানিয়াহুর উচ্ছ্বাস মুসলিম বিশ্বের জন্য কতটা স্বস্তিদায়ক হয়েছে তা ধারণা করা মুশকিল। এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্য ইস্যু, শিয়া-সুন্নি বিরোধ, জঙ্গিদের উগ্র ধর্মীয় আচরণ, ধর্ম বনাম ধর্ম পুরো আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে আরো কোন পর্যায়ে নিয়ে যাবে তা নিয়ে আলাপ-আলোচনার বুদ্ধি কিন্তু একজন চা দোকানিও রাখেন। বাংলাদেশিরা আর যাই বুঝুক না বুঝুক, রাজনীতিতে সমঝদার। তাদেরই আশঙ্কা- মুসলমানদের ব্যাপারে ট্রাম্পের ঢালাও মনোভাব বাংলাদেশি মুসলিম অভিবাসীদের বিপাকে ফেলতে পারে। ট্যারা দৃষ্টি পড়তে পারে বাংলাদেশের ওপরও। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটা অস্বীকারের তো উপায় নেই যে হলি আর্টিজানের দগদগে একটি ঘা আছে আমাদের? আমি কোনো বিশেষ ধর্মের পক্ষে সাফাই গাইতে রাজি নই। তবে সত্যিই অবাক হই যখন সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখি কথিত ধর্মনিরপেক্ষরা বলছেন- ‘যাক এবার অন্তত বাংলাদেশি মুসলমানরা বুঝবে সংখ্যালঘু হয়ে টিকে থাকার যন্ত্রণা’। আমার প্রশ্ন হলো এ দেশে যা হচ্ছে তার জন্য দায়ী কি ও দেশের অভিবাসীরা? নাকি অন্য দেশে যা হচ্ছে তার জন্য দায়ী আমরা? একজনের দায় আরেকজন কেন নেবে!
হায়রে দেশ আমার। পোশাকের মাধ্যমে ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করার স্বাধীনতা যেমন থাকা উচিত, তেমনি কে কতটুকু ধর্মীয় অনুশাসন মানবে তারও স্বাধীনতা থাকা চাই। আমি তো মনে করি সংখ্যালঘু-গুরু প্রসঙ্গ উত্থাপনই হাস্যকর। বরং ধর্মের নামে যে ব্যারিকেড, তা সর্বজনীনভাবে তুলে দেওয়া হোক। হলি আর্টিজানের রক্তাক্ত বাস্তবতা অন্তত আমার বিশ্বাসকে এভাবেই প্রবল করেছে। এখানে ধর্মই একমাত্র যুদ্ধের কারণ হলে আর যাই হোক বাংলাদেশের ইশরাত আখন্দকে মেরে ফেলা হতো না। আমেরিকান নাগরিক কিন্তু ‘বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত’ ফায়াজ-অবিন্তাকে নির্মমতার শিকার হতে হতো না। আবার পুরো বিশ্বজুড়ে ধর্মের নামে যে কোনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটত না। ফায়াজ-অবিন্তাদের মতো লাখো অভিবাসী মুসলিম আছে, যারা জন্মগতভাবে ধর্মের বেড়াজালে আটকানো কিন্তু অন্তরে সর্বজনীন। ট্রাম্প নিজে কি ধর্মের প্রশ্নে উদার? ইসরাইল বা ভ্যাটিকান কি তাদের আধিপত্য বিস্তারে সর্বোচ্চ অবস্থানে নেই? ওবামার নামের সঙ্গে থাকা হুসেইনকে কেন পছন্দ করেননি অনেক আমেরিকান? তার অর্থ হলো, হিজাব, সিঁদুর, ক্রস বা নির্বাণ লাভ কোনোটাই নিরাপদ নয়।
ধর্মবাজদের কাছে নিরাপদ নয় খোদ নিজের ধর্ম। এটা বোঝানোর সাধ্য কার? বরং প্রতিপক্ষ ভেবে প্রতিনিয়ত গালমন্দ করা অনেকটা বদ-অভ্যাসের মতো দাঁড়িয়েছে এখন। ধর্ম ফ্যাক্টর নয়। ফ্যাক্টর হলো ধর্মকে বর্ম করে ক্ষমতা দখল। না হলে এই প্রথম আমেরিকার কোনো প্রসিডেন্টের নির্বাচনী জয়ে যারপরনাই তাই খুশি হয় রাশিয়া? ট্রাম্পকে বন্ধু ভাবতে শুরু করেছে তারা। স্লোভেনিয়ার দুই নারীর জীবনসঙ্গী হওয়ার ইতিহাস হয়তো এই আস্থার পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে। সে যাই হোক। তবে এখানেও রয়েছে বিবাদের ভয়। কারণ, খোদ আমেরিকানরাই রাশিয়ার লম্ফঝম্প দেখতে পারে না। এই অবস্থায় ট্রাম্পের ব্যক্তিগত রাশিয়ান প্রীতি অসন্তোষ তৈরি করতে পারে ট্রাম্প-হিলারি উভয় শিবিরেই। রদবদল আসতে পারে পরাক্রমশীল অন্যান্য দেশের অবস্থানেও। বাংলাদেশের এই ক্ষেত্রে হয়তো বিশেষ কিছু আসবে-যাবে না। কারণ, রাশিয়ার সঙ্গে টেকসই বন্ধুত্বে এরই মধ্যে কৃতকার্য বাংলাদেশ। তবে রাজনীতির বলয় পরিবেশ পরিবর্তন আর গ্রিনহাউস ইফেক্ট অনেক আগেই শুরু হয়ে গিয়েছে। যার ভুক্তভোগী হয় শেষমেশ উন্নয়নশীল এবং গরিব দেশগুলো। ভয়টা ওখানেই।
কথায় বলে গাছে বেল পাকিলে তাতে কাকের কি? বিশ্বের কথিত মোড়ল আমেরিকার চেয়ারে নয়া চেয়ারম্যানের আবির্ভাব নিয়ে এখনো জাবর কাটছে সোশ্যাল মিডিয়া। আসছে জানুয়ারিতে আগামী চার বছরের জন্য গদিতে বসতে যাচ্ছেন ট্রাম্প। আবারও শুরু হবে আলোচনা। পরবর্তী বছরগুলোতে হয়তো বহুবার চায়ের কাপে ঝড় ওঠাবেন ক্ষমতার শীর্ষে থাকা এই ভদ্রলোক। তাতে কার কী হবে জানি না। কিন্তু চা দোকানি জামাল বেজায় খুশি। কারণ ট্রাম্পও ব্যবসায়ী, তিনিও ব্যবসায়ী। ছোট-বড় ব্যাপার না। মওকা মতো একচোট ব্যবসা করতে পারবেন- খুব একটা হাসি টেনে সেদিন বলছিলেন। ভালোই তো। সবাই যখন বেল পাকাতে অস্থির, খাই না খাই বেল গাছে আমি তাকালে ক্ষতি কি? ভাইরে, কাকে বেল খেতে পারলে সমস্যা নেই। কিন্তু বেল যদি কাককে খেয়ে ফেলার হুমকি দেয়, তাহলে কিছু না কিছু তো আসবে-যাবেই। মানেটা বুঝলেন তো!
লেখক : সাংবাদিক, মাছরাঙা টেলিভিশন।
এই সংক্রান্ত আরো সংবাদ
খেলার জগতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পেশাদারি কাঠামো
লাল-সবুজের তরুণ প্রজন্মের এ সময়ের প্রিয় শ্লোগান, ‘বাংলাদেশের জান, সাকিববিস্তারিত পড়ুন
আগস্টের শোককে শক্তি হিসেবে নিতে পারি আমরা তরুণেরা
“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তিবিস্তারিত পড়ুন
বাবা যখন ধর্ষক
যেখানে আপন বাবাই ধর্ষণ করে, সেখানে সৎ বাবার ধর্ষণ আমাদেরবিস্তারিত পড়ুন